ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা, জাতীয় নিরাপত্তা ও রাজনীতি

কাজী মুস্তাফিজ
  প্রকাশিত : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৬:২৩| আপডেট : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৬:৫৮
অ- অ+
কাজী মুস্তাফিজ

এখন তথ্য ও প্রযুক্তির যুগে আমাদের বসবাস। তথ্যই প্রযুক্তির জ্বালানি। তথ্য ছাড়া প্রযুক্তি অচল। বিশ্বব্যাপী অবাধ তথ্যপ্রযুক্তির যে বিপ্লব শুরু হয়েছে তাতে ইন্টারনেটের সুবিধায় সারা পৃথিবী একটা নেটওয়ার্কের আওতায়। ভৌগলিকভাবে আমাদের রাষ্ট্রীয় সীমানা থাকলেও ভার্চুয়াল জগতে কোনো সীমানা নেই। এই প্রেক্ষাপটে ‘আপনার তথ্য টাকার মতো, এটিকে গুরুত্ব দিন’- এমন বার্তা প্রচার করছেন বিশ্বব্যাপী সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ভিশনকে উপলক্ষ করে নেয়া বিভিন্ন কর্মসূচির ফলে ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সারা পৃথিবীতে সব দেশ যেখানে তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ নেয়া শুরু করেছে সেখানে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে।

১৯৮১ সালে ইউরোপের বৃহৎ সংগঠন 'কাউন্সিল অব ইউরোপ'-এ কনভেনশন ১০৮ স্বাক্ষরের মধ্যদিয়ে বিশ্বে প্রথম ডেটা প্রাইভেসি ডে বা তথ্য সুরক্ষা দিবস উদযাপন শুরু হয়। বাংলাদেশেও ২৮ জানুয়ারি এই দিবস বহুদিন ধরে পালন হয়ে আসছে। ইউরোপে নাগরিকদের তথ্য কীভাবে ব্যবহার করা হবে তা নিয়ে জেনারেল ডেটা প্রটেকশন রেগুলেশন (জিডিপিআর) করা হয়েছে। এটি গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্যের ব্যবহারে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষমতা কমিয়ে আনার চেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এই নীতিমালার অধীনে আইন মেনেই ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করতে হবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পারিবারিক তথ্য ফাঁসের অভিযোগে তার ব্যক্তিগত সহকারী মেডেলিন ওয়েস্টারহাউটকে ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান 'ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা'র বিরুদ্ধে ফেসবুকের প্রায় আট কোটি ৭০ লাখ ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য ‘চুরি’র অভিযোগ ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ট্রেড কমিশন সেটির তদন্তের পর ফেসবুককে ৫০০ কোটি ডলার জরিমানা করে। ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার ‘চুরি করা’ এই তথ্য ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে এবং ব্রিটেনের ব্রেক্সিট গণভোটে প্রভাব বিস্তারের কাজে ব্যবহার করা হয়।

জাতীয় স্বার্থে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার গুরুত্ব

উদাহরণটা ফোনালাপ দিয়ে দিলে সুবিধা হবে। প্রায়ই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার সংবাদ আসে গণমাধ্যমে। প্রশ্ন ওঠে এগুলো কীভাবে ফাঁস হয়? নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে মানুষ নিজেদের দূরালাপনের জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। ব্যবসায়িক নীতির দিক থেকে গ্রাহকের ব্যক্তিগত আলাপের সুরক্ষা ওই কোম্পানি নিশ্চিত করাই স্বাভাবিক। এর ব্যতিক্রম হলে গ্রাহকের কাছে তারা দায়বদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে সেটির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। ফলে মানুষ বাধ্য হয়ে ইন্টারনেট সুবিধায় হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারসহ বিভিন্ন বিদেশি অ্যাপ ব্যবহার করছে। সব ধরনের প্রযুক্তিরই নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে এবং সাইবার দুর্বৃত্তরা তা কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে বিদেশি অ্যাপসগুলোর নিয়ন্ত্রণ বিদেশিদের হাতেই। যেসব অ্যাপস আমরা বিনামূল্যে ব্যবহার করছি সেগুলো প্রকৃতপক্ষে কতটা ‘বিনামূল্যে’? যেকোনো সফটওয়্যার ইনস্টল করার সময় আমরা কিছু শর্তে সম্মতি দিতেই হয়। সেখানে আপনার আলাপনের তথ্য (অডিও, ভিডিও, লেখা) রেকর্ড করে রাখার অনুমতি এবং কীভাবে কোন ক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করতে পারে সব বিষয় উল্লেখ থাকে।

মনে করুন আপনার ব্যক্তিগত আলাপন ওই অ্যাপস কোম্পানি সরাসরি কখনো প্রকাশ করল না। কিন্তু আপনিসহ আপনার দেশের অন্যান্য ব্যক্তির আলাপনে কোন ধরনের বিষয় প্রাধান্য পাচ্ছে সেটি চাইলে তারা সহজেই বিশ্লেষণ করতে পারে। কম পরিশ্রমে এ কাজ করার জন্য আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সফটওয়্যার যথেষ্ট। আরেকটু খোলাসা করে বললে, একটি দেশের নাগরিকদের রাজনৈতিক আলাপন বিশ্লেষণ করে রিপোর্ট তৈরির সুযোগ রয়েছে। আর সেই রিপোর্টের তথ্য যাদের কেনার আগ্রহ থাকবে এমন কোনো গোষ্ঠীর কাছে বিক্রির লোভ যে সামলে রাখতে পারবে প্রতিষ্ঠানগুলো সেই নিশ্চয়তা কে দেবে?

বিদেশিদের এ ধরনের গোয়েন্দা প্রতিবেদনের গ্রাহক বাংলাদেশের ভেতরে বাইরে দুরকমই হতে পারে। দুটোই রাজনৈতিক। জাতীয় রাজনীতি আর আন্তর্জাতিক রাজনীতি। ভেতরে হলে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থ থাকবে। আর দেশের বাইরে হলে সেটাও সেসব অপশক্তি কাজে লাগাবে যারা মুক্তিযুদ্ধের আগ থেকে বাংলাদেশের ধনসম্পদ লুটেপুটে খাওয়ার জন্য হাঁ করে বসে আছে। এই অঞ্চলকে সব সময় অস্থিতিশীল করে রাখতে চায় তারা। অপার সম্ভাবনাময় স্বাধীন বাংলাদেশের ভূখণ্ড আমাদের জন্য স্রষ্টার অনেক বড় দান। আর এজন্যই ইর্ষান্বিত হয়ে আমাদের উন্নয়ন ব্যাহত করার জন্য দুজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করিয়েছে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা। স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও কি এ থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার কিছু নেই?

তথ্য সুরক্ষা নাগরিকের অধিকার

রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে তার সব ধরনের নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ (খ) নম্বর অনুচ্ছেদে প্রাইভেসি বা ব্যক্তির তথ্য সুরক্ষা ও গোপনীয়তা মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণা (অনুচ্ছেদ ১২) নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সনদ (অনুচ্ছেদ ১৭), জাতিসংঘের কনভেনশন অন মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স (অনুচ্ছেদ ১৪) এবং শিশু অধিকার সনদ (অনুচ্ছেদ ১৬)-এ প্রাইভেসিকে অধিকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের কোনো আইনে নাগরিকের তথ্য সুরক্ষার বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা বা নীতিমালা, কিছুই নেই।

২০০১ সালে পাস হওয়া বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন ২০১০ সালে সংশোধন করা হয়। তখন ফোনে আড়ি পাতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। সরকারি সংস্থাগুলোর বাইরে যেকোনো ব্যক্তির কথোপকথন আড়ি পেতে রেকর্ড করলে বা প্রচার করলে দুই বছর কারাদণ্ড এবং পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু গ্রাহকের ব্যক্তিগত তথ্য কোথায় কীভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবহার করবে সে বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় স্বার্থে আড়ি পাতা হলে এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ক্ষমতায় যাওয়ার পর একজন জনপ্রতিনিধি যে শুধু তার দলের নয় বরং প্রত্যেক নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করছেন, সেটি ভুলে যান। নেতৃস্থানীয় জায়গায় থেকেও আমরা দলমতের ঊর্ধে¦ থেকে কাজ করার মানসিকতা পোষণ করতে পারি না।

শেষ কথা

শেষ করব অর্থনীতিবিদ ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর একটি কথা দিয়ে। সম্প্রতি তিনি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, তিনটি নীতি মেনে চললে সমাজে অশান্তি থাকবে না। মানুষ একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করবে না, অন্যায়ভাবে গায়ে হাত তুলবে না এবং একজনের ব্যক্তিগত তথ্যে অনৈতিকভাবে অন্য কেউ প্রবেশ করবে না। তাই সত্যিকার অর্থে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে দেশীয় প্রযুক্তিগুলোর প্রসারে গুরুত্ব দিতে হবে এবং এজন্য সংশ্লিষ্ট বেসরকারি খাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সব ধরনের প্রযুক্তিসেবায় দেশী উদ্যোগগুলো জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। নয়তো ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে সাইবার রাজনীতির যে মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে।

লেখক: সাংবাদিক; প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন।

[email protected]

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বেইলি রোডে ক্যাপিটাল সিরাজ সেন্টারে আগুনের সূত্রপাত নিয়ে যা জানা গেল 
শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করতে পারেন জর্জিয়া মেলোনি: ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্তেও
২৫ মার্চ কালো রাতকে হার মানিয়েছে শাপলা গণহত্যা: রাশেদ প্রধান
দেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন খালেদা জিয়া
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা