আদিবাসীবান্ধব হোক উন্নয়ন কর্মসূচি

সুব্রত বিশ্বাস শুভ্র
 | প্রকাশিত : ০৯ আগস্ট ২০২০, ১১:০১

আজ ৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। প্রতি বছর আগস্ট মাসের ৯ তারিখে সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়। আদিবাসীদের অধিকার, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে সুরক্ষা প্রদানের স্বার্থে ১৯৯৪ সাল থেকে জাতিসংঘ দিবসটি পালন করে আসছে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়। আদিবাসী জনগোষ্ঠী এ দিবসটিকে তাদের নিজেদের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি উপস্থাপনের পাশাপাশি তাদের দাবি-দাওয়া নিজ নিজ রাষ্ট্রের সামনে এবং বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন।

বর্তমানে পৃথিবীতে ৭০টি দেশে প্রায় ৪০ কোটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে। আদিবাসীর সংখ্যা সারা পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর প্রায় পাঁচ ভাগ এবং পৃথিবীর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৫ ভাগ। এসব আদিবাসী জনগোষ্ঠী প্রায় ৭ হাজার ভাষায় কথা বলে এবং তাদের রয়েছে প্রায় ৫ হাজার স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈচিত্র।

বিশ্বের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও তাদের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ‘জাতিসংঘ ও আদিবাসী জাতি এক নতুন অংশীদারিত্ব’ শিরোনামে ১৯৯৩ সাল থেকে আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ ঘোষণা করে। আদিবাসীদের অধিকার, মানবধিকার ও স্বাধীনতা সংক্রান্ত বিষয়সমূহ নিয়ে ১৯৮২ সালের ৯ আগস্ট জাতিসংঘের আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপ-এর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনকে স্মরণ করার জন্য জাতিসংঘ ১৯৯৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর ৯ আগস্টকে আন্তর্জতিক আদিবাসী দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

আদিবাসীদের সার্বিক অবস্থার উন্নতির জন্য জাতিসংঘ ১৯৯৩ সালে ১৯৯৫-২০০৪ সময়সীমাকে প্রথম আন্তর্জাতিক আদিবাসী দশক এবং ২০০৪ সালে ২০০৫-২০১৪ সময়সীমাকে দ্বিপক্ষীয় আন্তর্জাতিক দশক হিসেবে ঘোষণা করে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে ১৯৯৪ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে এলেও বাংলাদেশে পালিত হয়ে আসছে ২০০৪ সাল থেকে। মূলত ২০০১ সালে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম গঠিত হবার পর থেকে বেসরকারিভাবে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে।

বাংলাদেশে প্রায় ৫৫টির বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে এবং ৩০ লক্ষাধিক আদিবাসী বাস করে। দেশের সমতলে ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, রংপুর, দিনাজপুরে সাঁওতাল, গারো, শিং, ওরাঁও, মুন্ডারি, মাহাতো, রাজোয়ার, কর্মকার ও মাহালী সম্প্রদায়ের জাতিগোষ্ঠী বসবাস করে। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবন) চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, মুরং বা ম্রো, খিয়াং, লুসাই, পাংখোয়া, বম, খুমী ও চাক জনগোষ্ঠী বসবাস করে।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের দীর্ঘ সশস্ত্র লড়াইয়ের অবসান হয় শান্তি বাহিনীর সাথে বাংলাদেশ সরকারের শান্তি চুক্তির মাধ্যমে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর। এতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং শান্তি বাহিনীর পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা অরফে সন্তু লারমা।

পার্বত্য শান্তি চুক্তির প্রায় ২৩ বছরে অনেক উন্নয়ন সাধিত হলেও পাহাড়ে দূর হয়নি ক্ষোভ। ভূমি বিরোধ নিষ্পতি না হওয়ায় পাহাড়ে এখনো সংঘাত দূর হচ্ছে না।

বাংলাদেশ বসবাসকারী আদিবাসী জনগণ সাংবিধানিকভাবে আদিবাসয় হিসেবে স্বীকৃত নয়। বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে। তবে এই জনগোষ্ঠী উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হিসেবে নয় বরং আদিবাসী হিসেবেই নিজেদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেতে চায়। আদিবাসী জনগনকে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্টী বলা হয়েছে। আর এতে পাহাড়ে বসবাসরত আদিবাসীদের মধ্যে এখনো বিরাজ করছে উদ্বেগ আর আতঙ্ক।

একটি রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে বসবাসকারী একদল জনগোষ্ঠী যারা সাংস্কৃতিকভাবে সংখ্যালঘু, যাদের নিজ একটি সংস্কৃতি আছে এবং যাদের একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার আছে এবং যারা রাষ্ট্রের কাঠামোয় সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রান্তিক, তারাই আদিবাসী হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। বাংলাদেশে বসবাসকারী আদিবাসীরা তাদের সাংবিধানিক এবং আইনি অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছে। বিগত চার দশকেরও বেশি সময়ে বাংলাদেশ অর্থনেতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে সত্য, কিন্তু আদিবাসীদের স্বীকৃতি ও অধিকার বিষয়ে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি। আদিবাসীরা অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।

অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, শিক্ষার অসচ্ছলতা, শিক্ষার অনগ্রসরতা, পেশাগত বৈচিত্রের অভাব, ভূমিহ্রাস, উচ্ছেদ, অসচেতনতা, নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আদিবাসীদের পর্যাপ্ত অংশগ্রহণ না থাকা, আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রের বাস্তবায়ন না করা ইত্যাদি বহুবিধি কারণে আদিবাসীদের উন্নয়ন আশানুরূপ নয়। তাই তাদের উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্র ও সরকারি, বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত আদিবাসীবান্ধব উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন।

উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একথা সত্য যে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলস্রোত ধারার বাইরে রেখে কার্যকর উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই সব আদিবাসীর সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করাই হোক এবারের আদিবাসী দিবসের অঙ্গিকার।

লেখকঃ কাউন্সিলর, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভা্‌ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

(ঢাকাটাইমস/৯আগস্ট/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :