সেই তরুণটিকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে
১৯৮১ সাল। আমাদের বাসার গেটের ঠিক উল্টোদিকে থাকতেন একজন ডাক্তার। আমাদের একটু কিছু হলেই বাবা তার কাছে নিয়ে যেতেন, অথবা ওনাকে কল করতেন। পারিবারিক সুসম্পর্ক ছিল তার সাথে। ওনার ছিল দুই মেয়ে; শিউলি দি আর মিলি দি। দুজনাই আমার স্কুলে পড়ত। বাবা আমাকে স্কুলে দিয়ে আসতেন। আর মাঝে মাঝে শিউলি দি মিলি দি'র সাথে ওদের গাড়িতে চড়ে স্কুলে যেতাম।
বেশির ভাগ সময় ওদের সাথেই আসতাম। রিকশায় যাওয়ার সময় অথবা গাড়ির কাচের মধ্য দিয়ে দেখতাম, কতজন হেঁটে হেঁটে হেলতে দুলতে যায়। আমার খুব ইচ্ছে হতো, ওদের মতো হেঁটে হেঁটে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে।
দিদিদের ছুটি আমার ছুটির পরে হতো। ততক্ষণ আমি স্কুলের মাদারের কাছে বসে থাকতাম। একদিন আমি ছুটির সাথে সাথেই বের হয়ে গেলাম। হাঁটতে লাগলাম মহানন্দে৷ এদিক-ওদিকে কত কি দেখার মতো আছে! গাড়ি বা রিকশায় চড়লে তো চোখের নিমিষে পথ শেষ হয়। আমি হাঁটছি তো হাঁটছি। সব রাস্তাই আমার কাছে একই রকম। ছোট্ট আমি জানি না, পথেরও বাঁক আছে, জায়গারও দূরত্ব আছে।
হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হলাম। ভীষণ তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত; কিন্তু ভয় হচ্ছিল না একটুকুও। একসময় পা দুটি অবসন্ন হলে আমি একটি কালভার্টে আমার স্কুলের ব্যাগের ওপর বসে থাকি।
একদম নির্জন জায়গাটি। এখন আমার মনে হয় তখন জোহরের নামাজের সময় ছিল, তাই রাস্তায় মানুষের আনাগোনা কম ছিল। বেশ খানিক্ষণ পরে একজন পাঞ্জবি, টুপি পরা তরুণ আমার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কি হারিয়ে গেছো?’ আমি কিছু বুঝলাম না। উনি আমাকে কোলে চাপিয়ে নিয়ে গেলেন একটা টিনশেডের বাড়িতে। একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা (তরুণটির মা) আমাকে দেখেই বুঝলেন কাহিনি।
আমাকে কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন ও খেতে সাধলেন। ততক্ষণে আমি বুঝে গেছি পথ হারিয়েছি। মায়ের জন্য ভীষণ খারাপ লাগছিল। কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম। তরুণটি ওর মাকে বলল, ‘কীভাবে পৌঁছাবো ওর বাসায়, ঠিকানা তো জানি না’। আমি ব্যাগ থেকে স্কুল ডায়েরি বের করে দিলাম, যেখানে আমার ঠিকানা ছিল।
তরুণটি দুপুরে কিছু না খেয়েই আমাকে নিয়ে বের হয় এবং আমার বাসায় পৌঁছে দেয়। বাসায় গিয়ে দেখি মা নেই। উদ্ভ্রান্তের মতো খুঁজছে আমায়। ‘ছুটির ঘণ্টা’ সিনেমার অভিজ্ঞতা থেকে স্কুলের টয়লেটও চেক করেছিল নাকি সেদিন। ছোট চাচি বেড়াতে এসেছিলেন আমাদের বাসায় কয়েকদিন আগে। উনিই পরম যত্নে তরুণটিকে খাওয়ালেন। কিছু টাকা দিতে চাইলেন, কিন্তু উনি তা নিলেন না।
যাওয়ার সময় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আর এভাবে স্কুল থেকে আসবে না, রাস্তায় ছেলেধরা থাকে। মা-বাবার কথা শুনবে’।
ইদানীং টাইম ট্রাভেল করে সে সময়টিতে গিয়ে আবার সেই তরুণটিকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছা করে সেই সত্যযুগে গিয়ে তার প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসার কথা জানাতে, আর জানাতে আমাদের সন্তানেরা কতটা অনিরাপদ এখন!
লেখক: চিকিৎসক
ঢাকাটাইমস/১৭জানুয়ারি/এসকেএস