ইসলামে দেশপ্রেমের গুরুত্ব

ড. মো. শাহজাহান কবীর
 | প্রকাশিত : ১৬ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:২৭

স্বাধীনতা মহান আল্লাহর দেওয়া এক বড় নিয়ামত। মাতৃভূমির প্রতি যে বিশেষ অনুরাগ-আবেগ, মমতা ও ভালোবাসা, তারই নাম দেশপ্রেম। ইসলামে স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার জোরালো দিকনির্দেশনা রয়েছে।

দেশপ্রেম ও মাতৃভূমিকে ভালোবাসা এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা ইমানের দাবি। তাই বহুল প্রচারিত আরবি প্রবাদ—‘স্বদেশপ্রেম ইমানের অঙ্গ।’ ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়-মনজুড়ে আরবি প্রবাদ বাক্যটি স্বদেশপ্রেমের প্রতি বিশেষ প্রভাব ফেলেছে।

মাতৃভূমির প্রতি হৃদয়ের টান এক মহান মানবীয় গুণ। এ গুণের অধিকারী ছিলেন মানবতার মুক্তির মহান অগ্রদূত সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.) ও তার সাহাবায়ে কেরাম। ধর্মের বাণী মানুষকে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়েছে; কিন্তু ধর্মের প্রবক্তারা জীবন বিসর্জন দিয়ে ধর্মীয় সত্য প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। নবী ও রাসুলগণ এ পন্থায় দেশ ও সমাজের উপকার করে স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তাদের দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদেরও সেসব দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা উচিত।

ভালোবাসার শক্তি অসীম ও পরাক্রম। ভালোবাসা যেভাবে মানুষকে বেঁচে থাকতে সাহস জোগায়, তেমনি ভালোবাসা মানুষকে প্রাণ বিসর্জন দিতেও সাহসী করে তোলে। কোনো ভূখণ্ডের প্রতি ভালোবাসা, তার বিরুদ্ধে পরিচালিত সব ধরনের আগ্রাসন ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব। ১৯৭১ সালে বর্বর পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করে লাখ লাখ মানুষের জীবন, সম্পদ ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে যে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ আমরা পেয়েছি, তার মূলেও আছে মুক্তিকামী জনতার দেশপ্রেম ও দেশাত্মবোধ। যার কাঙ্ক্ষিত পরিণতিতে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রত্যেক নবীকে একেকটি অঞ্চলে দ্বিনের দাওয়াতের দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন। হযরত মুসা (আ.)-এর জাতি ও দেশ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা সূরা আল-মায়েদার ২০ আয়াতে এরশাদ করেনÑ‘স্মরণ করো, যখন মুসা তার সম্প্রদায়কে বলেছিল—হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ করো, যখন তিনি তোমাদের মধ্য থেকে নবী পাঠিয়েছিলেন এবং তোমাদের রাজত্বের অধিকারী করেছিলেন। আর বিশ্বজগতে কাউকেও যা তিনি প্রদান করেননি, তা তোমাদের দিয়েছেন।’

সূরা ইবরাহিমের ৪ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেনÑ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি।

উল্লেখিত আয়াতগুলোতে ‘কাওমিহি’ বা ‘স্বজাতি’ শব্দ ব্যবহার করে দেশ, দেশের মানুষ, দেশের ভাষা ও নিজ সম্প্রদায়ের প্রতি সবিশেষ গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। অন্যায়ভাবে কাউকে নিজ দেশ ও মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য করা ইসলামের চোখে খুব গর্হিত অপরাধ। তাই মক্কার কাফির কর্তৃক স্বদেশভূমি মক্কা থেকে রাসুলকে (সা.) বিতাড়নের চেষ্টাকে কোরআনে ষড়যন্ত্র ও অন্যায় হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং তোমাদের ন্যায়পরায়ণ শাসকের আদেশ মেনে চল (সূরা নিসা: ৫৯)। দেশের স্বাধীনতা রক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, যে চোখ দেশের সীমান্ত রক্ষায় বিনিদ্র থাকে সে চোখকে জাহান্নাম স্পর্শ করবে না।

আল্লাহর রাসূল নিজে স্বদেশকে ভালবেসে আমাদের জন্য নমুনা উপস্থাপন করে গেছেন। রাসূল সা. তার দেশ মক্কাকে অন্তর দিয়ে ভালবাসতেন, মক্কার জনগণকে ভালবাসতেন। তাদের হেদায়াতের জন্য তিনি কঠোর অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন। কোনোদিন মক্কাবাসীর অকল্যাণ পর্যন্ত কামনা করেননি। তায়েফে এত নির্যাতন করল তারপরও কোনো বদদোয়া করেননি।

মহানবী সা. সাহাবিদের কাফিরদের অত্যাচারে আবিসিনিয়ায় হিজরতের অনুমতি দিলেও তিনি মক্কায় নির্যাতন সহ্য করে অবস্থান করলেন। পরিশেষে কাফিরদের কঠিন ষড়যন্ত্রের কারণে এবং আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে তিনি যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন মক্কার দিকে বারবার ফিরে তাকান। আর কাতর কণ্ঠে বলেন, ও আমার দেশ, তুমি কত সুন্দর! আমি তোমাকে ভালবাসি। আমার আপন জাতি যদি ষড়যন্ত্র না করত, আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।

মদিনায় হিজরতের প্রাক্কালে রাসুলে পাক (সা.) বলেছিলেন, ‘আল্লাহর নামে শপথ- হে মক্কা, তুমি আল্লাহর ভূখণ্ডগুলোর মধ্যে সর্বোত্তম, তুমি আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় তার অন্যান্য ভূখণ্ড থেকে। আমি যদি তোমার কোল থেকে বহিস্কৃত না হতাম, আমি তোমার কাছ থেকে বের হয়ে যেতাম না।’

এ বাণী থেকে রাসুলে পাক (সা.) এর মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন সহজেই বোঝা যায়। সাহাবায়ে কেরামগণ আমাদের মতোই দেহ-মনের মানুষ ছিলেন। হজরত আবু বকরও (রা.) রাসুলে পাক (সা.) এর সঙ্গে মদিনায় হিজরত করেছিলেন। তাই বলে তার মন থেকে মক্কার প্রতি ভালোবাসা কখনও মুছে যায়নি।

মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা, তার সংরক্ষণের দায়িত্ব শুধু জন্মভূমি হওয়ার কারণেই জরুরি নয়। বরং যে জন্মভূমিতে বসে, যে রাষ্ট্রে বাস করে মুসলিম জনগণ মহান আল্লার দেওয়া বিধান অনুযায়ী জীবনযাপনের সুযোগ পাবে, তার প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা থাকা একান্ত জরুরি। এ প্রসঙ্গে রাসুলে পাক (সা.) এরশাদ করেন, আল্লাহর পথে এক দিন সীমান্ত রক্ষার কাজে নিযুক্ত থাকা হাজার দিনের মঞ্জিল অতিক্রম করা অপেক্ষা উত্তম।

স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের জন্য কিছু করা গৌরবের বিষয়। দেশ ও জাতির জন্য আত্মনিবেদিত মানুষ সমাজের চোখে যেমন সম্মানিত, তেমনি আল্লাহর কাছেও অত্যন্ত গৌরবময় মর্যাদার অধিকারী। দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় সীমান্তরক্ষীদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। দেশের সীমান্তরক্ষী অতন্দ্র প্রহরীদের সম্পর্কে রাসুলে পাক (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘এক দিন ও এক রাত সীমান্ত পাহারা ক্রমাগত এক মাসের সিয়াম সাধনা ও সারা রাত নফল ইবাদতে কাটানো অপেক্ষা উত্তম (মুসলিম)।’

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসুলে পাককে (সা.) বলতে শুনেছি, ‘দুই প্রকারের চক্ষুকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না। প্রথমত, সেই চক্ষু যা আল্লাহর ভয়ে কাঁদে; দ্বিতীয়ত, আল্লাহর পথে সীমান্ত পাহারাদারি করতে করতে রাত কাটিয়ে দেয় বা বিনিদ্র রজনী যাপন করে’ (তিরমিজি)।

দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসা ইমান ও আদর্শভিত্তিকই হতে হবে। ইমানপ্রেমের মতো দেশপ্রেমও মুমিনের অস্তিত্বের অংশ। এ জন্য নিজের দেশ ও জাতির প্রতি স্বাধীন দেশের প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ নাগরিকের নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘সাবধান, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল ও তোমাদের প্রত্যেককেই দায়িত্বশীলতার জন্য জবাবদিহি করতে হবে (বুখারি)।’

দেশাত্মবোধ ও স্বদেশের প্রতি মমতা অনেক অন্যায় ও অপরাধপ্রবণতা থেকে মানুষকে বিরত রাখতে পারে। তাই দেশের প্রকৃত উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করতে হলে অবশ্যই দেশের প্রতিটি নাগরিকের অন্তরে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। স্বদেশের প্রতি অনুগত থেকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশমাতৃকাকে ভালোবাসা সবার ইমানি দায়িত্ব ও পবিত্র কর্তব্য।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :