বিবাহবিচ্ছেদ কেন বাড়ছে! প্রতিকার কী?

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম
| আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ১৭:০৪ | প্রকাশিত : ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ১৬:৪৯

বিবাহবিচ্ছেদের হার শিক্ষিতদের মধ্যে অনেক বেশি। কিন্তু সাধারণত কম শিক্ষিত বা অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে তা কম। একটি জরিপ দেখায় যে, ২০১০ থেকে ২০২১ পর্যন্ত রাজধানীতে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা প্রায় ৭৫০০০ এবং প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০টি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ে।

বাংলাদেশ বিশ্বের এমন একটি দেশ যেখানে পারিবারিক বন্ধন ও সুখ-দুঃখ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দাম্পত্য জীবন টিকিয়ে রাখার সংস্কৃতি আমাদের দেশে বহুকাল ধরে চলে আসছে। আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য পারিবারিক বন্ধনকে শক্তিশালী করার দিকে মনোনিবেশ করে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমরা আমাদের দেশে বিবাহিত জীবন চালিয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি থেকে ধীরে ধীরে দূরে চলে যাচ্ছি। বর্তমানে প্রায়ই বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে যা আমাদের সংস্কৃতির সাথে সত্যিই বেমানান। মুসলিম আইনের অধীনে বিবাহ একটি নাগরিক চুক্তি এবং এই চুক্তির মাধ্যমে দম্পতি একটি সুন্দর সংসার করার শপথ নেয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো রক্তের বন্ধন নেই, তবুও তাদের পারস্পরিক আস্থা, ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা সারাজীবন একটি সুন্দর সংসার করতে অনুপ্রাণিত করে। বিবাহ একটি পবিত্র বন্ধন যা স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক বিশ্বাসের ওপর স্থায়ী হয়। খুব নির্দিষ্ট কারণে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তবে তা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, এমনকি কোরআনেও। বিবাহবিচ্ছেদ কখনোই কাম্য হতে পারে না কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটা এখন আমাদের শহর ও গ্রামাঞ্চলে ঘটছে। আমাদের দেশে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন এবং ১৯৭৪ সালের বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ নিবন্ধন আইন অনুসারে, জরুরি প্রয়োজনে বিবাহবিচ্ছেদ করা যেতে পারে তবে এটি এখন আমাদের দেশে একটি ফ্যাশন বলে মনে হচ্ছে। বিগত কয়েক বছর ধরে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং সামান্য ঝগড়ার কারণে দাম্পত্য জীবন নষ্ট হচ্ছে। শুধুমাত্র ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনের সংখ্যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২ সালের প্রথম ১৯০ দিনে ৪৭০০টি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে। প্রতি ১ ঘণ্টায় সিটি করপোরেশনে একটি পরিবার ভাঙার আবেদন জমা পড়ছে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরে বিবাহবিচ্ছেদের হার বেশি। বিবাহবিচ্ছেদের আবেদনের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে নারীদের কাছ থেকে এবং ৩০ শতাংশ পুরুষদের কাছ থেকে। বিবাহবিচ্ছেদের হার শিক্ষিতদের মধ্যে অনেক বেশি এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে কম। একটি জরিপ দেখায় যে, ২০১০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত রাজধানীতে বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা প্রায় ৭৫০০০ এবং প্রতিদিন ৫৫ থেকে ৬৫টি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়ে। ২২ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখের একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুসারে, জুলাই থেকে অক্টোবর ২০২২ পর্যন্ত মাত্র পাঁচ মাসে বিবাহবিচ্ছেদের হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে প্রতিদিন ৪৪টি তালাক হয়েছে, অর্থাৎ প্রতি ৪৫ মিনিটে একটি তালাক। কর্মজীবী স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি। চলতি বছরের পাঁচ মাসে ঢাকায় ৫৯৭০টি তালাক হয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে ১২০৫টি তালাক হয়। গত বছর গড়ে প্রতি মাসে ৯২০টি বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছে ২৯.৭৮ শতাংশ। ২০২২ সালে বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা ২০২১ সালের তুলনায় ১৮ শতাংশ বেড়েছে। এ বছর চট্টগ্রামে ৪৮৭৫টি বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। চলতি বছরের ১০ মাসে সিলেটে তালাকের আবেদন জমা পড়েছে ২ হাজার ৩৩৬টি।

বিবাহবিচ্ছেদের কারণগুলো

আইনের ছাত্র হিসেবে এবং পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে গিয়ে অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা কারণগুলো তুলে ধরছি। যেমন- ১) শারীরিক অক্ষমতা, যৌন ব্যাধি, যৌনবিকারগ্রস্ত স্বামী বিবাহবিচ্ছেদের একটি অন্যতম কারণ, এটি লজ্জা কিংবা গোপন করার বিষয় নয়। ২) যৌতুক আমাদের দেশের জন্য এক সামাজিক ব্যাধি। যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮ অনুসারে বরপক্ষ বা কনেপক্ষ যেকোনো পক্ষের নিকট যৌতুক দাবিই অপরাধ হিসেবে গণ্য। যৌতুকের জন্য স্বামী, স্বামীর পরিবারের সদস্যদের অত্যাচার-নিপীড়ন, নির্যাতনের শিকার হয় নারী, কখনো মৃত্যুর মাধ্যমেও যৌতুকের বলি হতে হয় তাকে। যৌতুক দাবি কিংবা নির্যাতনের কোনো বয়স বা সময় নেই। ৩৫ বছরের সংসারও ছেড়ে আসতে দেখা যায় নারীকে বিয়ে বিচ্ছেদের মাধ্যমে। ৩) বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭ অনুসারে ১৮ বছরের মেয়ে, ২১ বছরের ছেলের বিয়েকে বাল্যবিয়ে হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। গত দু বছরে করোনার সময়ে বাল্যবিবাহ বেড়েছে ভয়াবহভাবে। স্কুল বন্ধ, বাবা-মা ১৮ বছর উঠতি বয়সী মেয়েকে দিয়েছেন বিয়ে, অনেকটা ঝঞ্ঝাটমুক্ত হওয়ার জন্য।

যে বিষয়গুলো তালাককে ত্বরান্বিত করতে পারে। যেমন- ১. আজকের যান্ত্রিক সভ্যতায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব বিবাহবিচ্ছেদকে ত্বরান্বিত করে। ২. স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, বিশ্বাস এবং ভালোবাসা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে যা বিবাহবিচ্ছেদের কারণ। ৩. দাম্পত্য জীবনে সহনশীলতার অভাব তীব্র আকার ধারণ করছে। ৪. খারাপ মেজাজ, সন্দেহ, আত্ম-অহং, উদাসীনতা, অধৈর্যতা পরিবার ভেঙে যাওয়ার কারণ। ৫. টিভি সিরিয়াল, ফেসবুক, সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাব পরিবার ভাঙার কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। ৬. বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, মাদক গ্রহণ এবং রোমান্সও বিবাহবিচ্ছেদের কারণ। ৭. অন্য মহিলাদের প্রতি স্বামীর আসক্তি বিবাহবিচ্ছেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। ৮. নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ভুলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়া। ৯. স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আধিপত্যপূর্ণ মনোভাব। ১০. যৌথ পরিবার ভেঙে যাওয়া এবং বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করা। ১১. অফিস/কর্মস্থলে খুব ব্যস্ত থাকা এবং পরিবারকে সময় না দেওয়া। ১২. কর্মজীবী মহিলারা পরিবারে বেশি সময় দিতে পারেন না যা অনেকেই বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হিসেবে দেখেন। ১৩. দাম্পত্য জীবনের ছোটখাটো ভুল মেনে নেওয়ার প্রবণতা না থাকা। ১৪. ক্রমাগত দাম্পত্য জীবন নিয়ে সামাজিক চাপ ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে এবং এটি বিবাহবিচ্ছেদের একটি কারণ। ১৫. স্ত্রীকে যথাযথ ভরণ-পোষণ না দেওয়া। ১৬. যৌতুকের জন্য স্ত্রীকে নির্যাতন। ১৭. মাদকাসক্তি, পুরুষত্বহীনতা এবং বন্ধ্যাত্ব। বিবাহবিচ্ছেদের কারণ যাই হোক না কেন, তালাকের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এই বিবাহবিচ্ছেদ শিশুদের জীবনকে ধ্বংস করে দেয়। বিবাহবিচ্ছেদের এই সংস্কৃতি একদিকে যেমন পারিবারিক শৃঙ্খলা নষ্ট করে অন্যদিকে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে। বিবাহবিচ্ছেদ নারীদেরও অনেক কষ্ট দেয় এবং তারা সমাজের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়। নারীরা তাদের দ্বিতীয় বিয়ের সময় অনেক সমস্যার সম্মুখীন হন এবং এর ফলে অনেক নারী তাদের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। আমাদের সমাজে এখনো বিবাহবিচ্ছেদের জন্য নারীদের দায়ী করা হয়।

নারীদের বিবাহবিচ্ছেদের চারটি কারণ চিহ্নিত করেছে জাতীয় মহিলা পরিষদ- ১. যৌতুক। ২. বিবাহের বাইরে অবৈধ সম্পর্ক। ৩. মানসিক নির্যাতন। ৪. শারীরিক নির্যাতন। দাম্পত্য জীবনে ছোটখাটো ভুল ধারণা থাকতে পারে, কিন্তু তার ভিত্তিতে সংসার ভেঙে যাওয়া কখনোই কাম্য হতে পারে না। বিবাহ একটি পবিত্র বন্ধন এবং এটিকে মূল্য দিতে শিখতে হবে। ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক ও আইনগতভাবে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি দেওয়া হলেও সভ্য সমাজে বিবাহবিচ্ছেদের সংস্কৃতি চালু রাখা উচিত নয়। দাম্পত্য জীবন টিকিয়ে রাখার জন্য স্বামী-স্ত্রীর সদিচ্ছাই যথেষ্ট। বিবাহবিচ্ছেদ একটি অসম্মানের বিষয় যা পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে একটি পবিত্র বন্ধন সম্পূর্ণরূপে অসম্মানিত হয়। তালাকপ্রাপ্ত স্বামী-স্ত্রীকে সমাজে অবজ্ঞার চোখে দেখা হয় এবং গর্ব করে কারো কাছে মুখ দেখাতে পারে না। তাই বিবাহবিচ্ছেদ এড়াতে স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই চেষ্টা করা দরকার।

তালাকের মতো খারাপ কাজ এড়াতে যা করতে পারেন: ১. ধর্মীয় নির্দেশ মেনে চলা। ২. স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েরই পরিবারের কাজ ভাগ করে নেওয়া উচিত এবং একে অপরের কাজের প্রশংসা করা উচিত। ৩. স্বামী এবং স্ত্রীর একে অপরের সমালোচনা করা উচিত নয় এবং কিছু ভুল হলে তাদের ক্ষমা করার মানসিকতা থাকা উচিত। ৪. তাদের তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তর্ক করা উচিত নয় এবং সামান্য ভুল বোঝাবুঝি হলেও নিজেকে সংযত করার জন্য ধৈর্য ধরতে হবে। সঙ্গীকে সময় দেওয়া এবং মিষ্টি করে কথা বলা স্বামীর কর্তব্য। উভয়েরই তাদের রাগ এবং বদমেজাজ নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বর্তমানে প্রায় সবাইকে এক ধরনের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। এতে মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতাও বেড়েছে। মনস্তাত্ত্বিক চাপ দাম্পত্য কলহকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। পারিবারিক কলহের কারণে বিবাহবিচ্ছেদ বাড়ছে। অতীতে মহিলারা বিবাহবিচ্ছেদ করতে চাননি, কারণ তাদের পরিবার তাদের আশ্রয় দিতে চায় না। ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ, সামাজিক অনুশাসন এবং সমাজের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের ইতিবাচক হস্তক্ষেপই বিবাহবিচ্ছেদ রোধ করতে পারে। পারিপার্শ্বিক চাপকে দাম্পত্য জীবনে চালিয়ে যেতে হবে। বিবাহবিচ্ছেদের বিরুদ্ধে এক ধরনের সামাজিক চাপ সৃষ্টি করা অপরিহার্য। বাপের বাড়িতে আশ্রয় কম থাকলে নারীরা তালাক চাইবে না। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের আত্মত্যাগের ওপর দাম্পত্য জীবন টিকে থাকে। যে দম্পতি ত্যাগ করতে শিখবে তারা সুন্দর জীবন উপভোগ করতে পারবে।

লেখক: মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম, কলামিস্ট ও আইনি গবেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :