যে কবিকে বলা হতো কাফের সেই তিনিই লিখলেন "ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ"

সোহেল সানি
| আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৩, ১০:২৪ | প্রকাশিত : ১৮ এপ্রিল ২০২৩, ২৩:০৫

যে কবি বাংলা তথা ভারতীয় মুসলিম সমাজে মৌলভি-মওলানা কর্তৃক ধিকৃত ছিলেন "কাফের" বলে সেই কবিই কিনা ১৯৩১ সালে লিখলেন-‘ও মন রমজানের ঐ রোজা শেষে এলো খুশির ঈদ’ গানটি। পরবর্তীতে মুসলিম সমাজে যে গান আর পবিত্র ঈদ উৎসব এক ও অভিন্ন সত্তা হয়ে যায়।

পৃথিবীর নীল আকাশটায় চাঁদের উঁকিঝুঁকি মানেই ঘরে ঘরে বেজে উঠে গানটি। রমজান শেষে মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে আনন্দ নিয়ে হাজির হয় হিজরি শাওয়াল মাসের ১ তারিখ। যে দিন সমগ্র মুসলিম বিশ্ব মেতে ওঠে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরে। বাঙালিদের জন্য এই ঈদের একটাই মাত্র আগমনী গান। যার রচয়িতা বিদ্রোহী কবি খ্যাত আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশ কেবল নয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সঙ্গীত শিল্পী

রুনা লায়লার কন্ঠে গানটি যেন কন্ঠ আর সুরের মূর্ছনা ছড়ায়। সুরটি প্রথম তৎকালীন প্রখ্যাত শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের দরদমাখা কন্ঠে তুলে দিয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ঈদ এলেই একযোগে জনপ্রিয় শিল্পীদের কন্ঠেও শোনা যায় গানটি। দুনিয়ার বুকে থাকা প্রবাসী বাঙালি মুসলমানের কানেও বেজে ওঠে সুমধুর এ গানটি। গানটি ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে আকাশ -বাতাসকে করে অনুরণিত। আর আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে দেয় মুহূর্মুহূ আতশবাজির খেলা। নীল আকাশে যেন খেলা করে রঙধনুর আলপনা।

এই গানটি লেখার একটা চরম ইতিহাস রয়েছে। যা আমাদের অনেকেরই অজানা। সময়কাল ১৯৩১। ধর্মান্ধ সাধারণ মুসলিম সমাজে কাজী নজরুল ইসলাম ‘কাফের’ বলে ধিকৃত ছিলেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষিত মুসলমানরা তাঁকে ‘কাফের’ বলতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন না। আলেম ও মওলানাদের সুরে সুরে তারাও কবি নজরুলকে ‘ইসলামের শত্রু’ হিসাবে চিহ্নিত করতেন। মাত্র একুশ বছর বয়সে লেখা ‘বল বীর বল উন্নত নতশির...’ শীর্ষক ‘বিদ্রোহ’ কবিতাকেও খোদা বা আল্লাহবিরোধী উন্মাদনা হিসাবে দেখেছিল তদানীন্তন মুসলিম সমাজ। হিন্দু প্রমিলাকে বিয়ে করা এবং হিন্দুদের ভজন ও শ্যামা সংগীত লেখার কারণে কবির প্রতি মুসলিম সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল।

তখন সংগীত শিল্পীদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা একেবারে হাতেগোনা। সেই হাতেগোনাদের মধ্যে ছিলেন আব্বাস উদ্দীন। কবি নজরুল ইসলামকে ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা ‘কাফের’ ঘোষণা করায় দারুণ মর্মাহত ছিলেন তিনি। সুসম্পর্কের সুবাদে আব্বাসউদ্দীন কবির সঙ্গে দেখা করে বললেন-‘কাজী দা- আপনি অন্তত দুটি ইসলামিক গানের রচয়িতা হোন। আমি গেয়ে দেবো সে গান। আর সে গান নিশ্চয়ই মুসলিম সমাজে সৃষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাবে। ’ কবির মন সায় দিলো। তবে একটা শর্ত জুড়ে দিয়ে বললেন - ‘ঠিক আছে আমি লিখবো ইসলামিক গান, তবে তুমি যদি ভগবতী ভট্টাচার্যকে সম্মত করাতে পারো। ’

অর্থাৎ কলকাতার এইচএমভি রেকর্ডিংয়ের মালিক শ্রী ভট্টাচার্যকে সম্মত করাতে হবে। ভট্টাচার্য বাবু শিল্পবোদ্ধা হিসেবে উদার চিত্তের মানুষ ছিলেন। কিন্তু কলকাতার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ বিষয়টি কীভাবে নেবে সে দিকটায় চিন্তামুক্ত হতে পারছিলেন না। শ্যামা সংগীত ও ভজনের তখন রমরমা বাজার। বিপুল জনপ্রিয়। মুসলিম সমাজে সংগীত তখনো নিষিদ্ধ আর ইসলামে তো একেবারেই হারাম। কোচবিহারের উদীয়মান ও জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের পীড়াপীড়িতে ভগবতী ভট্টাচার্য বললেন, ‘এমন ঝুঁকি কী করে নেওয়া যায়? পুঁজোয় ধুমছে গান রেকর্ড বিক্রি হয়ে যায়, কিন্তু ঈদের সময় ইসলামিক কোনো গান যে বিক্রি হবে না এটা নিশ্চিত। কারণ মুসলমানরা পয়সাকড়ি পাবে কোথায়?’

এসব বলে ভট্টাচার্য উপেক্ষা করতে চাইলেও আব্বাসউদ্দীন আশা ছাড়লেন না এবং শেষ পর্যন্ত সম্মত করতে সমর্থ হলেন। এরপর খুশির খবরটি দিলেন কবি নজরুল ইসলামের মুখোমুখি হয়ে। এক বসায় কবি লিখে ফেললেন ‘ও রমজানের ঐ রোজা শেষে এলো খুশির ঈদ’ শীর্ষক গানটি। কবি স্বকণ্ঠে সুর তুলে দিলেন আব্বাসউদ্দীনের কন্ঠে। আব্বাসউদ্দীনের পুত্র শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী এ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। আব্বাসউদ্দীন নিজের স্মৃতিকথায়ও লিখে গেছেন এ গানটি কীভাবে কোন পরিস্থিতিতে কবিকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন। আব্বাসউদ্দীনকে গানটি লেখা শুরু করার আগেই কবি বলেছিলেন চা ও পান নিয়ে আসতে। চা পান করার পর মুখে পান চিবুতে চিবুতে গানটি লিখে ফেলেন। কবিকে দিয়ে সুরও করিয়ে নিলেন আব্বাসউদ্দীন। তারপর গাইলেন। রেকর্ড করা হলো। এরপর সে কী অবস্থা কলকাতার অলিগলিতে বাজতে থাকলো গানটি। মন্ত্রমুগ্ধের মতো মুসলমানরাও শুনলো।

কবি নজরুলকে ইসলামিক গান লিখতে এবার খোদ উৎসাহিত করলেন এইচএমভি রেকর্ডিং এর মালিক। ইসলামিক গান গাওয়ার মুসলমান শিল্পী কই? তাইতো হিন্দু শিল্পীরা মুসলমান নামে গান গাইতেন। যেমন গণি মিয়া নামে ধীরেন দাস, দেলোয়ার হোসেন নামে চিত্ত রায়, আমিনা বেগম নামে আশ্চর্যময়ী দাসী, সোনা মিয়া নামে গিরীন চক্রবর্তী প্রমুখ ইসলামিক গান গিয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। আর এভাবেই কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামিক গানের যাত্রা। একদিন যে মুসলিম সমাজ তাঁকে ‘কাফের’ বলতো, ইতিহাসের কী অদ্ভুত ফলশ্রুতি সেই মুসলিম সমাজই আজ কবি নজরুলকে ইসলামিক কবি হিসাবে আখ্যায়িত করছে। কাজী নজরুল ইসলাম প্রকৃতপক্ষে অসাম্প্রদায়িক কবি। মানবতার কবি। সাম্যের কবি।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :