করোনায় মানসিক শক্তি বাড়ানোর উপায়

ড. মেহতাব খানম, অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
| আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০২০, ১৬:৩৮ | প্রকাশিত : ১৬ এপ্রিল ২০২০, ১৫:৫২

প্রতিরোধই এখন করোনা মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর। তাই আতঙ্কিত না হয়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। এজন্য প্রয়োজন মানসিক শক্তি। এছাড়া মানসিক শক্তি আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও ইতিবাচক ভাবে বাড়িয়ে দেয়। করোনাভাইরাসের এই সময়ে মানসিক শক্তি বাড়ানোর উপায় জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম।

গোটা বিশ্বজুড়ে এখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমরা মৃত্যুর খবর পাচ্ছি, তাতে করে কারো পক্ষে এখন ভালো থাকা সম্ভব নয়। আমাদের প্রতি মুহুর্তে ভীষণ সংশয় কাজ করছে। আতঙ্ক কাজ করছে। খুব অনিশ্চয়তা আবং অসহায়ত্বের মধ্য দিয়ে আমদের সময় কাটছে।

এইযে সময়ের একটি ভিন্নতা চলে এসেছে আমাদের জীবনে। তার পরেও কী করে আমরা ভালো থাকতে পারি। সেই উপায়টি খুঁজতে হবে।

আমি খবর পাচ্ছি। অনেকে ঘুমাতে পারছেন না। তারা দুঃস্বপ্ন দেখছেন। অনেকে বলছেন তারা ঘরবন্দি থাকার ফলে, ঘরে সবার সঙ্গে থাকার ফলে অনেক সময় সম্পর্কের অবনতি ঘটছে। অনেক সময় তারা বাড়ির কাজগুলো করার সাথে সাথে বাইরের কাজগুলো করছেন। বিশেষ করে কর্মজীবী মহিলা যারা আছেন। তারা বাড়ির কাজ করছেন। সন্তানদের দেখাশোনা করছেন। ঘরের খেয়াল করছেন। এবং তারা অফিসের কাজও করছেন।

এটি কিন্তু সহজ নয়। বেশ কঠিন একটি কাজ। কাজেই এতো কিছুর ভেতরে আতঙ্ক নিয়ে ঘর এবং বাড়ির সমস্ত কাজগুলো সামলে ভালো থাকাটা অনেক কঠিন হচ্ছে।

তাই আমি বলব, আমাদের শরীর এবং মন এসময় যত্ন করা অতীব প্রয়োজন। শরীরের যত্নের ব্যপারে অনেকে অনেককিছু বলছেন। সুষম খাবারের কথা বলছেন। ভালো লাইফস্টাইলের কথা বলছেন। সেগুলো তো আমরা করবই।

আমি মনের যত্নের দিকে বেশি জোর দেব। প্রথমেই বলব শরীর চর্চার কথা। অনেকে মনে করেন শরীর চর্চা করলে শুধু শরীরই ভালো হয়। শরীরের উপকার হয়। শুধু তা কিন্তু নয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন শরীর চর্চা করলে মনেরও অনেক উপকার হয়। মনের স্বাস্থ্য ভালো হয়। এটি প্রমাণিত যে, শরীর চর্চার ফলে আমাদের এ্যানজাইটি কমে যায়। আমাদের ডিপ্রেশন কমে যায়। আমাদের স্ট্রেস ম্যানেজ করার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। আর এটি যখন ঘটে তখন আমাদের মনের স্বাস্থের উন্নতি ঘটার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বেড়ে যায়।

যেহেতু করোনাভাইরাস একটি অসুস্থ্যতা। যখন আমাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ছে । তখন আমাদের শরীর ও মন ভালো রাখার জন্য অনেক কাজ করছে।

এরপর আমি বলব মেডিটেশনের কথা। মেডিটেশন হয়তো অনেকেই করেন। মেডিটেশন করার ফলে আমাদের যেটি হয়। আমাদের মন ভবিষ্যতেও যায় না , অতীতেও যায় না। মনের একটি ধর্ম হচ্ছে- মন খুব ছোটাছুটি করে। একদম পাখির মতো। কখনো অতীতে চলে যায় , কখনো ভবিষ্যতে চলে যায়।

বর্তমানে একেবারেই থাকতে চায় না। মেডিটেশন করার মাধ্যমে আমরা আমাদের মনকে ধরে রাখতে পারি। মনের সমস্ত অনুভূতি এবং সমস্ত আবেগ বর্তমানে ধরে রেখে মনকে বিশ্রাম দিতে পারি। মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দিতে পারি। এতে করে আমাদের যে এনার্জিটা তৈরি হচ্ছে। সেটি আমরা কাজে লাগাতে পারি। বর্তমানে আমাদের মন থাকার একটি অভ্যেস হয়ে যায়। এজন্য কিছুটা সময় নিয়ে আমরা মেডিটেশন করতে পারি।

আমি যে মেডিটেশনটি করি সেটা হচ্ছে- মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন। সেটি খুব অল্প সময়ে ঘরে বসেই করা যায়। সেটিতে আমাদের যে ইন্দ্রিয়গুলো আছে। পাঁচটা ইন্দ্রিয় আছে। ইন্দ্রিয়গুলোকে কাজে লাগিয়ে মেডিটেশনগুলো ডিজাইন করা হয়েছে। আমরা ইনটারনেটে সে মেডিটেশনগুলো পেয়ে যাব। আমরা চেষ্টা করব সেই মেডিটেশনগুলো করার জন্য।

এরপর আমি বলব এক্সারসাইজের কথা। যেটিকে ব্রিদিং এক্সারসাইজ বলে। সেটি আমরা করতে পারি। সেটি হচ্ছে একটি কমফর্টেবল জায়গায় বসে আমরা বড় করে নিঃশ্বাস নিয়ে কিছুক্ষণ ধরে রেখে ধীরে ধীরে ছেড়ে দেব। নিঃশ্বাস যখন আমরা নিচ্ছি সেই নিঃশ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেন আমাদের মস্তিষ্কে চলে যাচ্ছে। যখন ব্লাড সার্কুলারে চলে যাচ্ছে। সেটা আমাদের গোটা শরীরকে একটি স্বস্তি দেয়।

আমাদের মনটা ভালো করে দেয়। কাজেই আমরা প্রতিদিন নিয়ম করে এই ডিপ ব্রিদিংয়ের এক্সারসাইজটা করব।

এরপর আমি বলব এইযে আমরা সুযোগ পেয়েছি। একসাথে পরিবারের লোকজনের সাথে থাকার, সময় কাটাবার। বড় একটা সুযোগ পেয়েছি ঘরবন্দি হওয়ার ফলে। আমরা এই সুযোগটিকে কাজে লাগাই। আমরা এর অপর্চুনিটির সাইটটা দেখি। আমাদের মনমালিন্য হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কথা কাটাকাটি হয়ে যাচ্ছে। সেটি কিন্তু খুব স্বাভাবিক। তারপরেও আমরা কী করে আমাদের সম্পর্কের বন্ধনগুলো কী করে আরও দৃঢ় করতে পারি। সেগুলো নিয়ে কিন্তু আমরা আলোচনা করতে পারি।

পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে পারি। আমাদের কিছু খেলাধুলা, কিছু আনন্দের বিষয়গুলো একসাথে করতে পারি। এটি করলে এই সময়গুলো আমরা খুব সুন্দর করে কাটাতে পারি।

এরপর আমি বলব আমাদের জীবনে শুধু পরিবারের লোকজনই নয়। আমাদের আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী আছেন। আমরা কিন্তু তাদের খবর এখন নিতে পারি।

অনেকদিন যাদের খবর নেওয়া হয় নি। যাদের আমরা ভালোবাসি। যারা আমাদের ভালোবাসেন। যারা আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী, তাদের খবরগুলো কিন্তু নেওয়ার এখন সময়। আমরা এখন চেষ্টা করতে পারি প্রতিদিন কারো না কারো খবর নিতে। বিশেষ করে যারা অসুস্থ আছে তাদের খবর নিতে পারি। কারো কিছু দিতে পারলে কিন্তু মন ভালো হয়ে যায়। সুতরাং এসময় আমরা চেষ্টা করব সাধ্যমত পাশে দাঁড়াবার। সাহায্য সহযোগিতা করার।

একজন সাইকোলোজিস্ট বলেছেন- যখন মনে করবেন ভেতরটা একদম নিঃশেষ হয়ে গেছে। তখন আমরা ভাবতে পারি কাকে কী দেওয়া যেতে পারে। কাজেই কাউকে কিছু দেওয়ার যে স্বস্তিটা যে শান্তিটা । সেটি কিন্তু এখন আমরা এইসব কাজের মাধ্যমে নিতে পারি।

সর্বপরি আমি বলতে চাই সৃষ্টি কর্তার কাছে আমরা হাত তুলে ক্ষমা চাওয়া। একদম আন্তরিকভাবে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তাঁর কাছ থেকে এখন শক্তি চাইতে পারি।

কারণ আমাদের সৃষ্টিকর্তার শক্তি হচ্ছে অফুরন্ত। যা কখনো শেষ হয় না। কাজেই আমাদের ভেতরে যতই কষ্ট হোক না কেন, তাঁর কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে চার কাছ থেকে শক্তি চেয়ে আমরা নিশ্চয় ভালো থাকব।

আমরা চেষ্টা করব সেলফ কেয়ার করতে। সেলফ কেয়ার এবং শেলফিস কিন্তু এক জিনিষ নয়। আমরা যদি শেলফিস না হয়ে সেলফ কেয়ার করি। সেলফ কেয়ার করলে নিজেরা ভালো থাকা যাবে। নিজের যত্ন নেওয়া হবে। নিজে ভালো থাকলে অন্যদের ভালো থাকাটাও নিশ্চিত হবে।

কাজেই সেলফ কেয়ারটা পরিপূর্ণভাবে করি। যাতে অন্যের যত্নগুলোও আমরা করতে পারি। ভবিষ্যতে কী হবে আমরা জানি না। ভবিষ্যৎ আমাদের একেবারেই অজানা। সুতরাং ভবিষ্যতের চিন্তা এখন মাথায় এলেও বর্তমানের চিন্তা করে আগামীর জন্য ভালোকিছু সঞ্চয় করে রাখি। আমরা জানি না এরপর আমাদের ভাগ্যে আম কী আছে। তারপরেও যায় আসুক না কেন আমাদের ভাগ্যে এখন যদি ভালো থাকি অন্যদের ভালো থাকার চিন্তা করে সামনে আগাতে থাকি। তাহলে ভবিষ্যতে যদি আরও কিছু ঝড়ঝাঞ্জা আসে সেগুলো মোকাবিলা করার শক্তি কিন্তু আমাদের বাড়বে।

সবাইকে আমার অনেক অনেক শুভেচ্ছা। সবাই সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন এই কামনা রইলো।

লেখক: ড. মেহতাব খানম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক।

অনুলিখন: শেখ সাইফ

ঢাকাটাইমস/১৬এপ্রিল/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :