যুগপৎ আন্দোলন ও ব্যর্থতার রাজনীতি

মো. সাখাওয়াত হোসেন
 | প্রকাশিত : ০১ মে ২০২৩, ০৮:৪৯

যুগপৎ আন্দোলনের মানে হচ্ছে, সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে যখন একটি গ্রুপ নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী আন্দোলন করে দাবি আদায়ে অনেক সময় সফল হয়, আবার ব্যর্থও হতে পারে। তবে তাদের লক্ষ্য থাকে এক ও অভিন্ন এবং উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের জন্য তারা কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করে থাকেন। যুগপৎ আন্দোলন মূলত এমন হয়েই থাকে এবং সেক্ষেত্রে যারা আন্দোলনের জন্য রাস্তায় দাঁড়ায় তাদের মধ্যকার এক ধরনের মেলবন্ধন গ্রোথিত হয়ে আন্দোলনে নতুন মোড় সৃষ্টি করে। তবে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আপনি যতই জোট মহাজোট গঠন করেন না কেন, আপনি ঘোষিত কোন আন্দোলনই প্রকাশ্যে আলোচনায় আসবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে উঠবে না।

যুগপৎ আন্দোলন অনেক ক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলনে রূপ পরিগ্রহ করে থাকে। যদি যুগপৎ আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয় ও সামাজিক ভিত মজবুত হয়। সামাজিক ভিত তখনই মজবুত হবে যখন দেখা যাবে সামাজিক মানুষের দীর্ঘদিনের চাহিদা প্রত্যাশা আন্দোলনের মাধ্যমে ফলপ্রসূ আকারে বাস্তবায়নের আকাঙ্খা ছকের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা বপিত হয়। কিন্তু আন্দোলনের আহবান যদি নিখাদ ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে করা হয় তাহলে সেখানে সাধারণ জনতার সাড়া দেওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দেখা যাচ্ছে বিএনপি সহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে মিডিয়াতে কর্মসূচি দিচ্ছে। কিন্তু কেন জানি বিষয়গুলো জমে উঠছে না? অবশ্য একটি গোষ্ঠী সবসময় পুলিশের পক্ষ থেকে বাঁধা বিপত্তির বিষয় সামনে নিয়ে আসে। কেন এর আগে যখন রাজনৈতিক দল আন্দোলন সংগ্রাম যেত সেখানে কি পুলিশ বাঁধা প্রদান করেনি। পুলিশের যুক্তি রয়েছে এমন: পাবলিক নুইসেন্স এর প্রকোপ হতে জনসাধারণকে নিরাপদ রাখতে পুলিশ সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। সব সরকারের আমলেই এ ধরনের ঘটনা যে ঘটে না, তা এ দেশের রাজনীতির পটভূমিতে বলা যাবে না। এটা মেনে নিয়েই আপনাকে রাজনীতি করতে হবে, রাজনীতির মাঠে কৌশলী ভূমিকা অবলম্বন করে চলতে হয়।

একতরফাভাবে পুলিশকে সামনে নিয়ে এসে নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। এমনটি যতদিন ঘটবে ততদিন এখন যারা আন্দোলনের ডাক দিচ্ছে তাদের আন্দোলন সাড়া পাবে না। প্রকৃতঅর্থে নিজের ঘরে লুকিয়ে থাকা সমস্যাকে চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংক যখন ঋণ প্রদান বন্ধে ঘোষনা প্রদান করে তখন এ পক্ষটি আনন্দে আত্নহারা হয়ে উঠে। তাদের মধ্যে সরকারের বেকায়দায় ফেলার মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে এ ব্যাপারটিকে দাঁড় করাতে এক ধরনের অসম প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। দেশের মানুষের মধ্যে এ বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তাদের অব্যাহত প্রচেষ্টা বিভিন্নভাবে লক্ষ্য করা গিয়েছে। কিন্তু যখন বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হল, পদ্মা সেতুতে কোন দুর্নীতি হয়নি, কানাডার আদালতে এ মর্মে রায় ঘোষণা করা হল, পরবর্তীতে তারা হোঁচট খেল এবং নিজেদের মত যুক্তি দাঁড় করিয়ে পদ্মা সেতুতে সরকার ব্যাপক দুর্নীতি করেছে এ বিষয়টি জনগণের মধ্যে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু জনগণ তাদেরকে প্রত্যাখান করল এবং পদ্মা সেতু নিয়ে মানুষের ব্যাপক আগ্রহের কারণে এ সংক্রান্তে সবচেয়ে বেশি সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে দেশী বিদেশী গণমাধ্যমে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরবর্তী সময়ে সমগ্র বিশ্ব যেখানে বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ সেখানেও এ পক্ষটির বিমাতাসুলভ পক্ষপাতিত্ব সাধারণ জনগণকে হতাশ করেছে।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, যুগপৎ আন্দোলনে দলগুলো কার্যকরভাবে ব্যর্থ হচ্ছে কিংবা আন্দোলনে যাওয়ার মতো যুগোপযোগী কোন ইস্যু জনগণের সামনে দাঁড় করাতে ব্যর্থ হচ্ছে। সে কারণেই দলগুলো জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, জনবান্ধব কর্মসূচি প্রদান না করায় দেশের জনগণের কাছ থেকে ক্রমশ আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে তারা বিদেশী বন্ধুদের উপর নির্ভর করে তাদের দাবি দাওয়াকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যে বিদেশী বন্ধুদের দ্বারস্থ হচ্ছে তাদের অনেকের দেশের অভ্যন্তরীন অবস্থা তেমন উল্লেখযোগ্য নয় তবুও তাদের ধরণা দিতে হচ্ছে যুপপৎ আন্দোলনে যাওয়া কতিপয় রাজনৈতিক দলগুলোর। বাংলাদেশের জনগণ এ ব্যাপারগুলোতে মারত্নকভাবে মনোক্ষুন্ন হয় এবং তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে এ রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের সঙ্গে একীভূত হয়ে জনগণকেন্দ্রিক ভাবনা চিন্তা থেকে ক্রমাগত সরে গিয়ে বিদেশনির্ভর নীতিতে অগ্রসর হচ্ছে যা কোনভাবেই দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

যে রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে, সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের কাছে বার্তা নিয়ে যাচ্ছে; মোটামুটিভাবে বেশ কিছু কারণে দলগুলোর আন্দোলন আলোর মুখ দেখছে না। প্রকৃতঅর্থে আন্দোলনে অংশ নেয়া দলগুলো এ ব্যাপারে ততটা ওয়াকিবহাল না, যদি হতো তাহলে ধীরে লয়ে গতিতে সার্বিক দিক বিবেচনায় গ্রহণ করে দলগুলো সামনের দিকে অগ্রসর হতো।

প্রথমত: বিএনপি ব্যতীত অন্য দলগুলোর উল্লেখযোগ্য কোন জনসমর্থন দেশব্যাপী নাই। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, সারা দেশে অনেকের কমিটি নেই এমনকি জেলা পর্যায়ে দলীয় কার্যালয়ও নেই।

দ্বিতীয়ত: বিএনপির সকল পর্যায়ের নেতা, কর্মী ও সমর্থকেরা আন্দোলনে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকছে। দলের প্রতি দীর্ঘদিনের ক্ষোভ থেকেই দলীয় নেতাকর্মীরা এ ধরনের অযাথিত কাজকর্ম করে যাচ্ছে।

তৃতীয়ত: যুগপৎ আন্দোলনে ঘোষিত কর্মসূচি জনসাধারণের মননে প্রভাব ফেলতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ বিষয়টি দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদেরও মধ্যে ব্যাপকভাবে গাঢ় হচ্ছে।

চতুর্থত: আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্বদের দক্ষতা ও যোগ্যতা এবং সততা নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ ও দ্বিধা রয়েছে।

পঞ্চমত: বিদেশী বন্ধুদের উপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা যুগপৎ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর জন্য শাপেবর হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীরা এ ব্যাপারে চরম নাখোশ এবং শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধের অন্যতম হোতাও এটি।

শেষত: সাধারণ জনগণ থেকে তাদের দীর্ঘদিনের দূরত্ব আন্দোলনের ক্ষেত্রে সবসময় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাদের সমর্থনকারী অনেকেই আন্দোলনের কার্যক্রম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সাধারণ জনগণ মনে করছে আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে স্বাভাবিক পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করার পায়তারা থেকেই যুগপৎ আন্দোলনের নামে কার্যত ব্যর্থতার রাজনীতি একে অপরের পৃষ্ঠপোষক ও পরিপূরক হয়ে উঠছে। তাদের উচিত হচ্ছে কোন কর্মসূচি ঘোষণা করার পূর্বে রাজনীতির মাঠে ব্যাপকভাবে জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে মাঠের রাজনীতিতে সময় প্রদান করা, জনগণের সঙ্গে মিশে জনগণের ভাষা বোঝার চেষ্টা করা। জনগণের ভাষা বুঝতে পারলে রাজনীতির মাঠে আন্দোলন করা সহজতর হয়ে থাকে, জনগণকে সাথে নিয়ে যে কোন আন্দোলনে সফলতা পরিস্কারভাবে আনয়ন করা সম্ভব। অন্যদিকে জনগণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ব্যতীত এ দেশে রাজনীতিতে কোন আন্দোলন আলোর মুখ দেখেনি। এ বোধটি যুগপৎ আন্দোলনে যারা জড়িত তাদের মধ্যে সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত, না হলে ধাপে ধাপে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েই যাচ্ছে। সবিশেষ তাদের উচিত হবে জনগণের সঙ্গে একীভূত হয়ে জনগণের ইচ্ছাকে বিবেচনায় নিয়ে রাজপথের আন্দোলন ঘোষণা করা।

মো. সাখাওয়াত হোসেন, চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :