আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, যারা আল্লাহকে ভালোবাসে

মহান আল্লাহ বিশ্বজগতের সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা, লালনকর্তা ও পালনকর্তা। তিনি সমুদয় বস্তুর মালিক ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। সত্তা, স্বকীয়তা, গুণ, কর্ম ও ক্ষমতায় তাঁর সমপর্যায়ের কেউই নেই, তিনি লা শরিক। দৃশ্য ও অদৃশ্য জগতের সব কিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণাধীন।
মহাবিশ্বের রাজাধিরাজ আল্লাহ। মানুষ, পশুপাখি, মাছ, গাছপালা, প্রকৃতি, পৃথিবী, চাঁদ, গ্রহ, উপগ্রহ, সৌরজগৎ, নীহারিকা নিয়ে এক মহাআশ্চর্য্য এই বিশ্বভ্রম্মান্ডে যা কিছু আছে, সবকিছু এক আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। সেই সৃষ্টিকর্তা সর্বশক্তিমান ও একজন। তাঁকে কেউ সৃষ্টিও করেনি, তার সন্তানাদিও নেই। তাঁর সমকক্ষ বা তাঁর মত কিছুই নেই।
আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোন উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সর্বদা রক্ষণাবেক্ষণকারী। তাঁকে তন্দ্রা ও নিদ্রা স্পর্শ করে না। আকাশমন্ডলে ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, তাঁরই। কে সেই ব্যক্তি যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর নিকট সুপারিশ করে? তিনি লোকদের সমুদয় প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অবস্থা জানেন। পক্ষান্তরে মানুষ তাঁর জ্ঞানের কোনকিছুই আয়ত্ত করতে সক্ষম নয়, তিনি যে পরিমাণ ইচ্ছে করেন সেটুকু ছাড়া। তাঁর কুরসী আকাশ ও পৃথিবী পরিবেষ্টন করে আছে এবং এ দুয়ের রক্ষণাবেক্ষণ তাঁকে ক্লান্ত করে না, তিনি উচ্চ মর্যাদাশীল, মহান।
হে মহান সত্তা আমরা আপনার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি। আপনি কতই না মহান। আল্লাহতায়ালা বলেন, অতএব, আপনি আপনার মহান পালনকর্তার নামে পবিত্রতা ঘোষণা করুন। (সুরা আল ওয়াকিয়াহ, আয়াত: ৯৬)নিশ্চয় তিনি আল্লাহ গৌরবময়, সর্বাধিক বড়ত্বের অধিকারী, সর্বোচ্চ সম্মানিত। নিশ্চয়ই তিনি গৌরব, বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্বের বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত। যিনি বৃহত্তর, মহিমান্বিত, মহত্তম ও উচ্চতর। আল্লাহর খাঁটি বান্দাদের অন্তরে রয়েছে তাঁর মহত্ত্ব ও বড়ত্ব। তাদের অন্তরসমূহে তাঁর বড়ত্ব ও মহত্ত্বে পরিপূর্ণ। তারা তাঁর সামনে বিনীত হয়, তাঁর বড়ত্বের সামনে অবনত হয়।
আল্লাহতায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই যারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, অতঃপর সে বিশ্বাসে অবিচল থাকে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না। তারাই জান্নাতের অধিকারী। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। তারা যে কর্ম করে, এটা তারই প্রতিফল। (সুরা আহকাফ, আয়াত ১৩-১৪)
আল্লাহতায়ালা বলেন, যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদের আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সঙ্গে আছেন। (সুরা আনকাবুত, আয়াত ৬৯)
আল্লাহকে পেতে হলে প্রতিটি মানুষের প্রথমেই দরকার আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা। ঈমানের ভিত্তিতে মহান আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক ও ভালোবাসা তৈরি হয়। যার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়, তার চাওয়া-পাওয়া অগ্রাধিকার পায়। আল্লাহকে ভালোবাসার উপায় ও পরিণাম সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, মনে রেখো, যারা আল্লাহর বন্ধু, তাদের কোনো ভয়-ভীতি নেই, তারা চিন্তিতও হবে না। যারা ঈমান এনেছে এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছে, তাদের জন্য সুসংবাদ পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে। আল্লাহর কথার কখনো হেরফের হয় না। এটাই হলো মহা সফলতা। (সুরা ইউনুস, আয়াত ৬২-৬৪)
আল্লাহতায়ালা প্রেমময়। বান্দাদের সীমাহীন ভালোবাসেন। বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল। তিনি আমাদের নেয়ামতের সাগরে ডুবিয়ে রেখেছেন। এ বিশ্বচরাচরে যা কিছু আছে, সব তাঁর দয়া অনুগ্রহ ও সুমহান প্রেমের প্রকাশ। আল্লাহতায়ালা বলেন, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, সব তিনি তোমাদের সেবায় নিয়োজিত রেখেছেন। এর সবই তাঁর পক্ষ থেকে। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন। (সুরা জাছিয়া, আয়াত ১৩)
আল্লাহ বলেন, শপথ আঞ্জির ও যায়তুনের এবং সিনাই মরুভূমির পাহাড় তূরের এবং এই নিরাপদ শহরের,আমি মানুষকে সর্বোত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি। (সুরা তীন, আয়াত ১-৪)
মহান আল্লাহ মানুষকে অনেক বেশি ভালোবাসেন, তাই তাকে করেছেন আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা। তাকে দিয়েছেন সর্বোচ্চ মর্যাদা। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। (সুরা ইসরা, আয়াত ৭০)
ভালোবাসা ছাড়া মানুষ, জিন, অন্য প্রাণীরাও বাঁচতে পারে না। এই প্রীতি ভালোবাসা, স্নেহ মমতার কল্যাণেই পৃথিবী এখনো টিকে আছে। মানবপ্রজন্ম ও প্রাণীকূল পৃথিবীর শোভাবর্ধন করছে। স্নেহময়ী মা তার সন্তানকে যেমন ভালোবাসে, তার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন আল্লাহতায়ালা মানুষ, জিন, প্রাণীকূলকে। ভালোবাসা আল্লাহ প্রদত্ত। তাঁর দেয়া একটি বড় নেয়ামত।
নবীজী সা. বলেছেন- ‘আল্লাহর একশ’ ভাগ রহমত আছে। তন্মধ্যে একভাগ রহমত মানুষ, জীন, চতুষ্পদ জন্তু ও কীট-পতঙ্গের মাঝে বণ্টন করে দিয়েছেন। এ একভাগ রহমতের কারণেই সৃষ্টিজীব পরস্পর একে অপরের প্রতি অনুগ্রহ করে এবং এ একভাগ রহমতের ভিত্তিতেই বন্য পশু নিজ সন্তানের প্রতি অনুগ্রহ ও অনুকম্পা প্রদর্শন করে। (সহীহ মুসলিম ৬৭২১)
আল্লাহর দৃষ্টিতে সব মানুষই সমান। তার কাছে তারাই বেশি সম্মানিত যারা পরহেজগার এবং আল্লাহভীরু। এক্ষেত্রে আর্থিক সামর্থ্য, ক্ষমতা বা অন্য কিছু বিবেচনায় আসবে না। মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা ও তার কারণ উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে অধিক আল্লাহভীরু ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে অধিক সম্মানিত। (সুরা হুজরাত, আয়াত ১৩)
মহান রাব্বুল আলামিন তার পরহেজগার বান্দাদের ভালোবাসেন। আল্লাহ বলেন, আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি এবং জলে-স্থলে তাদের আরোহণ করিয়েছি, তাদের পবিত্র বস্তু দিয়ে রিজিক দিয়েছি এবং আমার বহুসংখ্যক সৃষ্টির ওপর সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। (সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৭০)
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে তৈরি করেছেন। তাদের এ শ্রেষ্ঠত্ব যাতে উপলব্ধি করা যায়, সে জন্য মানুষকে সৌন্দর্যমন্ডিত করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, আমি মানুষকে অতি সুন্দর অবয়বে সৃষ্টি করেছি। (সুরা ত্বিন, আয়াত ৪) আল্লাহ বলেন, তিনিই তো ওই সত্তা যিনি তোমাদের মায়েদের গর্ভে নিজের ইচ্ছামতো আকৃতি গঠন করেন। তিনি ব্যতীত আর কোনো উপাস্য নেই। তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়। (সুরা আল ইমরান, আয়াত ৬)
অন্য আয়াতে মানব সৃষ্টির উপাদান বর্ণনা করে আল্লাহ বলেন, আমি মানুষকে গন্ধযুক্ত কর্দমের শুষ্ক ঠনঠনা মৃত্তিকা থেকে সৃষ্টি করেছি। (সুরা হিজর, আয়াত ২৬)
মানুষের শারীরিক অবকাঠামো গঠন, বৃদ্ধি ও পরবর্তী পর্যায়ের বিশদ বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে লোক সকল! মৃত্যুর পর পুনরুত্থান সম্পর্কে যদি তোমরা কোনো সন্দেহ পোষণ করে থাক (তাহলে ভেবে দেখ) আমি তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি, পরে শুক্রকীট থেকে, তারপর রক্তপিণ্ড থেকে, পরে মাংসপিণ্ড থেকে যা আকৃতি সম্পন্নও হয়, আবার আকৃতিবিহীনও; যেন তোমাদের কাছে প্রকৃত সত্য সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করি। আমি যেটিকে (শুক্রকীট) ইচ্ছা করি একটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জরায়ুর মধ্যে স্থিতিশীল করে রাখি। পরে তোমাদের শিশুরূপে ভূমিষ্ঠ করি। ফলে তোমরা তোমাদের যৌবনে পদার্পণ করে থাক। আর তোমাদের মধ্যে কাউকে এর আগেই মৃত্যু দেওয়া হয়।
আবার কাউকে নিকৃষ্টতম জীবনের (বার্ধক্য) দিকে প্রত্যাবর্তন করানো হয়, ফলে সে সবকিছু জেনে নেয়ার পরও কিছু জানে না। আপনি শুষ্ক জমিন দেখতে পাচ্ছেন। পরে যখনই আমি তার ওপর পানি বর্ষণ করি সহসাই তা সতেজ হয়ে ওঠে, ফুলে ওঠে এবং তা সব ধরনের সুদৃশ্য উদ্ভিদ উৎপাদন করতে শুরু করে দেয়। (সুরা হজ-৫)
আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ইবাদত করার জন্যই তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর এবং সকাল-সন্ধ্যায় তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর। (সুরা আল আহযাব, আয়াত ৪১-৪২)
আল্লাহ দয়ালু, করুণাময়, ধৈর্যশীল। বান্দা অবাধ্যতা করে, তবুও তিনি তাকে নিজের দুয়ারে আহ্বান করেন। অপরাধ করে, তবুও তাঁর করুণার দ্বার রুদ্ধ হয় না। অবিরাম তাঁর কল্যাণের বারিধারা বর্ষিত হচ্ছে। বান্দাকে তিনি ক্ষতি থেকে হেফাজত করছেন। বান্দার প্রতি ধৈর্যের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন।
পাপাচারে লিপ্ত হয়ে নিজের জীবন অপচয় করে ফেলছে। প্রেমময় মালিক কোমল ভাষায়, সুন্দর সতর্কীকরণের মাধ্যমে তাদের সম্বোধন করে বলছেন, বলো, হে আমার সেসব বান্দা! যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ; তোমরা আল্লাহর করুণা থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করেন। তিনিই ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়। (সুরা যুমার, আয়াত ৫৩)
তওবা করলে বান্দা আল্লাহর প্রিয়ভাজন হয়ে যায়। কারণ, আল্লাহ তওবাকারীকে ভালোবাসেন। তওবাকারীদের জন্য রয়েছে তাঁর বিশেষ ভালোবাসা। বান্দার তওবায় আল্লাহ খুশি হন। অথচ তিনি এর মুখাপেক্ষী নন। আল্লাহর করুণা সুপ্রশস্ত। তিনি এই করুণা লাভের উপায়ও বলে দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমার দয়া সবকিছুতে পরিব্যাপ্ত। আমি তা নির্ধারণ করব তাদের জন্য, যারা ভয় করে, জাকাত আদায় করে আর যারা আমার নিদর্শনগুলোতে বিশ্বাস রাখে। (সুরা আরাফ : ১৫৬) আল্লাহর সত্তা প্রেমময়, তিনি প্রিয়জনদের প্রতি স্নেহশীল। তাদের জন্য তাঁর উপচেপড়া ভালোবাসা। আল্লাহ মোমিনদের ভালোবাসেন। মোমিনরাও তাঁকে ভালোবাসে। মোমিনরা তাঁকে ভালোবাসে তাঁর একত্বে বিশ্বাস স্থাপন ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর অনুসরণের মাধ্যমে। আল্লাহতায়ালা বলেন, বলো, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ করো; আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা আল ইমরান, আয়াত ৩১)।
বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি সন্ধানে ব্যাপৃত থাকে; এক পর্যায়ে আল্লাহর ভালোবাসা লাভে ধন্য হয়, তার নৈকট্য অর্জন করে। যখন আল্লাহ কাউকে ভালোবাসেন, সৃষ্টির কাছেও তাকে প্রিয় করে তোলেন। বান্দা যখন নিজের হৃদয় আল্লাহর দিকে ধাবিত করে, সৃষ্টিকুলের হৃদয়ও আল্লাহ তার দিকে ধাবিত করে দেন। সাহল ইবনে আবু সালেহ সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন; হজের মৌসুম। আমরা আরাফায়। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সেখান দিয়ে যাচ্ছেন। লোকেরা তাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধার নজরে দেখতে লাগল। আমি আমার পিতাকে বললাম, ‘বাবা! আমার মনে হয়, আল্লাহ ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে ভালোবাসেন।’ বাবা বললেন, ‘কীভাবে বুঝলে?’ বললাম, ‘কারণ, মানুষের অন্তরে দেখুন তার জন্য কী পরিমাণ ভালোবাসা!’ তখন আমার বাবা বললেন, ‘আমি আবু হুরায়রা (রা.)-কে রাসুল (সা.)-এর কাছ থেকে বর্ণনা করতে শুনেছি, যখন আল্লাহ কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, জিবরাইল (আ.)-কে ডেকে বলেন, আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন, তুমিও তাকে ভালোবাসো। ফলে জিবরাইল (আ.) তাকে ভালোবাসেন। জিবরাইল (আ.) আবার আসমানের ফেরেশতাদের ডেকে বলেন, আল্লাহ অমুককে ভালোবাসেন, তোমরাও তাকে ভালোবাসো। ফলে আসমানের ফেরেশতারা তাকে ভালোবাসতে শুরু করে। এভাবে পৃথিবীতেও তার সর্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়। (মুসলিম)
আল্লাহতায়ালা বলেন, যারা ঈমান আনে ও নেক আমল করে, আল্লাহ তাদের জন্য ভালোবাসা বরাদ্দ করে রাখেন। (সুরা মারইয়াম, আয়াত ৯৬)
এ ভালোবাসা তারা পরজগতে যেমন লাভ করবে, লাভ করবে ইহজগতেও। বান্দার প্রতি আল্লাহর ভালোবাসা মৃত্যুর পরও জারি থাকে। মৃত্যুর সময় যখন উপস্থিত হয়, যখন চোখ ছিটকে বেরুনোর উপক্রম হয়, গলার মাঝে গড়গড় আওয়াজ শুরু হয়, মোমিনের জন্য সেই সময়ে আল্লাহর ভালোবাসা প্রাপ্তির সুসংবাদ রয়েছে। সেই তখনও আল্লাহ মোমিনের ওপর দয়া করেন। তার ওপর আল্লাহর করুণা বর্ষিত হতে থাকে। মোমিনকে যখন কবরে রাখা হয়, তার জন্য দৃষ্টির প্রান্তসীমা পর্যন্ত কবরকে প্রশস্ত করে দেওয়া হয়। তার কবর পরিণত হয় জান্নাতের বাগিচায়। যখন মানুষ কবর থেকে খালি পায়ে, উলঙ্গ, খতনাবিহীন বেরুবে, তখন ফেরেশতারা মোমিনদের সঙ্গে মিলিত হবে। তাদের অভিনন্দন জানাবে, সুসংবাদ দেবে। এ সবই মোমিনদের প্রতি আল্লাহর ভালোবাসার প্রকাশ।
আল্লাহতায়ালা বলেন, যাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ নির্ধারিত হয়ে আছে, তাদের জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে। তারা তার ক্ষীণতম শব্দও শুনতে পাবে না। তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো জীবনযাপনের মাঝে চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করবে। মহাভীতি তাদের বেদনাহত করবে না। ফেরেশতারা তাদের সঙ্গে এসে সাক্ষাৎ করবে আর বলবে, এটা হলো তোমাদের সেদিন, যার ওয়াদা তোমাদের সঙ্গে করা হয়েছিল। (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ১০১-১০৩)
আল্লাহ তায়ালা বলেন, (হে মুহম্মদ, তুমি) বলো,”তোমরা যদি আল্লাহ্কে ভালোবাসো তবে আমাকে অনুসরণ কর,আল্লাহ্ তোমাদের ভালোবাসবেন ও অপরাধ ক্ষমা করবেন।আল্লাহ্ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা- আল ইমরান, আয়াত ৩১)
আল্লাহকে ভালোবাসার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণ করতে হবে। ‘যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমার নবী (সা.)-এর অনুসরণ করো; তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ মার্জনা করবেন।’ (আল ইমরান: ৩১)। আল্লাহর কাছে প্রিয় ঈমান ও কুফরী, পাপাচার এবং অবাধ্যতা অপছন্দনীয় (হুজুরাত: ৭)। প্রভুর জিকরের ভালোবাসা মোমিনের হৃদয়ে থাকবে। (ছদ: ৩২)। ধ্বংসশীলদের ভালো না বাসাই যৌক্তিক (আনআম: ৭৬)। ভালোবাসার জিনিস ব্যয় (দান) করা প্রকৃত কল্যাণ লাভের উপায় (আল ইমরান: ৯২)। আল্লাহর ভালোবাসায় দান করা মোমিনের পরিচয় (বাকারা: ১৭৭)। আল্লাহর ক্ষমাকে ভালোবাসা বিশ্বাসীদের কাজ (নূর: ২২)। বিজয়কে ভালোবাসা মানব স্বভাব (ছফ: ১৩)। তোমরা তাদের (অবিশ্বাসী ও অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিদের) ভালোবাসো কিন্তু তারা তোমাদের ভালোবাসে না। আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, যারা (মোমিনরা) আল্লাহকে ভালোবাসে (মায়িদা: ৫৪)। মোমিনগণ আল্লাহকে কঠিন ভালোবাসেন। (বাকারা: ১৬৫)। তাঁরা (মোমিনরা) মুহাজিরদের ভালোবাসেন। (হাসর: ৯)। হাজতবাসকে আমি (হজরত ইউসুফ আ.) মন্দ কাজ অপেক্ষা ভালোবাসি (ইউসুফ: ৩৩)। ভালোবাসলেই হিদায়াত দেওয়া যায় না (কছছ: ৫৬)।
অবিশ্বাসী ও অকৃতজ্ঞদের ভালোবাসা
অকৃতজ্ঞ ও অবিশ্বাসীরা ঈমানের চেয়ে কুফরকে বেশি ভালোবাসে (তাওবা: ২৩)। অবিশ্বাসীরা দুনিয়াকে ভালোবাসে (আল ইমরান: ১৫২)। অকৃতজ্ঞরা দুনিয়ার জীবনকে ভালোবাসে (নাহল: ১০৭)। অবিশ্বাসীরা নগদকে ভালোবাসে (কিয়ামাত: ২০-২১; দাহর: ২৭)। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসার চেয়ে অন্য কিছুকে ভালোবাসা মুনাফিকদের স্বভাব (তাওবা: ২৪)। হিদায়াতের চেয়ে অন্ধত্বকে ভালোবাসে সংশয়বাদীরা (হামিম সাজদা: ১৭)। সম্পদকে ভালোবাসে বোকারা (ফাজর: ২০)। সম্পদের কঠিন ভালোবাসা নির্বোধদের কাজ (আদিয়াত: ৮)। তোমরা (অশান্তিকারীরা) কল্যাণকামীদের ভালোবাসো না। (আরাফ: ৭৯)। তারা (অহংকারীরা) কাজ না করেই প্রশংসা পেতে ভালোবাসে (আলে ইমরান: ১৮৮)। যারা অশ্লীলতা প্রকাশে ভালোবাসে, তারা বিপথগামী (নূর: ১৯)। কামনার ভালোবাসা পাপের কারণ (আলে ইমরান: ১৪)।
আল্লাহতায়ালা যা ভালোবাসেন না
আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না (বাকারা: ১৯০)। আল্লাহ অবিশ্বাসী পাপীদের ভালোবাসেন না (বাকারা: ২৭৬)। আল্লাহ অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিদের ভালোবাসেন না (আলে ইমরান: ৩২)। আল্লাহ জালিমদের ভালোবাসেন না (আল ইমরান: ৫৭ ও ১৪০; শুরা: ৪০)। আল্লাহ গর্বিত উত্ফুল্লকারীদের ভালোবাসেন না (কছছ: ৭৬)। আল্লাহ গর্বকারীদের ভালোবাসেন না (নিসা: ৩৬; লুকমান: ১৮; হাদীদ: ২৩)। আল্লাহ অহংকারীদের ভালোবাসেন না (নাহল: ২৩)। আল্লাহ অপব্যয়কারীদের ভালোবাসেন না (আনআম: ১৪১; আরাফ: ৩১)। আল্লাহ আমানতের খেয়ানতকারীদের ভালোবাসেন না (আনফাল: ৫৮)। আল্লাহ খেয়ানতকারী পাপীদের ভালোবাসেন না (নিসা: ১০৭)। আল্লাহ খেয়ানতকারী কাফেরদের ভালোবাসেন না (হাজ: ৩৮)। আল্লাহ কথায় (ভাষায়) মন্দ প্রকাশ করা ভালোবাসেন না (নিসা: ১৪৮)। আল্লাহ ফ্যাসাদ বিপর্যয় ভালোবাসেন না (বাকারা: ২০৫)। আল্লাহ ফ্যাসাদকারীদের (বিশৃঙ্খলাকারীদের) ভালোবাসেন না (মায়িদা: ৬৪; কছছ: ১২)। (কারও অগোচরে তার দোষ চর্চা কোরো না; পশ্চাতে নিন্দা করা আপন ভাইয়ের লাশের মাংস ভক্ষণ করার সমতুল্য। গিবতকারীরা বা পরনিন্দাকারীরা মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া ভালোবাসো কি? (হুজুরাত: ১২)
আল্লাহতায়ালা যাদের ভালোবাসেন
আল্লাহ সৎ কর্মশীলদের ভালোবাসেন (বাকারা: ১৯৫; আল ইমরান: ১৩৪ ও ১৪৮; মায়িদা: ১৩ ও ৯৩)। আল্লাহ পবিত্রদের ভালোবাসেন (তাওবা: ১০৮)। আল্লাহ তওবাকারী ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন (বাকারা: ২২২)। আল্লাহ মুত্তাকিদের ভালোবাসেন (আল ইমরান: ৭৬; তাওবা: ৪ ও ৭)। আল্লাহ ধৈর্যশীল ব্যক্তিদের ভালোবাসেন (আলে ইমরান: ১৪৬)। আল্লাহ (তাঁর ওপর) নির্ভরকারীদের ভালোবাসেন (আলে ইমরান: ১৫৯)। আল্লাহ ন্যায়নিষ্ঠদের ভালোবাসেন (মায়িদা: ৪২; হুজুরাত: ৯; মুমতাহিনা: ৮)। আল্লাহ মুজাহিদদের ভালোবাসেন (ছফ: ৪)। আমি (আল্লাহ) তার মাঝে ভালোবাসা দিয়েছি (তহা: ৩৯)।
প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য হলো আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার চেষ্টা করা। যেসব গুণাবলি অর্জন করলে মহান আল্লাহ খুশি ও সন্তুষ্ট হন সেসব গুণে নিজেকে সাজানো। কোরআন-হাদিস অনুসারে জীবন পরিচালনার পাশাপাশি উত্তম আচরণ, মানবকল্যাণে নিবেদিত হয়ে সমাজে ন্যায় ও সুবিচার প্রতিষ্ঠায় সুদৃঢ় হওয়া। বিপদে হতাশ না হয়ে ধৈর্য ধারণ এবং সহনশীলতার পরিচয় দেওয়া। সেই সঙ্গে কোনো পাপাচারে লিপ্ত হলে দ্রুত তওবা ইস্তেগফার করা, চোখ ও লজ্জাস্থানের হেফাজত করা, পরনিন্দা, ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকা। মানুষের প্রতি মন্দ ধারণা ও কুচিন্তা থেকে অন্তরকে মুক্ত রাখা। জীবনের যেকোনো পরিস্থিতিতে আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা। প্রকাশ্য ও গোপনীয় সব ধরনের পাপের কাজ আল্লাহর ভয়ে পরিত্যাগ করা। এ জাতীয় গুণে গুণান্বিত মানুষ আল্লাহর প্রিয় হয়। আল্লাহর প্রিয় হওয়া মানে তার সন্তুষ্টি অর্জন করা। এটাই তো মুমিন-মুসলমানের জীবনের পরম লক্ষ্য।
আল্লাহর প্রিয় হওয়ার জন্য শুধু মুখে মুখে আল্লাহকে ভালোবাসি বললে হবে না, কাজে-কর্মে, চলাফেরা, আচার-আচরণ ও চলাফেরায় তার প্রমাণ দিতে হবে। যাবতীয় চিন্তা, বিশ্বাস ও কাজের মাধ্যমে আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা হওয়া। আল্লাহর প্রিয় বান্দারা দুনিয়াতে চলাফেরায় নম্রতা, বিনয় ও নিরহংকারী হয়। কোনো প্রকার হীনমন্যতা, দুর্বলতা, জড়তা তাদের আড়ষ্ট করে না। আল্লাহর ভয়ে তাদের অন্তর বিনয়ী, নমনীয় ও সহনশীল হয়। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। আর জমিনে দম্ভভরে চলাফেরা করো না; নিশ্চয় আল্লাহ কোনো দাম্ভিক, অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (সুরা লোকমান, আয়াত ১৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রায়ই এই দোয়া করতেন: ‘হে আল্লাহ! আপনার ভালোবাসা চাই, আপনার ভালোবাসার জনের ভালোবাসা চাই; আর সে আমল করার তৌফিক চাই, যে আমল করলে আপনার ভালোবাসা লাভ করা যায়।’ (মুআত্তা ইমাম মালিক) নবী করিম (সা.) বলেন: ‘তোমাদের কেউ জান্নাতে যাবে না, যদি না সে ঈমান আনয়ন করে; আর ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ঈমানদার হবে না, যদি না তারা একে অন্যকে ভালোবাসে। আমি কি তোমাদের এমন একটি আমল শিখিয়ে দেব? যা করলে তোমাদের মাঝে প্রীতি ও ভালোবাসা জন্মাবে! (সে আমলটি হলো) তোমরা নিজেদের মাঝে সালামের প্রসার ঘটাও।’ (তিরমিজি শরিফ)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তোমাদের কেহ ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মোমিন হবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার সন্তান অপেক্ষা, তার পিতা অপেক্ষা এবং সব মানুষ অপেক্ষা বেশি প্রিয় (ভালোবাসার বস্তু) না হই।’ (বুখারি শরিফ)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন: ‘যে যাকে ভালোবাসে সে (পরকালে) তার সঙ্গে থাকবে (মুসলিম শরিফ)।’ হাদিসে আরও রয়েছে: ‘যে আমার সুন্নতকে ভালোবাসে সে অবশ্যই আমাকে ভালোবাসে, আর যে আমাকে ভালোবাসে সে জান্নাতে আমার সঙ্গেই থাকবে (নাসায়ি শরিফ)।’ নবীজি (সা.) বলেন: ‘সর্বোত্তম আমল হলো আল্লাহর জন্য ভালোবাসা।’ (আবু দাউদ শরিফ)
(ঢাকাটাইমস/১৬ডিসেম্বর/আরজেড)

মন্তব্য করুন