বই পড়া হোক সামাজিক আন্দোলন

শামীম শিকদার
  প্রকাশিত : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৭:৩৬
অ- অ+

চলছে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। এ মাসের প্রথম থেকেই শুরু হয় অমর একুশে বইমেলা। অমর একুশে বইমেলাকে বলা হয় বাঙালির প্রাণের মেলা, বাঙালির মিলনমেলা। নতুন নতুন রঙিন মলাটে কত নতুন বইয়ের অভিষেক ঘটে এই মেলায় তার কোনো হিসাব নেই! মেলাজুড়ে শুধু সারি সারি নতুন মলাটের বই আর বই। এ যেন এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। মাসের প্রথম তারিখ থেকেই শুরু হয় মাসব্যাপী ‘অমর একুশে বইমেলা’। লেখক, পাঠক আর প্রকাশকের এক মিলনমেলা। শত-সহস্র বই প্রদর্শিত হয় দর্শনার্থীদের জন্য।

কবি ওমর খৈয়াম যথার্থ বলেছেন, ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে যাবে; কিন্তু একখানা বই অনন্ত যৌবনা, যদি তেমন হয় বই।’ বইপাঠে আনন্দ লাভের পথ শ্রেষ্ঠ। এছাড়াও বই আমাদের মায়া-মমতা, সহানুভূতি, মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে। সত্য ও সুন্দরের পথ দেখায়। বই শাশ্বত ও চিরন্তন সম্পদ। যার সঙ্গে পার্থিব কোনো ধন-সম্পদের তুলনা হতে পারে না। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রসারিত করে, মনকে করে উদার। যার ফলে মানুষের মন হয় সুশোভিত। মানবতার অমল আলোক লুকিয়ে আছে বইয়ের মধ্যে। মানুষ সব সময় সৌন্দর্যের পূজারী, এই সৌন্দর্য মানুষের মনকে নাড়া দিয়ে যায় বই। এছাড়াও বই সমাজের বাস্তব প্রতিচ্ছবির কথা বলে। সংসারে জ্বালা-যন্ত্রণা এড়ানো যায় বই পড়ে, শুধু তাই নয় অমিয় আনন্দ লাভ করা যায়। ভিনসেন্ট স্টারেট বলেন, ‘মানুষের আনন্দ লাভের পথ বহু বিচিত্র।’ বই তার একটি মাধ্যম ও জীবনবোধ জাগিয়ে তোলে, বই নিজেকে চিনতে সাহায্য করে, বই কল্পনার দুয়ার খুলে দেয়, অন্যের সামনে নিজের চিন্তা তুলে ধরতে সাহায্য করে,বই মনোযোগ এবং ধৈর্য বাড়ায়, আমাদের ভেতর মানুষকে জানতে সাহায্য করে, মানুষ হবার জন্যই ভালোবাসতে শেখায় বই।

প্রথম বাংলা অক্ষরে বই ছাপানো হয়েছিল ১৬৮২ সালে। বইটির কিছু ছেঁড়া পাতা পাওয়া গেলেও, বইটি পুরো পাওয়া যায়নি। তখনও ঢালাই করা বাংলা বর্ণের প্রচলন না হওয়ায় বইয়ের বর্ণগুলো ছিল তামার পাত থেকে মুদ্রিত। তারপর ১৭২৫ সালে জার্মানিতে আরেকটি বাংলা বই ছাপা হয়েছিল। সেটিরও ছেঁড়া পাতাসহ নানা নমুনা পাওয়া গেছে। বাংলায় লেখা সবচেয়ে পুরোনো মুদ্রিত বইয়ের নাম 'কৃপার শাস্ত্রের অর্থেভেদ'। বইটি লিখেছিলেন মনোএল দ্য আসসুম্পসাঁও। বইটি লেখা হয়েছিল ১৭৩৩ খ্রিষ্টাব্দে রোমান হরফে। ১৮৪৭ সালে রংপুরে 'বার্তাবহ যন্ত্র' বাংলাদেশের প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। রংপুরের পর ঢাকার ছোট কাটরায় ১৮৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত ছাপাখানাটিকে বাংলার পুরোনো প্রেস বলা যায়, যা পরে 'ঢাকা প্রেস' নামে পরিচিত হয়। এখান থেকেই 'দ্য ঢাকা নিউজ' পত্রিকা প্রকাশিত হতো। এ থেকে বোঝা যায় বইয়ের প্রচলন বেশ আগে থেকেই শুরু হয়েছিল।

অজানার দ্বার উন্মোচন করে বই। বই পড়ার অভ্যাসটি অনেকেই রপ্ত করেন না বা করতে পারেন না। বই জীবনীশক্তি সঞ্চার করে। মনের ক্ষুধা মেটায় বই। বই মানুষের চোখ ফোটায়। সে চোখ মাছির মাথার মতো নয়। মাছির মাথার চারিদিকে অসংখ্য চোখ আছে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে মাত্র দুটি চোখ দৃশ্যমান হয়। এ চোখকে অগণিত চোখে পরিণত করা যায় শুধুমাত্র বই পড়ে। মানবজীবন নিতান্তই একঘেয়ে দুঃখ-কষ্টে ভরা, কিন্তু মানুষ বই পড়তে বসলেই সেসব ভুলে যায়। জগতে শিক্ষার আলো, নীতি-আদর্শ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সভ্যতা, সাহিত্য-সংস্কৃতি সবই জ্ঞানের প্রতীক বইয়ের মধ্যে নিহিত। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতিমূলক কোনো মজাদার বইয়ের বিষয়বস্তু বা ঘটনা মানুষ সহজে ভুলে যায় না। পৃথিবীতে বিনোদনের কত কিছুই না আবিষ্কৃত হয়েছে, কিন্তু বই পড়ার নির্মল আনন্দের কাছে সেগুলো সমতুল্য হতে পারেনি। তাই জীবনের অবসর সময়গুলো বইয়ের নেশায় ডুবে থাকা দরকার। একদিন ভাষাবিদ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ছিলেন। লাইব্রেরিয়ান ভুলবশত লাইব্রেরিতে তালা দিয়ে বাড়ি চলে যান। পরদিন এসে দেখেন তিনি পড়ার মধ্যে নিমগ্ন আছেন। লাইব্রেরিয়ান তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, আপনি সারা রাত লাইব্রেরিতে ছিলেন? তখন তার ধ্যান ভেঙে গেল। তিনি মুখ তুলে তাকালেন। এ থেকে বুঝা যায় বইয়ের প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলে সবকিছু ভুলে বই নিয়ে পড়ে থাকা যায়।

একটা সময় ছিল যখন তরুণদের অনেকেরই অবসর সময় কাটত বই পড়ে। নতুন বইয়ের ভাঁজ খুলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টে পড়ার মধ্যে তারা অন্য রকম এক আনন্দ পেত। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসে কিংবা চায়ের দোকানে তরুণদের সাহিত্য আড্ডা বসত। সেসব আড্ডায় গল্প হতো শিল্প, সাহিত্য, রাষ্ট্র, সমাজ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে; ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো হয়ে উঠেছে খুব জনপ্রিয়। বই পড়া কমেছে, কমেছে বইয়ের উপযোগিতা। বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্র এখন শিক্ষিত তরুণ সমাজের দিনরাত্রির সঙ্গী। মননশীলতা চর্চার অভাবে সুকুমার বৃত্তিগুলো যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।

ক‘দিন আগে একটি পত্রিকায় পড়লাম, ইরানের একটি আদালতে নাকি সর্বোচ্চ শাস্তি বইপড়া। চমৎকার উদ্যোগ। যিনি বই পড়েন তিনি কখনো মন্দ কাজ করতে পারেন না। সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত। যথার্থ শিক্ষিত হতে হলে মনের প্রসার দরকার। তার জন্য বই পড়ার অভ্যাস বাড়াতে হবে। তাই বই পড়ার বিকল্প নেই। একজন ভালো মানুষ হতে হলেও বই পড়তে হবে। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। লেখকেরা মননশীল ও বৈচিত্র্যময় লেখার মাধ্যমে তরুণদের আকৃষ্ট করবেন। প্রকাশনা সংস্থাগুলোর উচিত সহনশীল মূল্যে সে বই বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া। অভিভাবকেরা বই পড়ার বিষয়ে উৎসাহিত কর উচিত সন্তানদের। এভাবে বই পড়াকে সামগ্রিক একটি সামাজিক আন্দোলনের রূপ দিতে হবে।

লেখক: প্রবন্ধকার

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
হামদর্দ বাংলাদেশের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভা অনুষ্ঠিত
পাবনা-ঢাকা সরাসরি এক্সপ্রেস ট্রেন চালুর দাবিতে মানববন্ধন
নড়াইলে পুকুরে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু
মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী খুন: ডিবির অভিযানে আরও দুইজন গ্রেপ্তার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা