রেনুর পরিণতি থেকে বেঁচে গেলেন আরেক নারী

মনিরুল ইসলাম
  প্রকাশিত : ২১ নভেম্বর ২০১৯, ১৯:৫৪| আপডেট : ২১ নভেম্বর ২০১৯, ১৯:৫৬
অ- অ+

বাড্ডার তাসলিমা আক্তার রেনুর কথা মনে আছে নিশ্চয়। ছেলেধরা গুজবে মুহূর্তেই তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। সেরকম আরেকটা গণপিটুনির ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল ঢাকার অদূরেই সাইনবোর্ড মোড়ে। হয়তো আমি সেখানে না গেলে শ্রমিকদের মারধরে মারা যেত মানুষটি।

বুধবার সকাল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবরোধ করে বাস-ট্রাক শ্রমিকরা। শুধু অবরোধ নয়, শুরু হয় তাদের নৈরাজ্য। স্কুল কলেজের বাস-ভ্যান পর্যন্ত তাদের নৈরাজ্য থেকে বাদ যায়নি। সেই ঘটনা কভার করতে গিয়েছিলাম।

বেলা ১২টার নিউজে সরাসরি সম্প্রচারের সময় দেখলাম, একজন নারীকে ৫০-৬০ জন শ্রমিক মারমুখী হয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে রাস্তায় আড়াআড়ি করে রাখা দুই বাসের মাঝখানে। আমি মিনিট খানেকের ভেতর লাইভ শেষ করে দৌড় দিয়ে গেলাম সেখানে। শ্রমিকরা গুজব ছড়ালো, সেই নারী নাকি ছুরি দিয়ে মারতে এসেছে। সেই গুজব মুহূতেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো সাইনবোর্ডের হাজার শ্রমিকের কাছে।

আস্তে আস্তে ওই নারীকে মারতে সেখানে জড়ো হয় অন্তত দুশো মানুষ। আমি জানি না কী মনে করে, ঝাঁপিয়ে পড়ে, শ্রমিকদের ঠেলে ওই নারীর কাছে গিয়ে আগলে ধরলাম তাকে। পিঠে কয়েকটা কিল-ঘুষিও পড়ল তখন। শুরু করলাম ওই মারমুখীদের সাথে চিৎকার আর তর্ক। ওদের ভাষ্য, ওই নারী ছুরি দিয়ে শ্রমিক মারতে আসছে, তাই তাকে পিটিয়েই মেরে ফেলবে।

আমাকে তখন শত শত মানুষ বলছে, আপনি সরে যান, ওকে মেরেই ফেলবো। আমাকে সরাতে ধাক্কাও দিলো কয়েকজন। মারমুখী সবার তখন রক্তচক্ষু। এটা দেখে, আরো শক্ত হলাম। জানি না কোন শক্তি আমার ওপর ভর করেছিল তখন। একাই প্রায় ১০-১৫জন ধাক্কা দিয়ে সরালাম।

আমি আমার পরিচয় দিয়ে, টিভি মাইক্রোফোন উঁচু করে বললাম, পারলে মহিলার গায়ে হাত দিয়ে দেখেন, তারপর কী করি! জানি ওরা মারা শুরু করলে আমার কিছুই করার থাকবে না। ওরা মারা শুরু করলে মুহূর্তেই নিথর হয়ে যাবে হতভাগ্য এই নারী। এসব ভেবেই আরও শক্ত হয়ে দুই হাত দিয়ে আগলে দাঁড়ালাম। মিনিট ১৫ ধরে এরকম চিৎকার-চেচামেচির পর কয়েকজন দূরে সরতে থাকলো দু-একজন। টিভি সাংবাদিক ওই নারীকে ঠেকাতে আসছে এটা দেখে কেউ কেউ পিছিয়েও গেল।

খানিকটা নিরাপদে এনে ওই ভুক্তভোগীকে নাম ঠিকানা জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু, অনেক মানুষের চিৎকারের আওয়াজে তার নাম ঠিকানা মনে নেই। শুধু মনে আছে তিনি বলছিলেন, ফেনী থেকে তার মুমূর্ষু মাকে নিয়ে ঢাকায় হাসপাতালে আসছিলেন। পথে শ্রমিকদের অবরোধে আটকা পড়েন অ্যাম্বুলেন্স। প্রায় ৫-৭ কিলোমিটার হেঁটে, সাইনবোর্ডে আসে শ্রমিকদের সাথে কথা বলে তার অ্যাম্বুলেন্স বের করে দেয়া যায় কি না। এতপথ হেঁটে আর মাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ওই নারীর অবস্থা তখন পাগলপ্রায়। এসময় আড়াআড়ি করে রাখা একটি বাসের হেল্পারের সাথে তার ঝগড়া হয়।

তারপরই রটানো হয়, তিনি নাকি ছুরি নিয়ে শ্রমিক খুন করতে এসেছেন। এই গুজব ছড়িয়ে, তাকে গণপিটুনি দিতে উদ্যত হয় শতশত মানুষ। আমি কাল থেকেই ওই ঘটনা বারবার ভাবছি যে, নাম ভুলে যাওয়া ওই নারী নির্ঘাত মৃত্যু থেকেই বেঁচে গেছে হয়তো। আমিও আমার দায়িত্বের বাইরে গিয়ে, শ্রমিকদের সাথে ঝগড়া ঠেলাঠেলি-হাতাহাতি-গালাগালি করে বাঁচাতে পেরেছি একজন মানুষকে। ওই নারীকে একদম নিরাপদে সরিয়ে দিয়ে ক্লান্ত মিনিট খানেক হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। পরে ওই নারীকে আর খুঁজে পাইনি। তার একটা সাক্ষাৎকার নেয়ার ইচ্ছে থাকলেও পাইনি তাকে। ঘটনার সময় ছবিটি তুলেছেন ডেইলি স্টার পত্রিকার ফটো সাংবাদিক রাশেদ সুমন ভাই।

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, যমুনা টেলিভিশন

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
নির্বাচনের আগেই ফ্যাসিস্টদের বিচার হবে : আইন উপদেষ্টা
ফিরে দেখা ৮ জুলাই: ‘বাংলা ব্লকেড’ শেষে সরকারকে আল্টিমেটাম, সমন্বয়ক কমিটি গঠন
নির্বাচিত হলে স্থানীয় সব সমস্যা সমাধানের আশ্বাস আমিনুল হকের
মিলন-জাদুর ঝলক কি দেখা যাবে আবার?
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা