এখন ইংরেজি ভাষায় স্বদেশি সাহিত্যচর্চার সময় এসেছে

মোজাফফর হোসেন
 | প্রকাশিত : ১৮ মে ২০২০, ১৫:৫০

বাংলাদেশের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র/শিক্ষকরা ইউরোপ বা আমেরিকার ইংরেজি সাহিত্যের মূলধারার গবেষণা বা সমালোচনায় মৌলিক বা উল্লেখ করার মতো কোনো অবদান কি রাখতে পেরেছেন? আমি দেখেছি, ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রছাত্রী-শিক্ষকরা এমফিল-পিএইচডি করেন ইংরেজি সাহিত্যের বিষয়আশয় বা লেখকদের নিয়ে। অধিকাংশ সময় হয় এগুলো খুব চর্বিত বিষয়।

একটা ইংরেজি জার্নালের লেখা সংগ্রহ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। ইংরেজি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্রছাত্রী কিংবা নবীন শিক্ষকরা প্রবন্ধ পাঠাচ্ছেন, কারো বিষয় ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় প্রকৃতি, কারো শেকসপিয়ারে প্রেম, কারো এলিয়টের প্রবণতা, কারো ব্রন্টি বা উলফয়ের নারী চরিত্র, কামুর অস্তিত্ববাদ, কেউ যদি একটু আপডেটেড হন তো তার বিষয় ঝুম্পা লাহিড়ির ডায়াসপোরা সাহিত্য। গুগল করলে এসব বিষয়ে শত শত লেখা পাওয়া যাবে। বই তো আছেই। এমফিল/পিএইচডির বিষয়ও অধিকাংশ সময় অনুরূপ।

আমার কথা হলো, এসব লেখা কাদের জন্য? আদৌ ইংরেজি সাহিত্যের কোনো কাজে আসে কিনা। বিদেশি কোনো ছাত্রছাত্রী তো অনেক দূরের কথা বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও রেফারেন্স হিসেবে এসব লেখা শ্রেণিকক্ষে পড়ানো হয় না। আমি ৬ বছরের শিক্ষাজীবনে সিলেবাসভুক্ত কোনো টেক্সট নিয়ে বাংলাদেশি ছাত্র বা শিক্ষকের কোনো লেখা পড়িনি; শিক্ষকদেরও পড়তে দেখিনি।

অথচ তারা খুব সহজেই বাংলা সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে অবদান রাখতে পারতেন। তারা ইংরেজি ভাষায় বাংলা সাহিত্য নিয়ে প্রবন্ধ বা নিবন্ধ লিখতে পারতেন। পিএইচডির বিষয় হতে পারত আমাদের সাহিত্য। ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশুনা করে বাংলাদেশের সাহিত্যে অবদান রাখার বড় সুযোগ এটা। এমন যদি হতো তারা ইংরেজিতে লিখে মূলধারার ইংরেজি সাহিত্যে অবদান রাখছেন তাহলে এসব না বলে বরঞ্চ ধন্যবাদই দিতাম।

আমি যেটা বলছি সেটা যে সম্ভব তা ইতোমধ্যে ভালোমতো করিয়ে দেখিয়েছেন যে অল্প কয়েকজন তাদের মধ্যে দুজন ব্যক্তির নাম আমি করছি। আপনারা তাদের আমার চেয়ে ভালো চেনেন। অধ্যাপক ফকরুল আলম। তিনি ইংরেজি ভাষায় জীবনানন্দ দাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে কাজ করেছেন। বাংলা ভাষার ক্লাসিক ‘বিষাদ-সিন্ধু’ ও বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর ইংরেজি অনুবাদ তাঁর বড় কাজ। অন্যজন অধ্যাপক কায়সার হক।

তিনিও অনুবাদ ও প্রবন্ধ দুই দিক থেকেই বাংলা সাহিত্যকে ইংরেজি ভাষায় চর্চার মাধ্যমে বাংলাদেশের সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্যের অনেক কিছু অনুবাদ করেছেন।

খুব সম্প্রতি মনসামঙ্গল থেকে তাঁর The Triumph of The Snake Goddess বইটি Harvard University Press থেকে প্রকাশিত হয়েছে। [এ দুজনের মতো বেশ কয়েকজন তরুণ এবং অগ্রজ লেখক আমার বন্ধুতালিকায় আছেন, ধন্যবাদ জানিয়ে বলে রাখি বর্তমান আলোচনার বিষয় তাঁরা নন।]

আবার ইংরেজি ভাষা জেনে অন্যভাবেও বাংলা সাহিত্যে অবদান রাখা যায়। বিশ্বসাহিত্য বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে অথবা বিশ্বসাহিত্য নিয়ে বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ লিখে বা গবেষণা করে। এক্ষেত্রে অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। বুদ্ধদেব বসু থেকে শুরু করে কবীর চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবদুস সেলিম, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, খালিকুজ্জামান ইলিয়াস, জি এইচ হাবীবসহ আরো অনেকে আছেন। এনারা কেউ অনুবাদ করেছেন কেউ বিদেশি সাহিত্য বাংলা ভাষায় চর্চা করেছেন।

নোরা নিয়ে আমি ইংরেজিতে অনেক প্রবন্ধ পড়েছি। কিন্তু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘নোরা তুমি কোথায় যাবে?’ এরকম প্রবন্ধ পড়িনি। এখানে তিনি বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের স্বেচ্ছায় স্বামী-সংসার ছেড়ে যাওয়া নারীচরিত্রের সঙ্গে নোরার তুলনামূলক পাঠ উপস্থাপন করেছেন। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘অলস দিনের হাওয়া’র কথা কে না জানে! ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রশিক্ষকের কাছে বাংলা সাহিত্য এটাই প্রত্যাশা করে।

এদেশের প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষায় অনার্স-মাস্টার্স করানো হয়। প্রতিবছর হাজার হাজার কথিত মেধাবীরা সেখানে পড়ার সুযোগ পান। এত বছরে বাংলাদেশে বসে ইংরেজি ভাষায় ‘ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় প্রকৃতি’এইজাতীয় প্রবন্ধ লিখে বিশ্বের মূলধারার ইংরেজি সাহিত্যে যেহেতু কোনো অবদান রাখতে পারেনি, তাদের এখন ইংরেজি ভাষায় স্বদেশি সাহিত্যচর্চার সময় এসেছে।

যে সকল ছাত্র-শিক্ষক মনে করেন যে কেবল ইংরেজি ভাষা শেখা বা শেখানো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের কাজ। তাদের আমি এই আলোচনার ভেতর টানছি না। খুশি হবো তাদের জন্য প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা করে ইএলটিতে অনার্স-মাস্টার্স চালু হলে। তাতে হয়ত ইংরেজি সাহিত্যে কম ছাত্রছাত্রী ভর্তি হবে। হোক, তাতেই মঙ্গল।

এক্ষেত্রে, দেশের ইংরেজি দৈনিকের সাহিত্যপাতার ভূমিকাও অনেক সময় প্রশ্নবিদ্ধ। ‘ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় প্রকৃতি’ এ-জাতীয় লেখা তারাও মাঝেমধ্যে প্রকাশ করে। গুগল করলে পাঠক যখনই একই বিষয়ে এর চেয়ে অনেক ভালো লেখা শতশত পাবে, তখন সেটা প্রকাশের কোনো কারণ খুঁজে পাই না। বরং ‘জসিমউদদীনের কবিতায় প্রকৃতি’ বিষয়ে ইংরেজিতে প্রবন্ধ ছাপা হোক। অনেক সময় দেখি বিদেশি বইয়ের রিভিউও তারা প্রকাশ করে।

ধরুন মুরাকামি/অ্যাটউডের একটা নতুন বইয়ের রিভিউ ঢাকার কোনো ইংরেজি দৈনিক প্রকাশ করল। [উল্লেখ্য, বাংলা ভাষায় করা হলে প্রশ্ন তুলছি না, তার প্রয়োজন আছে] দেখা গেল, গোটা তিরিশেক ভালো রিভিউ ইতোমধ্যে ইংরেজি ভাষায় হয়ে গেছে। গুগল করলেই পাওয়া যাবে। তারা এক্ষেত্রে খুব সহজেই বাংলা ভাষার কোনো বইয়ের ইংরেজিতে রিভিউ প্রকাশ করতে পারেন। মাঝে মধ্যে সেটা করাও হয়। কিন্তু রিভিউয়ের ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ বাংলাদেশের বই কেন নয়?

একজন সম্পাদককে এই প্রশ্ন করার পর তিনি বললেন, তিনি চান বাংলাদেশের বই রিভিউ করাতে কিন্তু ইংরেজির ছাত্র-শিক্ষকরা বাংলা ভাষার বইয়ের রিভিউয়ে আগ্রহ দেখান না। গুগল থেকে পাঠ-সহায়তা নেওয়া যাবে না এই কারণে নিশ্চয় না। ধরে নিচ্ছি, তাঁরা ঢাকায় বসে মূলধারার ইংরেজি সাহিত্যে অবদান রাখতে চান। তাদের জন্য শুভকামনা জানানো ছাড়া আর কীইবা বলা যেতে পারে?

এখানে বলে রাখি, যারা বাংলাদেশে থেকে ইংরেজি ভাষায় সৃজনশীল সাহিত্যচর্চা করেন বা করতে চান তাঁদের আমি অভিনন্দন জানাই। বাংলাদেশি ইংরেজি সাহিত্যের একটা ঐতিহ্য দাঁড়াক এটা আমি মনেপ্রাণে চাই। আমাদের দেশের গল্প ইংরেজি ভাষায় লেখা হোক। এর মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাষার সাহিত্যও উপকৃত হবে। বাংলা সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ আরো সহজ হয়ে যাবে। সহজ হবে বাংলাদেশের সাহিত্যের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং।

আমার এই বক্তব্যের সঙ্গে যে কোনো প্রকারের দ্বিমতকে স্বাগত জানাই। কারো বিকল্প মত গ্রহণযোগ্য হলে নিশ্চয় আমি নিজেকে সংশোধন করব।

আমার দাবি: দেশের প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সিলেবাসে বাংলা সাহিত্য ইংরেজি অনুবাদে অন্তর্ভুক্ত হোক। বিভাগের ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের কোনো লেখক/বই/বিষয় নিয়ে ইংরেজিতে প্রবন্ধ লেখা বা গবেষণার পরিবেশ তৈরি হোক।

শুধু বাংলা ভাষার দুয়েকটি ভালো বই ইংরেজিতে অনুবাদ করলেই বাংলাদেশের সাহিত্য আন্তর্জাতিকীকরণের দিকে এগিয়ে যাবে না। বাংলা সাহিত্য পঠনপাঠন ও চর্চার একটা ইংরেজি ভাষাগত ঐতিহ্য তৈরি করতে হবে। দেশের ভেতর সেটা না হলে বিদেশে কিভাবে হবে?

বাংলাদেশের একজন ইংরেজি জানা ভালো লেখক ইংরেজি ভাষায় ঢাকার ইংরেজি পত্রপত্রিকায় মুরাকামি কিংবা অ্যাটউডের বইয়ের রিভিউ করে নিজের এবং ঐ পত্রিকার সময় ও সক্ষমতার অপচয় করলে হবে?

লেখকঃ গল্পকার

ঢাকাটাইমস/১৮মে/এসকেএস

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :