নীরব ঘাতক শব্দদূষণ হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০২ মে ২০২৪, ১১:০৫ | প্রকাশিত : ০২ মে ২০২৪, ১১:০০

বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত গ্রিনহাউস গ্যাস পৃথিবীর জলবায়ুকে করে তুলেছে উষ্ণ। ফলে চারিদিকে গরম দূষণ বেড়েই চলেছে। গরম দূষণসহ বিভিন্ন দূষণের থাবায় দিন দিন বাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে মানুষের একমাত্র আবাসস্থল এই পৃথিবী। পৃথিবীতে দূষণের শেষ নেই। পরিবেশ, বায়ু, পানি, নদী সবকিছুই দূষিত হচ্ছে। দূষণে দূষণে নগরজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। শব্দদূষণ এখন মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। শহরের মানুষ শব্দদূষণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। শব্দদূষণের শিকার সর্বশ্রেণি ও পেশার মানুষ। বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায়, শব্দদূষণের কারণে বাংলাদেশে ২৩টি রোগ সৃষ্টি হচ্ছে। শুধু নগর নয়, প্রতিনিয়ত গ্রামও শব্দদূষণে দূষিত হচ্ছে। কারণ গ্রামগুলো দ্রুত নগরে পরিণত হচ্ছে। শহরের ভালো-মন্দ সবকিছু গ্রামেও ছড়িয়ে পড়ছে। সতর্কতার অভাবে দিন দিন এই দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে।

সম্প্রতি গবেষকরা জানান, যানবাহনের শব্দের সঙ্গে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাকের সম্পর্ক রয়েছে। পাশাপাশি গবেষকেরা জানিয়েছেন, এই শব্দদূষণের মাত্রা প্রতি ১০ ডেসিবেল বাড়লে হার্টের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও ৩.২ শতাংশ করে বাড়তে থাকে। শুধু কি তা-ই! ভয়ঙ্কর এই আওয়াজ অনিদ্রাজনিত সমস্যাও বাড়িয়ে তুলতে পারে। এ ছাড়া স্ট্রেস হরমোন, অর্থাৎ কর্টিজলের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যেতে পারে। যা পরবর্তী কালে প্রদাহজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়া আশঙ্কা বাড়িয়ে তোলে। শুধু হার্ট অ্যাটাক নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শরীরে নানা কার্যকলাপ। অনিদ্রা থেকে ডায়াবেটিসের উপরেও প্রভাব পড়তে পারে।

জাতিসংঘের মতে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রচুর পরিমাণে শব্দ দূষণ হয়। আবাসিক এলাকার জন্য অনুমতিযোগ্য শব্দ সীমার মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। এছাড়া বাণিজ্যিক এলাকা ও যেখানে যানজট আছে সেখানে ৭০ ডেসিবেল। ঘনবসতিপূর্ণ ও ব্যাপক যানজটের শহর ঢাকায় শব্দের মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল এবং রাজশাহীতে ১০৩ ডেসিবেল পাওয়া গেছে যা মানুষের জন্য বিপজ্জনক।

জ্যামে আটকে থাকা গাড়িঘোড়ার আওয়াজে অনেকেরই বুক ধড়ফড় করতে শুরু করে। সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, তীব্র যানজট এবং সেই কারণে সৃষ্ট শব্দদূষণের সঙ্গে হার্ট অ্যাটাক এবং হার্ট সংক্রান্ত অন্যান্য রোগের যোগ রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, রাস্তার সিগন্যাল কিংবা যানজটে আটকে থাকা গাড়ির আওয়াজে উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যাও বেড়ে যেতে পারে।

অতিরিক্ত শব্দের কারণে উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের অসুখ, বুক ধড়ফড় করা, ঘুমের সমস্যা, মাথা ব্যথা ও মানসিক চাপ, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা ইত্যাদি হয়ে থাকে। এর ফলে কথা বলার সময় ভুল-বোঝাবুঝি হতে পারে। এটি সাধারণত সব বয়সের মানুষ, বিশেষ করে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে বেশি প্রভাব ফেলতে দেখা যায়। একটি গবেষণায় দেখা যায়, ব্যস্ত রাস্তা বা এয়ারপোর্টের আশপাশে থাকে এমন বাচ্চাদের মধ্যে অস্থিরতা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, মনোযোগের অভাব, পড়াশোনার দক্ষতা কমে যাওয়া বেশি পরিলক্ষিত হয়।

শব্দের মাত্রা ডেসিবেলকে শব্দ পরিমাপের একক হিসেবে ধরা হয়। পরিবেশে বিভিন্ন মাত্রার শব্দ পাওয়া যায়। ২০-৩০ ডেসিবেল থেকে শুরু করে হেডফোনে সর্বোচ্চ মাত্রা (৯৪-১১০ ডেসিবেল), রক গানের কনসার্ট (১১০-১২০ ডেসিবেল), প্রকট বজ্রপাত (১২০ ডেসিবেল) ও সাইরেন (১২০-১৪০ ডেসিবেল) পর্যন্ত। ৮৫ ডেসিবেলের বেশি শব্দ কানের ক্ষতি সাধন করে থাকে।

শব্দদূষণ প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। গাড়ির হর্ন, নির্মাণকাজ, মাইকের ব্যবহার, শিল্প-কারখানা—কোনো ক্ষেত্রেই শব্দদূষণ বিষয়ে কোনো নিয়মই মানা হচ্ছে না।

শব্দদূষণ দেশ, কাল, স্থান ভেদে অন্য সমস্যার পাশাপাশি স্বাস্থ্য সমস্যাটিও বড় করে তুলছে৷ যেমন একটানা গাড়ির শব্দ কিংবা উচ্চ শব্দের গান হৃদরোগের ঝুঁকি, শ্রবণশক্তি হ্রাস, মানসিক চাপ বাড়ানো ছাড়াও নানা রোগের ঝুঁকি বাড়ায়৷ জেনে নিন নীরব ঘাতক শব্দদূষণ শরীরে যেসব ক্ষতি করে-

শব্দদূষণে শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া

উচ্চ মাত্রার শব্দ আমাদের অন্তঃকর্ণের শব্দ সংবেদনশীল হেয়ার সেল ও স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা এক পর্যায় পার হলে কোনো প্রকার মেডিক্যাল বা সার্জিক্যাল চিকিৎসার মাধ্যমে ফেরানো যায় না। এটি যেকোনো বয়সের মানুষের মধ্যে দেখা যেতে পারে। এক কানে বা উভয় কানে এটি হতে পারে।

উচ্চ শব্দ হয় এমন পরিবেশে দীর্ঘ সময় অবস্থান করলে বা দীর্ঘদিন কাজ করলে কানের শুনানি আস্তে আস্তে কমতে থাকে, যা এক পর্যায়ে স্থায়ী বধিরতায় রূপ নিতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে শব্দদূষণের পাশাপাশি বার্ধক্যজনিত কারণে কানের শুনানি কমে যায়, যা সমস্যাটিকে আরো জটিল এবং তীব্র করে তোলে। এ অবস্থায় কানের শোনার যন্ত্র হিয়ারিং এইড ছাড়া কোনো বিকল্প থাকে না, যেটি একটি মাত্রা পর্যন্ত সাহায্য করে থাকে।

রাস্তায় গাড়ি চলাচল ও অনিয়ন্ত্রিত হর্নের ব্যবহার, রেলের ইঞ্জিন, হেলিকপ্টার গান ফায়ার বা বন্দুক থেকে বুলেট নির্গত হওয়ার শব্দ, জেনারেট ও কলকারখানার ভারী যন্ত্রাংশের শব্দ, সেচ ও কৃষিকাজে ব্যবহৃত ট্রাক্টর, কাঠ কাটার সমিল, রক কনসার্ট, নাইট ক্লাব বা উচ্চ শব্দে ইয়ারফোনে গান শোনা, মাইকের অসতর্ক উচ্চ মাত্রার ব্যবহার, নির্মাণকাজ থেকে দূষণ সৃষ্টিকারী শব্দের উৎপত্তি হয়। পরিবেশের কোলাহল থেকেও মারাত্মক শব্দদূষণের সৃষ্টি হতে পারে, যা আমাদের কানে শুনানি মারাত্মক ব্যাহত করে।

হঠাৎ প্রকট শব্দ; যেমন—বোমা বিস্ফোরণ, গাড়ির টায়ার বিস্ফোরণ বা যেকোনো তীব্র মাত্রার স্বল্পকালীন শব্দ একবার কানে লাগলেও তৎক্ষণাৎ কান চিরস্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এতে অন্তঃকর্ণের সংবেদনশীল অংশের ক্ষতির পাশাপাশি কানের পর্দা ও কানের অস্থিসন্ধিগুলো ছিঁড়ে যেতে পারে।

হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়

তীব্র শব্দ শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে দূর্বল করে দেয়৷ আর সেকারণেই হৃদরোগ, মাথা ঘোরার মতো অসুখের ঝুঁকিও বাড়ে৷ এবং রাতে যদি শব্দ ৫৫ ডেসিবেলের বেশি হয়, তাহলে ঘুমের সমস্যা হয়৷ আর নিয়মিত এমনটা হলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও বেড়ে যায়৷

টিনিটাস

কোনো বাহ্যিক শব্দ ছাড়া কানের ভেতর বেজে যাওয়াকে টিনিটাস বলে। লাতিন শব্দ ‘টিনিয়ার’ থেকে এটির উৎপত্তি, যার অর্থ ‘ঘণ্টার শব্দ’। শব্দদূষণের কারণে এটি হতে পারে। এই রোগে রোগী কানের ভেতর শোঁ শোঁ, ভোঁ ভোঁ, শিস দেওয়ার শব্দ, কেটলিতে পানি বাষ্প হওয়ার শব্দ, হিসহিস শব্দ, রেলগাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ, টিভির ঝিরিঝিরি শব্দ ইত্যাদি অনুভূত হতে পারে। প্রায় ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ১-২ শতাংশ মানুষ এটির কারণে দুর্বিষহ জীবন যাপন করে।

কানে ব্যথা

এটি সাধারণত নিউরোপ্যাথিক অথবা স্নায়ুর প্রদাহের কারণে হয়ে থাকে। অতিরিক্ত শব্দের কারণে আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের কিছু পরিবর্তন দেখা যায়, যার কারণে কানে ব্যথা অনুভব হতে পারে।

হাইপারাকিউসিস বা শব্দের প্রতি অতিসংবেদনশীলতা

এতে আক্রান্ত রোগীদের একটি বিড়ালের মিউ শব্দকে মনে হয় সিংহের গর্জন, কাগজের পৃষ্ঠা ওল্টানোর শব্দকে মনে হয় বজ্রপাত, কমোডের ফ্লাশের শব্দ মনে হয় নাইজেরিয়া জলপ্রপাত। এতে আক্রান্ত রোগীরা কত কষ্টে জীবন যাপন করছেন বুঝতেই পারছেন।

মাথা ঘোরানো

অন্তঃকর্ণের সঙ্গে যুক্ত ভেস্টিবুলার নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হলে এ রকম হতে পারে।

স্বরযন্ত্রের অসুখ

শব্দ বেশি হয় এমন শিল্প-কারখানায় যাঁরা দীর্ঘ সময় কাজ বা অবস্থান করেন, তাঁদের সাধারণত উচ্চ শব্দে কথা বলতে হয়। এর কারণে তাঁদের মধ্যে স্বরযন্ত্রের বিভিন্ন রোগ; যেমন—স্বরভঙ্গ, ভোকাল কর্ড নডিউল, ল্যারিনজাইটিস ইত্যাদি হয়ে থাকে।

শব্দদূষণ প্রতিরোধে করণীয়

শব্দদূষণ প্রতিরোধে শব্দ হয় এমন যন্ত্রপাতি; যেমন—জেনারেটর, ডিশ ওয়াশার, ওয়াশিং মেশিন ব্যবহারের সময় রুমের দরজা বন্ধ রাখব, যাতে শব্দ বাইরে আসতে না পারে।

গাড়ির হাইড্রোলিক হর্ন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। হেডফোন বা স্পিকারে গান শোনার সময় ভলিউম কম রাখা ভালো। আবাসিক এলাকাগুলো বিমানবন্দর, হাইওয়ে, শিল্প-কারখানা থেকে দূরে করা উচিত।

হযত্রতত্র গান-বাজনা, পার্টি, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক সভা-সমাবেশ ও ঘোষণায় অনিয়ন্ত্রিত মাইক ও স্পিকারের ব্যবহার সীমাবদ্ধ এবং নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

ভারী যন্ত্রাংশ, জেনারেটর, গাড়ি ও কলকারখানার ইঞ্জিন ও যন্ত্রপাতিতে নির্দিষ্ট সময়ে লুব্রিকেন্ট বা তেল ব্যবহার এবং নষ্ট যন্ত্রাংশ দ্রুত পরিবর্তন করতে হবে। এতে শব্দ উৎপাদন কম হবে।

প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগাতে হবে। গাছকে শব্দ শোষণকারী হিসেবে ধরা হয়। এতে কানের ক্ষতি কম হয়। এসব জায়গায় শব্দ শোষণকারী ব্যবস্থা স্থাপন করা যায়।

কিছু সংবেদনশীল জায়গা; যেমন—স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, হাসপাতাল, বৃদ্ধাশ্রম, আদালত ইত্যাদির আশপাশে সম্পূর্ণভাবে গাড়ির হর্ন, গান-বাজনা, মাইক বাজানো নিষিদ্ধ করতে হবে।

(ঢাকাটাইমস/২ মে/আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :