গম্ভীরা গান যেভাবে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছাল

কামরুজ্জামান রাব্বি
 | প্রকাশিত : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:০১

গম্ভীরা বাংলা লোকগানের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই গানের উৎপত্তি নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। অনুমান করা হয় প্রায় দেড় হাজার বছর আগে এই গম্ভীরা গানের উৎপত্তি হয়েছে। তবে গম্ভীরাকে যদি বাংলা ভাষা বা বাঙালি জাতির মধ্যে অনুপ্রবেশ হিসেবে বিচার করা যায়, তাহলে হয়তো এ অনুমানকে গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে বাঙালি জাতি বা বাংলা ভাষার মধ্যে গম্ভীরার উৎপত্তি বা আবির্ভাবকে দেড় হাজার বছর বয়সে নিয়ে যাওয়া নিছক কল্পনা। কারণ বাঙালি জাতির প্রধান উপাদান বাংলা ভাষা। মোটা দাগে বাঙালি জাতির উদ্ভবকে হাজার বছরের পিছনে নিয়ে যাওয়া হলেও বাংলা ভাষার বয়স আদৌ তা নয়। প্রকৃতপক্ষে স্ববৈশিষ্ট্যে বাংলা ভাষা সৃষ্টি হয়েছে ত্রয়োদশ/চতুর্দশ শতাব্দীতে। প্রায় সাত শ বছর আগে।

অনেকে চর্যাপদকে বাংলা ভাষার আদি রূপ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে চর্যাপদে যে ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোকে স্বতন্ত্র বাংলা বলা যায় না। চর্যাপদগুলো ছিল বাংলা, অহমিয়া ও ওড়িয়া ভাষার পূর্বপুরুষ। তবে বাংলা ভাষার সঙ্গে তার যোগ বেশি। বিভিন্ন পণ্ডিতের মতানুসারে বলা যায়, প্রাপ্ত চর্যাগুলো রচিত হয়েছিল অষ্টম/নবম থেকে শুরু করে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত। তাই বাংলা গম্ভীরার বয়স নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমাদের সাত শ বছর অতীতে যাওয়ার আগেই থেমে যেতে হয়।

বাংলা ভাষার গম্ভীরাকে গৌড়কেন্দ্রিক ধরে আলোচনা করা যেতে পারে। গৌড় ছিল সেকালে বাংলার রাজধানী বা তার পূর্বে গৌড় ছিল একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। চৌদ্দ শতকের দ্বিতীয় ভাগে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহর আমলে গৌড়কে সমগ্র বাংলার রাজধানীতে পরিণত করা হয়েছিল। তৎকালীন গৌড়ের পরিধি ছিল ভারতের বর্তমান মালদা ও বংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অংশ নিয়ে। আঞ্চলিক ভাষা উচ্চারণ ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও উভয় জেলার মানুষের সঙ্গে মিল দেখা যায়। সুতরাং ভৌগোলিক বিচারে আধুনিক ধারার গম্ভীরাকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের স্থানান্তরিক লোকসঙ্গীত বা লোকনাট্য না বলে উৎপত্তি সূত্রের লোকসংস্কৃতি ধরা যায়। তবে সূত্রপাত ঘটে বর্তমান মালদা অংশেই। সেখান থেকে সম্প্রসারিত হয় বর্তমান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলায়।

আবার গম্ভীরা গানের উৎপত্তি নিয়ে গবেষকদের যুক্তিগত আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে বর্তমান ধারার এ লোকনাট্যের উৎপত্তি মালদায়। তবে এর পিছনেরও ইতিহাস আছে। ইন্দো-মঙ্গলীয় জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন শাখায় গম্ভীরা উৎসব বা বার্ষিক উপজাতীয় অধিবেশন উপলক্ষে বর্ষবিবরণী বা বর্ষপর্যালোচনা হিসেবে এ ধরনের আয়োজনের সন্ধান পাওয়া যায়। ড. আশুতোষ মনে করেন, এ রকমের অনুষ্ঠান থেকেই গম্ভীরার উদ্ভব ঘটে। তিনি এও মন্তব্য করেন, মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে ব্যবহৃত গম্ভীরার সাথে সঙ্গীত অর্থে গম্ভীরার মৌলিক সম্পর্ক নাই। তিনি জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার অঞ্চলের লোকসঙ্গীত গম্ভীরা শব্দটিকে তিব্বতীয়-চৈনিক প্রভাবজাত সংস্কৃত রূপান্তর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাই গম্ভীরার আদিভূমি ও উৎপত্তিভিত্তিক জনগোষ্ঠী নির্ণয়ের জন্য ব্যাপক অনুসন্ধান প্রয়োজন।

ভারতের মালদহ মূলত এই গম্ভীরা গানের উৎপত্তিস্থল হলেও জলপাইগুড়ি, দিনাজপুরে এই গানের প্রচলন আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী অঞ্চলে গম্ভীরা গানের প্রচলন দেখা যায়। আদিতে গম্ভীরা গানের দুই ধরনের রূপ থাকলেও বর্তমানে আছে শুধু পালা গম্ভীরা। জনৈক গবেষকের মতে, শিবের আরেক নাম ‘গম্ভীর’। মূলত গম্ভীরা গানের মূল বিষয়বস্তু শিবের বন্দনাগীতি। কিন্তু বর্তমানে গম্ভীরা গানের মধ্যে শিবের কোনো অস্তিত্ব বা সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায় না। এখন গম্ভীরা হয় নানা রকম ঘটনা, সমাজ ও জীবনের কথা নিয়ে। একটা সময় গম্ভীরা পূজা উৎসবের প্রচলন ছিল যা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। বর্তমান সময়ের এই গম্ভীরাকে এক ধরনের লোকনাট্য বলা যায়। অন্যদিকে ভারতের মালদহ, জলপাইগুড়ি, দিনাজপুরে এখনও গম্ভীরা মুখোশ পরে গম্ভীরা নৃত্য করা হয় চৈত্রসংক্রান্তিতে।

বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী অঞ্চলের গম্ভীরা গান দুজন শিল্পী পরিবেশন করেন, সাথে থাকে বাদকদল। এই দুজন শিল্পীর একজন নানা ও অন্যজন নাতির চরিত্রে বেশ কৌতুকপূর্ণ সংলাপ, নাচ ও গানের মাধ্যমে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। নানা-নাতি ছাড়াও গম্ভীরা গানে ছয় থেকে সাতজন দোহার, একজন তবলাবাদক, একজন হারমোনিয়ামবাদক ও একজন জুড়িবাদক থাকেন।

নানা ও নাতির পোশাক থাকে বাংলার কৃষকের মতো। নানার মুখে পাকা দাড়ি, মাথায় মাথাল, হাতে লাঠি, গায়ে গেঞ্জি, লুঙ্গি ও কোমরে গামছা। নাতি তালি দেয়া হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরে বেশ রস করেন। একেকটি গানের বা পালার পরিবেশনকাল এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যেই থাকে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় গম্ভীরা গাওয়া হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের রাকিব উদ্দিন, কুতুবুল আলম, মাহবুবুল আলম, ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ, সফিউর রহমান, সৈয়দ শাহ জামাল প্রমুখ উল্লেখযোগ্য গম্ভীরা শিল্পী। মূলত এদের প্রচেষ্টা ও পরিবেশনাতেই গম্ভীরা একালে একটি জনপ্রিয় লোকগানে প্রাণ পায়। রসকষসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জে ছয়টি গম্ভীরা দল বর্তমানে আছে।

লেখক: লোকসঙ্গীত শিল্পী। এবং অতিথি প্রভাষক, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ (ইউডা)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :