অনন্ত ঘুমে শিল্পপ্রাণ এক

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ২৯ আগস্ট ২০২০, ১৪:০১

০১.

গেল ৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর মাথায় করে গেলাম তাঁর কাছে। ইস্কাটন গার্ডেনের শান্ত পথ ধরে। আলাপের দিনক্ষণ ঠিক ছিল আগেই। ডোরবেলে হাত রাখলাম। দরজটা ওপাশ থেকে খুলে যেতেই চৌকাঠে ঝোলানো উইন্ড চাইমটা টুং টাং করে বেজে উঠলো। সেই মিহি শব্দ মিলিয়ে গেলো উষ্ণ অভ্যর্থনায়। বসার ঘর দেখিয়ে দিয়ে লেখকের তনয় বললেন, ‘আপনি বসুন। বাবা আসছেন।’ ক্ষণিক অপেক্ষার পালা শেষে এলেন সাংবাদিক, কথাশিল্পী রাহাত খান। তারপর দীর্ঘ আলাপ। দেড় ঘণ্টা পার। তবু যেন কথা শেষ হয় না। বললেন, ‘আবার একদিন এসো। কথা তো খুব বলা গেল না। অনেক কথা মনেও থাকে না সব সময়।’

তারপর আর যাওয়া হয়নি। তখন থেকেই যে দিন ঢলে পড়ছিল মহামারির অন্ধকারে। ঘরবন্দি সময়ে কতদিন ভেবেছি ফোন করব। বিশ্রামে আছে কিনা, ভেবে আর সাহস হয়নি। এই তো সেদিন শুনলাম খুব অসুস্থ তিনি। হাসপাতালেও নিতে হয়েছে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রেও (আইসিইউ) ছিলেন।

০২.

গত ৩০ জুলাই কল করলেন কবি সরকার আমিন ভাই। বললেন, ‘রাহাত ভাইয়ের সাক্ষাৎকারটা ‘ধানশালিকের দেশ’-এ ছাপা হয়েছে। তিনি তো অসুস্থ। হাসপাতালে আছেন। তুমি একটা কপি তাকে দিয়ে আসো। খুশি হবেন।’

পত্রিকা নিয়ে ছুটলাম বারডেম হাসপাতালে। অভ্যর্থনাকক্ষে নাম বললাম, কোন বিভাগে বা কেবিনে ভর্তি আছেন জানতে চাইলাম। দায়িত্বরত একজন কর্মী জানালেন, এভাবে কেবল নাম বলে রোগী খুঁজে পাওয়া কঠিন। বললাম, ‘তিনি নামকরা সাংবাদিক। লেখক। ঊর্ধ্বতন কাউকে যদি একটু জিজ্ঞাস করতেন। তারা নিশ্চয়ই বলতে পারতেন।’

অভ্যর্থনাকক্ষের নারী কর্মীটি দু-একজনের সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। কিন্তু কেউ কোনো তথ্য দিতে পারলেন না। শেষে বললেন, ‘আপনি উপরে তৃতীয় তলায় কাউন্টারে চলে যান। রোগী ভর্তির ফি নেওয়া হয়। তাদের কাছে তথ্য থাকতে পারে।’

শহরে করোনা ছায়া ফেলার পর হাসপাতালের চৌহদ্দিতে যেতে বুক কাঁপতো। কার শরীরে করোনার জীবাণু কে জানে। বাতাস নির্গমন পিপিই গায়ে চাপিয়ে, দুটো-তিনটে মাস্কে মুখ ঢেকেও রক্ষা হচ্ছেনা চিকিৎসক, নার্সদের। দেদারে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রাণ হারাচ্ছেন। সেখানে কেবল একটা মাস্ক চেপে দুরুদুরু বুকে তিনতলায় গিয়ে উঠলাম। সব খুলে বলার পর কাউন্টার থেকে বলা হলো, এই নামে একজন রোগী আইসিইউতে ছিলেন। সেখানে গিয়ে খোঁজ নিন।

আইসিইউ রুদ্ধ দুয়ারে দুজন নিরাপত্তা প্রহরী। ভেতরে যাওয়ার সুযোগ নেই। নাম বলে ভেতরে একটু খোঁজ নেওয়া যায় কিনা, জানতে চাইলাম। প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। পরে অনুনয়-বিনয় করে বলার পর একজন উঠে গেলেন। ভেতর থেকে ঘুরে এসে বললেন, এ নামে কোনো রোগী নেই। কেবিন ফ্লোরে গিয়ে খোঁজ নেন। গেলাম সেখানে। নাম বলার পর তারা কোনো তথ্য দিতে পারলেন না। ফের পাঠালেন অভ্যর্থনাকক্ষে। সেখানে গিয়ে বিগত সাতদিনের তথ্য ঘেটে নিশ্চিত হলাম তিনি বাসায় ফিরে গেছেন।

০৩.

ইস্কাটন গার্ডেনের বাসায় গেলাম। করোনার কারণে উপরে ওঠা বারণ। গেটের আনসারকর্মী ইন্টারকমে কল করলেন। রাহাত ভাইয়ের সহধর্মিণীর সঙ্গে কথা বলিয়ে দিলেন। তিনি জানালেন, রাহাত ভাই ঘুমোচ্ছেন। দেখা করা সম্ভব হবে না।তিনি একজন লোক পাঠালেন। তার পত্রিকাটি দিয়ে ফিরে এলাম। সন্ধ্যায় মুঠোফোনে রাহাত ভাইয়ের সহধর্মিণীর সঙ্গে কথা হলো। বললেন, পত্রিকাটি রাহাত ভাইয়ের হাতে দিয়েছেন। তিনি খুশি হয়েছেন। করোনা পরিস্থিতি ঠিক হলে বাসায় যেতে বলেছেন।

০৪.

শুক্রবার রাতে সহকর্মী শেখ সাইফ মেসেঞ্জারে জানালেন, সাংবাদিক রাহাত খান মারা গেছেন। খবরটা শোনার পর থেকে ভেতরটা কেমন আদ্র হয়ে উঠল। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। বারবার কানে বাজছে সেই কথা, ‘তিনি এখন ঘুমিয়ে আছেন। এখন তো কথা বলা যাবে না।’ অনন্তঘুমে ভালো থাকুন। শান্তিতে থাকুন।

লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :