ইরানের হিজাব বিরোধী আন্দোলন

বৈশ্বিক সাংবাদিকতার দৃশ্যপট ও বাস্তবতার আয়না

মো. অলিউর রহমান
| আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০২২, ১৬:২৩ | প্রকাশিত : ০১ নভেম্বর ২০২২, ১৬:২১

বৈশ্বিক সাংবাদিকতা- শব্দটার ভাবার্থ হিসেবে ‘যোগসূত্র’ শব্দটা ব্যবহার করা যেতে পারে। কারণ বৈশ্বিক সাংবাদিকতা মূলত পাঠক/দর্শক ও বাস্তবতার মধ্যে একটা যোগসুত্র হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এই ‘বাস্তবতা’ অনেক সময় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ভিন্ন রূপ ধারণ করতে পারে।

কয়েক সপ্তাহ আগে সিএনএনের সাংবাদিক ক্রিশ্চিয়ান আমানপুরের একটা ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে যেখানে আমানপুর একটা খালি চেয়ারের সামনে দৃশ্যত কারো জন্য অপেক্ষারত হয়ে বসে ছিলেন। পরে ছবিগুলোর পেছনের গল্প পড়ে জানা যায়, আমানপুর ইরানের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম রাইসির সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তখন তাকে রাষ্ট্রপতির তরফ থেকে হিজাব পড়তে বলা হলে তিনি তা পড়তে অস্বীকৃতি জানান এবং রাষ্ট্রপতির তরফ থেকে সাক্ষাৎকার বাতিল করা হয়।

ঘটনাটি দেশে বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন ফেলে। কেউ কেউ অমানপুরের সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসাও করেন। কিন্তু একটা প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়, তার এই আচরণ কিসের প্রতি ইঙ্গিত করে? তিনি নিজে যেহেতু ইরানি বংশোদ্ভূত, তিনি কি ইরানে চলমান হিজাব বিরোধী আন্দোলনে নিজের সমর্থন জানানোর জন্য এ কাজ করেছিলেন নাকি ইরানের সরকারের বিরুদ্ধে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করার জন্য এ কাজ করেছিলেন তা নিয়ে এখনও মানুষের মনে শঙ্কা রয়েই গেছে।

যদি তিনি আন্দোলনে নিজের সমর্থন জানানোর জন্য এ কাজ করে থাকেন, তাহলে ইরানের ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতিকে জনগণের প্রশ্নের কাঠগড়ায় দাড় করানোর মাধ্যমেও তিনি তা করতে পারতেন। প্রশাসন থেকে জনগণের জবাবদিহিতা হয়ত বেশি মুখ্য ছিল বলেই তিনি গত বছর তালিবানের নেতা সিরাজউদ্দিন হাক্কানীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য হিজাব পড়েছিলেন। কিন্তু আলোচনার বিষয় যখন ইরানের হিজাব বিরোধী আন্দোলন তখন প্রশাসনকে এভাবে কেন বিশেভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে?

বিষয়টাকে যদি আরেকটু সহজ করে দেখার চেষ্টা করা হয় তাহলে একটা প্রশ্ন দাড়ায় যা হল, ইরানের ‘হিজাব বিরোধী আন্দোলনকে’ কেন্দ্র করে বৈশ্বিক সাংবাদিকতার দৃষ্টিভঙ্গির বাঁক কেন বদলে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে?

কয়েক সপ্তাহ আগে ইংরেজি দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানে ইরানের হিজাব বিরোধী আন্দোলন নিয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের শীর্ষক ছিল, ‘Are hijab protests, the beginning of the end for Iran's regime?’ গত বছর যখন তালিবান সরকার আফগানিস্তানে জোর পূর্বক নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল তখন আফগান নারীরা নিজেদের স্বাধীনতার জন্য একটা আন্দোলন করেছিলেন যার স্লোগান ছিল ‘Do Not Touch My Clothes’।

দুইটা আন্দোলনই পোশাক নিয়ে। কিন্তু তালিবান সরকারের পতন নিয়ে বৈশ্বিক সাংবাদিকতা জগতে বিশেষ কোন ও প্রতিবেদন নজরে পড়ে না। বিষয়টাকে একটু ভিন্নভাবে দেখলে কিছু জিনিস পরিষ্কার হবে। কিছুদিন আগে ভারতে হিজাব নিয়ে ঘটে যাওয়া বিতর্কের কথাই ধরা যাক। ইরান ও ভারতের দুইটা ঘটনা আসলে বলতে গেলে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। দুইটার মূল বক্তব্য একটাই— একজন নারী কি হিজাব পড়বেন কি পড়বেন না তা তার ব্যক্তি স্বাধীনতার ওপর নির্ভর করবে। কেউ তাকে জোর করে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করাতে পারবে না।

১৯৭৯ সালে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের পর এ পর্যন্ত নারীদের স্বাধীনতার জন্য যতগুলো উল্লেখযোগ্য আন্দোলন হয়েছে যেমন My Stealthy Freedom, White Wednesdays, Girls Of Revolution Street তা সম্মিলিতভাবে যতটুকু ইতিহাসের পাতায় ও মানুষের মনে দাগ কাটতে পারেনি, তার থেকে বেশি গভীর দাগ কেটেছে বর্তমান হিজাব বিরোধী আন্দোলন যার সূচনা হয়েছে ২২ বছর বয়সী মাহশা আমিনীর মৃত্যুর মাধ্যমে। কিন্তু আন্দোলনের দৃশ্যপটটা যদি নারীদের স্বাধীনতাকামী আন্দোলন থেকে ইরানের সরকার বিরোধী আন্দোলন হিসেবে এভাবেই বৈশ্বিক সাংবাদিকতায় তুলে ধরা হয় তাহলে হয়তবা এতগুলো প্রাণ যেই উদ্দেশ্যে চলে গেল তা কখনই স্বার্থক হবে না। বৈশ্বিক সাংবাদিকতা বিশ্বের মানুষকে একটা দৃষ্টিভঙ্গি দেয়, বাস্তবতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। কিন্তু তাই যদি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে সত্য কখনোই মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারবে না।

লেখক

শিক্ষার্থী

গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :