একজন যোগ্য কাণ্ডারি ও পরিবর্তনের গল্প

বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন ও উচ্চশিক্ষার জন্য প্রায় শতাব্দিকালব্যাপী এ দেশের আলিম-ওলামাহ, পীর মাশায়েখ আপমর তৌহিদীজনতা একটি ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য মিছিল -মিটিং, সভা-সেমিনার থেকে শুরু করে লংমার্চ পর্যন্ত করেছেন। স্বাধীনতার পর অনেক সরকার আসলে-গেলেও দেশের সিংহভাগ আলিম ওলামার এই দাবিকে কেউই গুরুত্বসহকারে দেখেননি। ছারছিনার পীর মরহুম আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ রহ. সিলেটের সাহেব কিবলা ফুলতলী রহ. এবং দেশের মাদরাসা শিক্ষকদের প্রাচীনতম সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মুদাররেসীনের নেতৃত্বে কঠোর আন্দোলন, মিছিল-মিটিং চলতে থাকে যুগের পর যুগ।
অবশেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপলব্ধি করেন আলিম ওলামদের এই দাবিটি যৌক্তিক। তিনি শত বছর ধরে কোটি মানুষের প্রাণের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ২০১৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর "ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় আইন" সংসদে পাস করেন। হাজার হাজার মাদরাসা শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার পথে যুক্ত হয় নতুন মহাসড়ক। ছারছিনা ও ফুলতলীর মরহুম পীর কিবলাদ্বয়ের আমৃত্যু লালিত স্বপ্ন, হাজারো আলিম-ওলামা ও তৌহিদী জনতার মনের চাওয়া পায় পূর্ণতা। প্রতিষ্ঠিত হয় এ্যাফিলিয়েটেড ক্ষমতা সম্পন্ন ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ পান দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. আ ন ম রইস উদ্দিন রহ.। দিন-রাত এক করে তাঁর মেধা শ্রম ব্যয় করে তার যোগ্যতম ছাত্র এবং সহকর্মী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদসহ বেশ কিছু সহযোগী নিয়ে প্রণয়ন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও নীতিমালা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম শুরু করার আগেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য প্রফেসর ড. আ ন ম রইস উদ্দিন রহ.। তারপর মাদরাসা শিক্ষার অভিভাবকত্ব নিয়ে সদ্য জন্ম নেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আহসান সাইদ। তিনি তার যথাসাধ্য শ্রম ও মেধা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিছুটা সফল হয়েছেন হয়তো। তবে অদৃশ্য কারণে বিশ্ববিদ্যালয় তার কাঙ্ক্ষিত সফলতার পথে খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। যে স্বপ্ন নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম,সেই স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়।
কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মুক্ত হয়ে ফাজিল কামিল যখন ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের যুক্ত হলো তখন যেন জটিলতা আরো গভীর হলো। চরম সেশনজটে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জীবন বিষিয়ে উঠলো। ৩ বছরের ফাজিল ডিগ্রি ৬ বছরেও শেষ হয় না। ২ বছরের কামিল ৪ বছরেও সমাপ্তির কোনো খবর নেই। অনার্স কোর্সগুলোর অবস্থা আরোও শোচনীয়। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় মাদরাসা সমূহের কাছে হয়ে উঠে আতংকের নাম। অধিভূক্তি নবায়ন থেকে নিয়োগ সর্বত্র ঘুষের ছড়াছড়ি। শত বছরের স্বপ্ন যেন ধূসর হতে থাকে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে।
এমন করেই কেটে যায় আট আটটি বছর। কামিলের ৩টি পরীক্ষার ফল আটকে যায়। হাজার হাজার ছাত্র তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হয়ে পরে শংকিত। এমনি সংকটকালে যখন সারাদেশের ১৫ শ'র বেশি ফাজিল কামিল মাদরাসা খুঁজে ফিরছে উত্তরণের পথ। হাজার হাজার ছাত্র সেশনজটের কবল থেকে মুক্তির প্রহর গুণছে। ঠিক সেই সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আলিম ওলামাদের স্বপ্নের এই বিশ্ববিদ্যালয়র দায়িত্ব তুলে দেন দেশের প্রথিতযশা আলিম শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. আব্দুর রশীদ স্যারের হাতে।
দেশের অধিকাংশ ইসলামপ্রিয় মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ভাবতে শুরু করে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এইবার একজন যোগ্য কান্ডারি খুঁজে পেল। অনেকেই আবার হেসে উড়িয়ে দিল এই বলে যে, আট বছরে যার কোনো উন্নতি হয়নি এক আব্দুর রশিদ কিইবা করবেন??? "কথায় নয় কাজে পরিচয়" সেই প্রবাদ বাক্যই যেন প্রমাণ করা শুরু করলেন প্রচণ্ড ভিশনারী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশীদ।
দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে একদা এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী কাধে তুলে নিলেন দেশের মাদরাসা শিক্ষার অভিভাবকত্ব। নানা প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতাসহ একটি বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের পবিত্র দায়িত্বে নিয়ে কাজ শুরু করেন।
প্রথম দিনই তিনি ঘোষণা দিলেন, “আজ থেকে কোনো মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্র, কর্মচারী, কর্মকর্তা কেউ যেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে মনোকষ্ট নিয়ে ফিরে না যায়। তারা যেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে মনে মনে ভাবে একটা ভালো জায়গায় একটু ভালো সময় কাটিয়েছি।” তিনি তার সহকর্মীদের কাছে এই আবেদন রাখেন। দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন “যেই স্বপ্ন ও আশা নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন সেই স্বপ্নকে সামনে নিয়ে ইসলামি উচ্চশিক্ষার এই বিশ্ববিদ্যালয় কে আল আযহারের মতো করে গড়ে তোলাই হবে আমার কাজ।”
তারপরের গল্প শুধু পরিবর্তনের। দীর্ঘ ৮ বছরের জঞ্জাল যেন এক মাসে পরিষ্কার করার লক্ষ্যে কাজ শুরু করলেন। শুরু হলো নোংরামি। রেজাল্ট প্রত্যাশী এবং পরীক্ষার জন্য অপেক্ষমান ছাত্রদের ভুল বুঝিয়ে নামিয়ে দেওয়া হলো আন্দোলনে। এ যেন ডুবতে বসা তরীতে কালবৈশাখী ঝড়। তবে কান্ডারি যখন নির্ভিক, সৎসাহসী, কর্মবীর ষড়যন্ত্র আর নোংরামি সেখানে কিছুই না। ভিসি মহোদয় চ্যালেঞ্জ নিলেন। পরিকল্পনা ছাড়া ঘোষণা করা পরীক্ষার রুটিন চেঞ্জ করে নতুন রুটিন ঘোষণা করলেন এবং সঠিক সময়ে পরীক্ষা গ্রহণের প্রত্যয় ব্যক্ত করেলন। এক মাসের মধ্যে জট লেগে থাকা ৩ বছরের কামিলের রেজাল্ট প্রকাশ করে তার কাজের গতি জানান দিলেন। তারপর শুধু চলতে থাকেন দুরন্ত গতিতে। পরিবর্তন এর ছোঁয়া লাগতে থাকে সর্বত্র। দিনরাত এক করে সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করেন উপাচার্য মহোদয়।
এতো বছর ধরে যেন এমন কান্ডারির অপেক্ষায় ছিল দেশের মাদরাসা শিক্ষা। মাদরসা অধিভভক্তি নবায়ন ও নিয়োগের সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিয়ে তিনি ঘুষহীন কাজের সূচনা করেন। তিনিই আমাদের মনে নতুন আশা ও স্বপ্নের নবদিগন্ত খুলে দেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে একটি অচলপ্রায় বিশ্ববিদ্যালয় ফিরে পায় প্রাণ। খুলতে শুরু করলো নব নব দিগন্ত। পরিবর্তিত বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠতে শুরু করলো মাদরাসা শিক্ষার প্রকৃত অভিভাবক।
৪ এপ্রিল ২০২৪ দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্তি। মাত্র এক বছরে একটি প্রায় ডুবতে বসা বিশ্ববিদ্যালয়কে টেনে তুলতে সক্ষম হয়েছেন প্রফেসর আব্দুর রশীদ। তিনি প্রমাণ দিতে সক্ষম হয়েছেন যে সহীহ নিয়ত এবং সৎ সাহস থাকলে যে কোন কাজই আল্লাহ সহজ করে দেন। কমর্বীর ভিসি মহোদয় মাত্র এক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র পালটে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১০ বছরে যা কাজ হয়েছে নিঃসন্দেহে এই এক বছরে তিনি তারচেয়েও অনেক বেশি কাজ করেছেন। অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে যেসকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তার মধ্যে অন্যতম হলো-
* বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী নিয়োগ প্রবিধান প্রণয়ন ও অনুমোদন।
* দীর্ঘদিন শূন্য থাকা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং রেজিস্ট্রারসহ অতি প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পদে যোগ্য ও দক্ষ লোকবল নিয়োগের মাধ্যমে অচলাবস্থার পরিবর্তন।
* ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের এম ফিল পিএইচডি আইনের খসড়া প্রণয়ন ও অনুমোদন।
* ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজেস্ব গবেষণা জার্নাল প্রকাশের উদ্যোগ।
* বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজেস্ব ক্যাম্পাসের সীমানা প্রাচীর নির্মাণের মাধ্যমে স্থায়ী ক্যাম্পাসের স্বপ্নের শুভ সূচনা।
* ধার করা সিলেবাস বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি আধুনিক ও যোগপোযোগী সিলেবাস প্রণয়নের উদ্যোগ।
* বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাসূ করা শিক্ষার্থীদের মূল সার্টিফিকেট প্রদানের সূচনা।
* কোন ফাইল কারোও টেবিলে ৩ দিনের বেশি থাকলেই শোকোজ দেওয়ার আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কাজে গতি আনয়ন।
* আরবি বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘুষমুক্ত করার ঘোষণা।
* মসজিদে নিজের ইমামতিতে জামাতের সূচণা করা এবং ইমাম নিয়োগ।
* বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে শিক্ষার্থী ও শিক্ষা বিনিময় চুক্তির সূচনা।
* বিশ্ববিদ্যালয়ের আগত মানুষের জন্য একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুসজ্জিত কক্ষ প্রস্তুত করেছেন, যেখানে সারাদেশ থেকে আসা শিক্ষক শিক্ষার্থীরা রেস্ট নিতে পারেন।
* দায়িত্ব গ্রহণের এক মাসের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা ৩ টি কামিল পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করে সেশনজট মুক্ত করার প্রয়াস শুরু করেন।
*সৌদি আরবের সাথে যৌথ উদ্যোগে আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট নির্মাণ
* সারাদেশের ফাজিল কামিল মাদরাসার শিক্ষার মানোন্নয়োণে অধ্যক্ষদের সাথে দফায় দফায় সভা।
* ফাজিল কামিল স্তরে শিক্ষার্থী বৃদ্ধির জন্য নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ।
* ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের আরবি প্রভাষক হওয়ার পথে বিদ্যমান জটিলতা নিরসনের উদ্যোগ।
* সারাদেশে একসাথে জুম মিটিং এ বুখারীর সবক প্রদানের সূচনা।
* নিয়মিত সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সভার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আইন কানুন অনুমোদন।
* ফিকহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ নামে নতুন বিভাগ চালু করণ।
* বিভাগীয় মাদরাসা শিক্ষকদের সমাবেশের আয়োজন।
* মাদরাসাগুলোতে আরবি ও ইংরেজি ল্যাগুয়েজ ক্লাব খোলার উদ্যোগ
* আলিয়া মাদরাসার হারিয়ে যাওয়া বুখারীর সবক ও খতম পূণরায় চালুর উদ্যোগ।
* সবশেষ বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার ৫০ বছরের ইতিহাস ভেঙে দিয়ে পরীক্ষা গ্রহণের দেড় মাসের মধ্যে ফাজিল পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করার মাধ্যমে এই মহান কান্ডারি প্রমাণ করেছেন তিনি পারবেন। হ্যাঁ তিনিই পারবেন শত বছরের কোটি মুমিনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে।
বিগত একটি বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল পেতে শুরু করেছে দেশের ১৫ শ ফাজিল কামিল মাদরসার লাখো শিক্ষার্থী। নিয়মিত পরীক্ষা গ্রহণ এবং সময়মতো ফলাফল প্রকাশ করার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাওয়ার আভাস দিচ্ছে। আশা করি এই যোগ্য কান্ডারীর হাত ধরেই ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠবে দেশের কোটি মুমিনের আস্থা ও ভালোবাসার বিশ্ববিদ্যালয়।
লেখক: কবি ও ইসলামী বক্তা; প্রভাষক, ফজলুল হক মহিলা কলেজ, ঢাকা।

মন্তব্য করুন