রাজায় রাজায় লড়াই উলুখাগড়ার প্রাণান্ত: নার্গানা কারাবাখ যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে

কথায় আছে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় আর প্রাণ যায় সাধারণ প্রজাদের। পৃথিবীর পরাশক্তিদের মধ্যে রেষারেষি, পরস্পর ক্ষমতার লড়াই ও তাদের অস্ত্র ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে যুদ্ধের দামামায় বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। তারই ধারাবাহিকতায় দুই প্রতিবেশী দেশ আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার বিরোধপূর্ণ নার্গানা কারবাখ অঞ্চল নতুন আর এক সংঘাতের সূচনা করছে।
২৭ সেপ্টেম্বর থেকে সীমান্তে উত্তেজনার রেষ ধরে পাল্টাপাল্টি আক্রমণ শুরু হয়েছে। বুধবার পর্যন্ত আর্মেনিয়ার ৮০ জন সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন এবং ১২০ জনের মতো আহত হয়েছেন। অপরপক্ষে আজারবাইজানের ৪০০ জন সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন এবং ১৪ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে জানা যায়। এছাড়াও আজারবাইজানের একটি এয়ারক্রাফট, চারটি হেলিকপ্টার ও কিছু সংখ্যক ট্যাংক বিধ্বস্ত হয়েছে বলে জানা যায়। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন প্রমুখ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিলেও দুই পক্ষের কেউই আমলে নেয়নি।
নার্গানা কারাবাখ ১৯৮৮ সাল থেকেই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দুই দেশের মধ্যেই বিরোধপূর্ণ অঞ্চল। ১৯২২ সালে আজারবাইজান সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকেই নাগার্না কারাবাখ দেশটির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে পরিচালিত হতো। ১৯৯২ সালের সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আলাদা হওয়ার পর থেকেই উত্তেজনা আরও বাড়তে থাকে। এই অঞ্চলটি ভৌগোলিকভাবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে আজারবাইজানের স্বীকৃত হলেও, আর্মেনিয়ানরা নিয়ন্ত্রণ করে। খ্রিস্টান আর্মেনিয়ান ও তুর্কি মুসলিম জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত ৪,৪০০ বর্গ কিলোমিটার এই অঞ্চলে ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত সংঘটিত যুদ্ধে প্রায় ৩০,০০০ লোকের প্রাণহানি ঘটে এবং প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। নাগার্না কারাবাখ এখন নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, কিন্তু জাতিসংঘ এখনো স্বীকৃতি দেয়নি। কার্যত আর্মেনিয়ার মদদপুষ্ট স্বাধীন দেশ হিসেবে নিজেদের কার্য পরিচালনা করছে। প্রসঙ্গত, গত তিন দশকে আজারবাইজানের প্রায় ২০ শতাংশ মূল ভূখণ্ড দখল করেছে আর্মেনিয়া।
২৯,৭৪৫৩ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের আর্মেনিয়া চারদিক ভূমিবেষ্টিত ককেশীয় অঞ্চলভুক্ত দেশ, যার পশ্চিমে তুরস্ক, উত্তরে জর্জিয়া, পূর্বে আজারবাইজান। ৩১ লক্ষ জনসংখ্যা বিশিষ্ট এই দেশের ৯৩ ভাগ খ্রিস্টান ও ২ ভাগ ইয়াজিদীর বসবাস। গ্লোবাল মিলিটারাইজেশন ইনডেক্সের তথ্যমতে, আর্মেনিয়া পৃথিবীর তৃতীয় সামরিকায়িত দেশ। আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উভয় দেশেরই প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া হলেও আর্মেনিয়ার সাথে কৌশলগত বন্ধুত্ব রয়েছে রাশিয়ার। ১৯৯৭ সালে রাশিয়া এবং আর্মেনিয়া এক চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশের মধ্যে নিরাপত্তা ও অস্ত্র সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। যার ফলে, উত্তর-পশ্চিম আর্মেনিয়ায় একটি ৩০০০ সৈন্যের সামরিক ঘাঁটি গড়েছে রাশিয়া। ২০১৩ সালে রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ মূল্যে সামরিক সরঞ্জাম কেনার ও সামরিক সহযোগিতার একটি চুক্তি করে রাশিয়ার সাথে। ২০১৫ সালে রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ইউরেশিয়ান কাস্টমস ইউনিয়নে যোগ দেয় আর্মেনিয়া। ২০১৮ সালে রাশিয়ার অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কালাসনোকিভ এক চুক্তির মাধ্যমে আর্মেনিয়ার কারখানায় একে-১০৩ মডেলের বন্দুক উৎপাদনের অনুমতি পেয়েছে। এই চুক্তির আওতায় প্রতি বছর ৫০০০০ করে মোট দশ বছরে ৫০০০০০ বন্দুক উৎপাদন করবে। ২০১৩ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত আর্মেনিয়ার দুই-তৃতীয়াংশ অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ রাশিয়া। ২০১৬ সালে রাশিয়ার তৈরি ইস্কান্দার, মোবাইল ব্যালিস্টিক মিসাইল সরবরাহ করে রাশিয়া। শুধু অস্ত্র সরবরাহ নয়, আর্মেনিয়ার ৮০ ভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ করে রাশিয়া। এমনকি আর্মেনিয়ার ব্যাংক খাতেও অনেক বিনিয়োগ করেছে রাশিয়া। ককেশাস রিসার্চ সেন্টারের মতে, ৬৪ ভাগ আর্মেনিয়ান মনে করে রাশিয়া আর্মেনিয়ার ভালো বন্ধু। কিন্তু ২০১৭ সালের পর থেকে এই জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। আর্মেনিয়া এখন রাশিয়া, ফ্রান্স, গ্রিস, ইরান, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশের সাথে ভালো সম্পর্কে তৈরি করছে। আর্মেনিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের পর্যবেক্ষক দেশ। এক জরিপে দেখা যায়, ৬৪ ভাগ আর্মেনিয়ান আর্মেনিয়াকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশ হিসেবে দেখতে চায়।
অপরপক্ষে ৯১.৬০ ভাগ আজারবাইজান জাতিগোষ্ঠীর দেশ আজারবাইজানের ৯৬.৬০ ভাগ মুসলিম। ৮৬,৮০০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দেশটির মোট জনসংখ্যা ১০১২৭৮৭৪ জন। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তেলনির্ভর অর্থনীতির দেশটির মোট জাতীয় আয়ের ৫৬.৫ ভাগ ব্যয় করেছে সামরিক বাজেটে। প্রথম দিকে রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকলেও আর্মেনিয়ার প্রতি পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকা থাকায় রাশিয়ার প্রতি আস্থা হারায়। গত এক দশকে রাশিয়ার সাথে ৫ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বাণিজ্য করেছে দেশটি।
১৯১৪-১৯২৩ সাল পর্যন্ত উসমানীয় সাম্রাজ্য কর্তৃক আর্মেনিয়ায় গণহত্যাকারী তুরস্কের সাথে আর্মেনিয়ার খারাপ সম্পর্ক থাকায় এবং সীমান্তবর্তী দেশ হওয়ার কারণে আজারবাইজানের কৌশলগত বন্ধু রাষ্ট্র তুরস্ক। তুরস্ককে আজারবাইজানের রাষ্ট্রপতি হায়দার এলিয়েভ একই জাতির দুটি রাষ্ট্র বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এই দুটি দেশের সরকার ১৯৯২ সালে সামরিক শিক্ষার জন্য চুক্তি করে। ২০১০ সালে আজারবাইজানে তুরস্কের ২০০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য পৌঁছায় । ২০১০ সালে দেশ দুটির মধ্যে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পরস্পর সহযোগিতা করার চুক্তি হয়। যার ফলে আজারবাইজানে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলে তুরস্ক। এমনকি গ্রিসের সাথে সংঘর্ষ বাড়লে তুরস্ক সমর্থন দেয় দেশটিকে। ২০১৯ সালে ৪.৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয় এই দুটি দেশের মধ্যে, ২০২০ সালের মধ্যে ১৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। তুরস্ক ছাড়াও ইসরায়েল, বেলারুস, পাকিস্তানের সাথেও অস্ত্র বাণিজ্য করে দেশটি। ২০১৭ সালের পর থেকে ইসরাইলের সাথে ৫ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বাণিজ্য করে দেশটি। ২০২০ সালে নতুন করে আর্মেনিয়ার সাথে সংঘর্ষ বাড়লে তুরস্ক সরকার আজারবাইজানকে সরাসরি সমর্থন দিচ্ছে।
বিশ্ব পরাশক্তিরা ও সাম্রাজ্যবাদীরা নিজেদের অস্ত্র ব্যবসার প্রসার ঘটাতে ও নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতেই পৃথিবীতে যুদ্ধ বাধায়। পরাশক্তিদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ না বাধালেও প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করে। যার বলি হতে হয় সাধারণ মানুষের। হয়তো নিজেদের জীবনের বিনিময়ে, নয়তো দখলদারিত্বের মুখে নিজেদের আবাসভূমি ছেড়ে দেশান্তর হয়ে। ২০১৭ সালে বিশ্বের দেশগুলোর সামরিক বাজেট ছিল প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ডলারের। অথচ পৃথিবীতে প্রতিদিন প্রায় ৮০ কোটি লোক অভুক্ত থাকেন। ক্ষুধায়, রোগ শোক, দারিদ্র্যের বলি হতে হয় কত মানুষকে তার ইয়ত্তা নেই। যুদ্ধের কারণে মানুষের আহাজারি, অভিবাসন সমস্যা, ক্ষুধায় দারিদ্র্য-রাহাজানিতে পৃথিবী আজ ক্লান্ত। আর যুদ্ধ নয়, পৃথিবীতে ফুটুক শান্তির ফুল।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকাটাইমস/৩অক্টোবর/এসকেএস

মন্তব্য করুন