সেই মেহমানখানায় যোগ হলো পড়াশোনা

পুলক রাজ, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ১৮ মে ২০২২, ১৭:৫২

মেহমানখানা। শুক্র-শনিবার যে কেউ এখানে খেতে পারেন। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত। টাকা-পয়সা লাগে না। কোনো বিলাসবহুল বাড়ি কিংবা বহুতল ভবন নয়। রাস্তার পাশে ফুটপাতে এই আয়োজন হয়।

করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে অন্নহীন ও অসহায় মানুষের ঠিকানা হয়ে উঠেছিল রাজধানীর লালমাটিয়ায় ডি-ব্লক এলাকা। এখানে রাস্তার পাশে ফুটপাতে কয়েকজনের উদ্যোগে চালু হয় এই ‘মেহমানখানা’। এ পর্যন্ত পথশিশুসহ বহু মানুষ খাবারের সন্ধানে হাজির হয়ে এখানকার অতিথি হয়েছেন। তবে নতুন খবর হলো সেই পথশিশুরা এখন পড়তে আসে এখানে।

ক্ষুধার্থ অসহায় মানুষের এই মেহমানখানার বয়স দুই বছরের বেশি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ফুটপাতে থাকা অসংখ্য দুস্থ নারী-পুরুষ ও শিশুসহ বিভিন্ন নিম্নআয়ের মানুষ এখানকার অতিথি। সবাইকে মেহমানখানার স্বেচ্ছাসেবকরা ডেকে নিয়ে এসে মেহমানদারী করছেন। করোনাকালে প্রতিদিন এই আয়োজন হলেও এখন চলে প্রতি শুক্রবার ও শনিবার। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত চলে এ কার্যক্রম।

গত শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কেউ রিকশায় বসে খাচ্ছেন। কেউবা প্যাকেটে করে খাবার নিয়ে যাচ্ছেন। শহরে হাজারো মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার এমন চিত্র বিরল।

এই আয়োজনের উদ্যোক্তা নাট্যজন আসমা আক্তার লিজা। তিনি মেহমানখানার চেয়ারপারসন। ঢাকাটাইমসের সঙ্গে আলাপকালে এই কার্যক্রমের বিস্তারিত জানিয়েছেন তিনি।

লিজা বলেন, আমাদের মেহমানখানাটা মূলত শুরু হয়েছিল করোনার প্রথম লকডাউন থেকে, ২০২০ সালে। ওই সময় পুরো রাজধানীর চিরচেনা চিত্র পাল্টে যায়। এ সময় আমি কাক, কুকুর এদের জন্য খাবার নিয়ে যেতাম রাজধানীর আনাচে-কানাচে। ঢাকা শহর যেহেতু স্তব্ধ, মানুষের চলাচল নেই। ডাস্টবিনগুলোতেও খাবার নেই, কুকুরগুলো কী খাবে? কাক কী খাবে? চড়ুই পাখি, কবুতর এরা কী খাবে? তো পশুপাখিদের জন্য প্রতিদিন খাবার নিয়ে বের হতাম। একপর্যায়ে পথে-ঘাটে মানুষের দুর্ভোগ দেখে নিজের মনে ভাবনা শুরু হলো মেহমানখানা নিয়ে।

মেহমানখানার এই উদ্যোক্তা বলেন, করোনার মহামারির সময় পশুপাখিদের খাওয়াতে গিয়ে একদিন নিউমার্কেট এলাকায় পথশিশুদেরকে দেখলাম, তারা খাবারের জন্য একটি দোকানের শাটার ভাঙার চেষ্টা করছিল। আমার তখনও পর্যন্ত মাথায় আসেনি যে মানুষ কী খাবে। আমার কাছে মনে হয়েছে যে সরকার থেকে বলা হয়েছে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিস্থিতিতে ঘরে থাকো। তার মানে সবাইতো ঘরেই থাকছে।

পথের মানুষগুলোর যে ঘর নাই, এটা লিজার মাথায় আসেনি কখনও। পরে তিনি ওই পথশিশুদের সঙ্গে কথা বললেন। তারা লিজাকে বললো যে, আপু আমরা নিউমার্কেট এলাকাতেই ঘুরে বেড়াই। লোকজন আমাদেরকে খাবার কিনে দেয়, আমরা খাই। এখন তো আর করোনার জন্য কেউ আসে না। এতদিন ধরে লকডাউন দিয়েছে, আমাদের তো ক্ষুধা লাগে। এটা খাবারের দোকান, আমরা জানি তালা ভাঙলে এটার ভিতর খাবার পাওয়া যাবে। বিষয়টি তখন খারাপ লাগে এবং লিজা মধ্যে এ নিয়ে ভাবনা তৈরি হয়।

লিজা ঢাকাটাইমসকে বলেন, কারও কেন একটা বার মাথায় এলো না -এই শিশুরা কী খাবে? পথে থাকা বয়স্ক মানুষগুলো কী খাবে? তখন শিশুদের সঙ্গে করে নিয়ে এলাম। তাদেরকে খাবার দিলাম, গোসল করিয়ে দিলাম, নখ কেটে দিলাম, আমার মনে হয়েছে আমার তো তেমন কোনো সাধ্য নেই যে ওদেরকে আমি ঘরে রাখবো। শুধু মনে হয়েছে ওদেরকে কেমন করে পরিচালনা করলে করোনা মহামারির মধ্যে একটু আরামে থাকবে।

লিজা বলেন, আমার মাথায় একটাই চিন্তা ছিল শিশুদেরকে কিভাবে রক্ষা করব। একটা সময় মনে হলো করোনা থেকে মুক্ত করা অনেক বড় ব্যপার। ভ্যাকসিন, ওষুধ, প্রতিরোধ, ওটাতো আমার তেমন কিছু করার নেই। যারা কর্মহীন বিপন্ন পথে থাকে, তারা যেন খাবারের অভাবে না মরে। অন্যান্য দেশে মহামারিতে মানুষ মরছে, আমার দেশেও মরলো, এই কষ্ট নেওয়া যাবে। কিন্তু না খেয়ে মানুষ মরে গেছে- এটা খুব কষ্টের মনে হলো আমার কাছে।

এরপর একটু একটু করে লিজার মেহমানখানার কার্যক্রম শুরু হলো। বাসা থেকে ৫০/১০০ জন মানুষের রান্না করে আশপাশের লোকজনদের দেন। লিজা বলেন, অনেক পথশিশু আসে। আবার রিকশা করে খাবার নিয়েও বের হই। একটা ড্রাইভারকে সব সময় রাখতাম। তবে দেখা গেলো ১০০-২০০ মানুষ থেকে হাজার হাজার মানুষ হয়ে গেলো। সবাই জেনে গেলো লালমাটিয়ার ডি ব্লকে মেহমানখানায় গেলেই ফ্রিতে খাবার পাওয়া যায়। তখন রিকশাওয়ালা, পথের মানুষ, বয়স্ক মানুষ এসে খেয়ে যায়। আমরা প্রথমে নিজেদের কাছ থেকে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করে গেছি।

এই উদ্যোগের প্রস্তুতিটা একটা যুদ্ধের মতোই ছিল জানিয়ে লিজা বলেন, আমরা ১১ জন ভলান্টিয়ার কাজ শুরু করলাম। এরপর আস্তে আস্তে ফেসবুকে দুয়েকটা ছবি আপলোড করি। এভাবে মানুষ জানতে লাগলো। এবং বিভিন্ন ধরনের মানুষ যুক্ত হতে লাগলেন।

লিজা বলেন, লকডাউন যাওয়ার পর প্রতি শুক্রবারে মেহমানখানা পরিচালনা করতাম। প্রতিদিন আমাদের সম্ভব হতো না। তবে কিছু কাছে মানুষের সহযোগিতা নিয়ে আমরা চালিয়ে যেতাম। মাঝের কিছু সময় খুব কষ্ট করে চালাতে হয়েছে। তবে একসময় মানুষেরও মন নরম হতে লাগলো। মানুষ প্রতিদিন দেখা যেত, চাল, ডাল, নুন, আলু, পেঁয়াজ, মুরগিসহ রান্নার বিভিন্ন উপকরণ আমাদের বাসার সামনে দিয়ে যেতো। যারা একটু বেশি দিতে পারছে এক থেকে চার-পাঁচ বস্তা চাল তারা সরাসরি দিনের আলোতে দিয়ে যায়। আর যারা একটু কম দেয় এক কেজি চাল, এক কেজি লবন। ওরা মধ্যবিত্ত, আর মধ্যবিত্তদের তো আরও বেশি দুঃসময়। কিন্তু ওরা রাতের অন্ধকারে দিয়ে যেতো।

কেউ কেউ খাদ্য উপকরণের সঙ্গে চিরকুট রেখে যেতো। তাতে লেখা ছিল- আমার এটুকুই ছিল। আমি দুই প্যাকেট লবণ দিয়ে গেলাম। সেই মানুষগুলোকে আমি কোনো দিন দেখিনি। হয়তো আমি কোনো দিন দেখবোও না। তবে তাদের জন্য সারাজীবন দোয়া থাকবে আমার। দুঃসময়ে তারা অভুক্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।, বলেন লিজা।

যেসব পথশিশু একবেলা খেতে আসতো, এখন ওরা মেহমানখানায় পড়তে আসে। ওরা এখন প্রশ্ন করে আকাশে চাঁদ কীভাবে ঝুলে থাকে? ওদের এখন বিজ্ঞান নিয়ে ভাবনা। ওদের অল্প একটু খাবার দিলে ওরা এই খাবারটা ভাগ করে রেখে দেয়। কেন এই খাবার পলিথিনে নিচ্ছো জানতে চাইলে তারা জানায়, কুকুর ছানা আছে বাসায়, ওদের জন্য নিয়ে যাচ্ছে।

মেহমানখানার অতিথি পথশিশুদের একটা মানবিক স্কুল দিতে চান লিজা। তিনি বলেন, আমাদের স্কুলটা মোটামুটি কার্যক্রম শুরু করেছি। স্কুলটার নাম ‘অন্যরকম পাঠশালা’। প্রথাগত নিয়মে স্কুলের মতো পড়ানোর সুযোগ না থাকলেও মৌলিক পড়াশোনা করানো হয় তাদের। এর মাধ্যমে যেন তারা অন্তত নিজেকে একজন ভালো মানুষ বলে দাবি করতে পারে। সেটা আমরা শেখাতে চাই। বিশেষ করে মানবিক জায়গাগুলো, তারা যেন মানুষকে ভালোবাসতে শেখে।

মেহমানখানা ক্ষুধার্থ মানুষের পাশে সব সময় থাকবে জানিয়ে লিজা বলেন, দৈনিক ২০-২৫ কেজি চালের রান্না হয় এখন। রাজধানীতে তিনটি এলাকায় মেহমানখানার কার্যক্রম চলছে। দরকার হলে ৬৪টি জেলায় মেহমানখানা চলে যাবে।

রিকশাচালক শরিফ হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, মেহমানখানায় যারা শ্রম দিচ্ছেন, তারা আমার মতো হাজার হাজার গরীবের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। তাদের জন্য আমি প্রাণ খুলে দোয়া করি।

ভ্যানগাড়ির চালক কুদরত পাশা বলেন, আমি করোনার লকডাউনের সময়ও প্রতিদিন এসে মেহমানখানায় খেয়ে যেতাম। এখনও আসি। আমার রুজি বন্ধ হয়ে গেছিলো করোনাভাইরাসের সময়।

মেহমানখানার স্বেচ্ছাসেবক সৈয়দ ইরাজ মাহমুদী বলেন, আমি অন্য জায়গায় চাকরি করতাম। ২০২০ সালে করোনাভাইরাসে লকডাউনের সময় আমার চাকরি চলে যায়। তারপর আমার বোন আসমা আক্তার লিজা আমাকে ডেকে এনে রান্নার কাজে ব্যস্ত করে দেন। ওই যে শুরু হলো মেহমানখানার মেহমানদারী এখন পর্যন্ত আমি লেগে আছি।

সৈয়দ ইরাজ বলেন, অসহায় মানুষের পাশে থেকে কাজ করতে ভালো লাগে। এত মানুষের রান্না তৈরি করতে অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু কাজ শেষ করে যখন বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এসে খেয়ে যায় তখন তৃপ্তিতে মন ভরে যায়।

(ঢাকাটাইমস/১৮মে/পিআর/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজধানী বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

রাজধানী এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :