ছদ্মবেশী বীর

অয়েজুল হক
| আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:৩৯ | প্রকাশিত : ২৫ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:৩৭

কোর কমান্ডার বিল্লাল খানের খুব প্রিয়মুখ হাসান। ছিপছিপে গড়নের উঠতি বয়সের যুবকের প্রশংসা না করে পারা যায় না। একদিন তামাশা করে সিনিয়র অফিসার জামিলকে বলেন, প্রভুভক্ত কুকুর এতটা অনুগত হয় না, হাসানের মতো।

জামিল বসের মুখে হাসানের প্রশংসা শুনে একগাল হেঁসে বলেন, ছেলেটা কে আমার ও খুব পছন্দ। ওকে রাজাকার বাহিনীর হেড করে দিলে মন্দ হয় না।

- অল্প বয়স যে!

- স্যার এসব ক্ষেত্রে বয়সের চেয়ে যোগ্যতা কী বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়?

বিল্লাল খান সিগারেটের সাদাটে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলেন, হুম। ঠিক বলেছ।

পরদিন হাসানের পদোন্নতি। ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়, হাসান রাজাকার বাহিনীর এ অঞ্চলের প্রধান। খবরটা গ্রামের পর গ্রাম ছড়িয়ে পড়ে।

প্রবীণ রাজাকারের দল কিছুটা মনোক্ষুণ্ণ হলেও পাক হানাদার বাহিনীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস দেখায় না কেউ। পেছনে, সামনে। হাসান দুর্দান্ত দাপটে তার কাজ চালিয়ে যায়। সুন্দর দিনের পর অসুন্দর দিন কী অপেক্ষায় থাকে! পারুলিয়া গ্রামে অভিযান চালাতে গিয়ে বড় ধরনের হোচট খায় পাক বাহিনী। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ঘেরাও করে আক্রমণ শানাতে প্রথমে ভেতর থেকে পালটা আক্রমণ। যেন ওরা প্রস্তুত হয়েই অপেক্ষায় বসেছিল। গোলাগুলি চলছে সে সময় পেছন দিক দিয়ে তীব্র ঝটিকা আক্রমণে একের পর এক লাশ পড়ে পাকবাহিনীর। ক্যাম্পে খবর আসার পর বিল্লাল খান চিন্তা, ক্ষোভে অস্থির। লাল চোখে পায়চারি করেন। হাসান ক্যাম্পে আসামাত্র ছুটে গিয়ে প্রশ্ন করেন, খবরটা আগেভাগে মুক্তিফৌজের কাছে কে জানিয়ে দিতে পারে হাসান?

- স্যার ক্ষমা করবেন। একটা গালি দিতে হবে।

- কী গালি দিতে চাও!

- ওই যে শয়তানের বাচ্চা শিমুল। ওদের গ্রামের ঘটনা। সেই হয়তো গ্রামের লোকজন আর মুক্তি বাহিনীর কাছে খবর পৌঁছে দিয়েছে। ইসস আমাদের এত্তো গুলো সৈন্য মারা পড়ল। অস্ত্র লুট... ভাবতে পারছি না স্যার।

- ওর প্রথম দিকে দেয়া বেশ কিছু ইনফরমেশনে আমরা সফল অভিযান চালিয়েছি। ওই গ্রামের স্বাধীনতাকামী বেশ কিছু মানুষ হত্যা করেছি। কিছু সুন্দরী মেয়েদের ক্যাম্পে...

হাসান মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, স্যার প্রথম দিকে বিশ্বস্ততা অর্জনের জন্য এমন করতে পারে। এখন তো আর প্রথম দিক নয়। সারাদেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠছে।

হাসানের কথামতো সন্দেহভাজন হিসেবে শিমুল কে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারা হয়। মরন চিৎকার শুনে বিল্লাল খানের দিকে তাকিয়ে হাসান বলে, স্যার সব মানুষ কী মরনের সময় এমন চিতকার দেয়?

- হু, তবে আওয়াজে ভিন্নতা আছে।

হাসানের মুখে হাসি, স্যার গাদ্দার, বেইমান গুলো মনেহয় একটু বেশি জোরে আওয়াজ দেয়।

- হতে পারে।

- কী কন স্যার, এতো মানুষ মারলেন! এ অভিজ্ঞতার ব্যপারে সন্দেহ থাকলে তো মুশকিল।

- কিসের মুশকিল?

- মুক্তিফৌজ যেকোনো সময় আমাকে মেরে ফেলতে পারে। আমি তো আর গাদ্দার না। মরনের সময় শান্তশিষ্ট থাকার চেষ্টা করবো। পারব না স্যার?

- ভয় পেয়ো না হাসান।

- মরনে আমার ভয় নেই স্যার। তবে বীরের মতো মরতে চাই। প্রতিশোধ চাই।

- আমিও তাই ভাবছি। পাল্টা আক্রমনে বিপর্যস্ত করে দেব সব।

- আজই অপারেশন হবে স্যার?

- হু, রাতে।

- তুমি শুধু খোঁজ দেবে ওরা কোথায় কোথায় আস্তানা গেড়ে আছে।

সুবোধ গোলামের মতো হাসান বলে, ইয়েস স্যার।

তখন দুপুর। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে রোদের খুব একটা তেজ নেই। হাসান রাজাকার বাহিনীর দশজন সদস্য নিয়ে অনুসন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। সামান্য পথ পেরিয়ে আনোয়ার, সানোয়ার, পলাশ কে তিন গ্রুপ করে তিন গ্রামে যেতে বলে। হাসান বেরোবে ছদ্মবেশে। একাই একশো। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে, বিকালের আগেই রিপোর্ট চাই আমার। বিকালে মন্টুর দোকানে সবাই চলে আসবে।

হাসান প্রায়ই মন্টুর দোকানে বসে চা খায়। মন্টু বিশ্বস্ত মানুষ হিসাবে সুপরিচিত। পাক হানাদার বাহিনী ঘাঁটি গাড়ার পর তার কাছ থেকে মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। ক্যাম্প থেকে খুব একটা দূরে নয় বলে জায়গাটা নিরাপদ মনে করে সবাই। সন্ধ্যা নামার আগেই একে একে সবাই মন্টুর চায়ের দোকানে হাজির হয়। হাসান রিপোর্ট নিতে শুরু করে। সাবের মাস্টারের বাগানবাড়ি, সিরাজুলের সফেদা বাগান...

সাধু গোছের ময়লা কাপড় পরিহিত বয়োবৃদ্ধ একজন বলেন, আজ কী অপারেশন হবে বাবা?

লোকটা মাঝেমধ্যে এই দোকানে চা খায়। আশেপাশে রাস্তায় ঝোপঝাড়ে ঘুমায়। মাথায় সমস্যা আছে বলে তাকে নিয়ে ঠাট্টা, মশকরা হয়। কেউ কিছু কিনে দিলে খায় না হলে ঘুপচি মেরে পড়ে থাকে।

- হবে মানে, আজই ফিনিস করে দেব সব।

রাত গভীর হতেই বিল্লাল খান ক্যাম্প ফাঁকা করে প্রায় শ'তিনেক সৈন্য অভিযানে প্রেরণ করেন। তিন গ্রামে এক সাথে আক্রমণ হবে। মুক্তিবাহিনীর সলিলসমাধি ছাড়া আর কিছু প্রত্যাশা করেন না তিনি। রাজাকারদের ভেতর হাসান, আর গোটা বিশেক সৈন্য নিয়ে ক্যাম্পে থেকে যান বিল্লাল খান। নিজের রুমে বসে একটা সিগারেট জ্বলিয়ে বলে, হাসান।

- ইয়েস স্যার।

- অভিযান কেমন শুরু করলাম?

- দারুণ স্যার।

হঠাত বাইরে গুলির শব্দ। প্রথমে থেমে থেমে তারপর এক নাগাড়ে।

হাসান মুখ কালো করে বলে, স্যার ক্যাম্পে আক্রমণ শুরু করেছে।

বিল্লাল খান উদ্বিগ্ন গলায় বলে, গুলির শব্দে মনে হচ্ছে ওরা চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছে।

- বাঁচতে হলে লড়তে হবে স্যার, যতক্ষণ জীবন থাকে।

বিল্লাল খান কথা না বলে লাড়াই করার জন্য বেরিয়ে যান। হাসান পিছুপিছু কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসে। আধাঘন্টার ভেতর লড়াই শেষ। মুক্তিফৌজ ক্যাম্প দখলে নেয়। হাসাব বিল্লাল খানের রুমেই বসে ছিল। শেষ পর্যন্ত কী হয় কে জানে! যা হয় সেটা হলো, হাতে গুলিবিদ্ধ বিল্লাল খানসহ হাসানকে ধরে নিয়ে যায়। বাকিরা লাশ হয়ে এখানে ওখানে পড়ে আছে।

সকালের দিকে খবর আসতে শুরু করে, মুক্তিফৌজ ওতপেতে বসে ছিল। ফাদে পা দেয়া মাত্র তীব্র আক্রমণে অভিযানে যাওয়া পাক হানাদার বাহিনীর অধিকাংশ মারা পড়েছে। দু'একজন পালিয়ে গেছে। ক্যাম্প গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আকাশে উঠেছে- বাংলাদেশের প্রথম সূর্য। বেলা বাড়তেই ক্যাম্প থেকে হাসান ও বিল্লাল খান দু'জন কে পিঠমোড়া দিয়ে বেধে বড় মাঠের পাশে একটা গাছে লটকানো হয়। মুক্তিফৌজের কমান্ডার সাহেব আসলেই গাদ্দার দুটো কে পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে। কিলবিল করে হাজার হাজার গ্রামবাসী জড়ো হতে থাকে। শুধু এ অঞ্চল নয় সারাদেশের পাক হানাদার পরাজিত। সবার চোখ মুখে বিজয়ের আনন্দ। কমান্ডার আসেন। সাথে সেই প্রবীণ বয়োবৃদ্ধ পাগল মানুষ। তিনি কথা বলেন প্রথম, এই হাসানের হাত খুলে দাও।

মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর কানাঘুঁষা চলে। বলে কী! একজন কমান্ডারের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করে, স্যার এই পাগল লোকটা কী বলে?

কমান্ডার গম্ভীর গলায় বলেন, তিনি পাগল না। মুক্তি সংগ্রামের অনেক উঁচু পর্যায়ের নেতা।

- তা এই গাদ্দারটাকে ছেড়ে দিতে বলছেন কেন?

কমান্ডার সাহেব মুচকি হাসেন, গাদ্দার বলো না। সে এক বীর যোদ্ধা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই পাগল লোকের কাছে ওদের ভেতরের সব তথ্য দিত। তিনি বলে দিতেন আমাদের করণীয় কী।

জনতাকে লক্ষ্য করে কমান্ডার সাহেব হাসানের সব কথা খুলে বলেন। উল্লাসিত জনতার স্লোগান, বীর ভাই, বীর হাসান।

বিল্লাল খান আগুন চোখে গর্জন করেন, ছদ্মবেশী গাদ্দার, বেইমান...

লেখক: কথাশিল্পী

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :