ধূমপানে ফুসফুসে ক্যানসার, জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ৩১ মে ২০২৩, ১৩:৪৬ | প্রকাশিত : ৩১ মে ২০২৩, ১০:৫৪

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯১৪-১৮ সালে মানুষ ধূমপানের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি ধূমপানের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তুঙ্গে ওঠে। মহিলারা ধূমপান শুরু করে ১৯৩৯-১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে। ক্রমে ধূমপান নেশায় পরিণত হয়। কিন্তু মানুষ জানত না ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে। এই ধূমপান বা তামাকের ব্যবহারের কারণে মৃত্যুমুখী হচ্ছে পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ- এটা মানুষের জানা ছিল না। ধূমপান ও তামাকের কারণে বছরে দেশে দেড় লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। শুধু তাই নয়, ধূমপানের কারণে অধূমপায়ীদের হৃদরোগের ঝুঁকি ২৫-৩০ শতাংশ বেড়ে যাচ্ছে। ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকিও শতকরা ২০ থেকে ৩০ ভাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে ধূমপান।

তামাক গাছ বামন জাতের স্বল্পজীবী উদ্ভিদ। পরিপূর্ণ তামাক গাছের পাতাকে বিশেষভাবে শুকিয়ে সেই পাতাকে উদ্দীপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তামাক পাতা দিয়ে সিগারেট, বিড়ি, চুরুট, জর্দা, গুল, নস্যি ও অন্যান্য উদ্দীপক দ্রব্য তৈরি করা হয়। তামাক মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তামাক ব্যবহারে স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হয়। এটি ক্যানসার ও হৃদরোগসহ নানা ধরনের কঠিন রোগ সৃষ্টি করে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।

ধূমপান একটি ঘাতকের নাম। এটি শুধু ব্যক্তিগত বদ অভ্যাসই নয়, সত্যিকারের অর্থে একটি সামাজিক ব্যাধি। ধূমপানে ব্যবহৃত সিগারেট কেবল নিজে জ্বলে না, অন্যদেরও জ্বালায়। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, একটি জ্বলন্ত সিগারেট থেকে প্রায় ১২ হাজার বিভিন্ন ধরনের রসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়, যার কোনোটিই আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নয়। বরং সবই ক্ষতিকর। তামাক পাতায় থাকে নিকোটিন, টার, ক্যাডমিয়াম, জৈব অ্যাসিড ও নাইট্রোজেন জাতীয় পদার্থ। এছাড়া সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকে মরণ বিষ কার্বন মনোক্সাইড ও ক্যানসার উদ্রেককারী নানারকম কার্সিনোজেন। যেমন-বেনজোপাইরিন, ডাইমিথাইল নাইট্রোসোমাইন, ডাই ইথাইন নাইট্রোসোমাইন, এন নাইট্রোসোনর নিকোটিন, নাইট্রোসোপাইরেলেডিন, কুইনলোন প্রভৃতি।

একখন্ড পরিচ্ছন্ন কাগজে মোড়ানো সিগারেট আকর্ষণীয় হলেও আসলে তা উগ্র নিকোটিনের বিষে ভরা। নিকোটিন এত মারাত্মক যে, দুটো সিগারেটে যে পরিমাণ নিকোটিন আছে, তা ইঞ্জেকশন দ্বারা কোনো সুস্থ মানুষের শরীরে প্রবেশ করালে তার মৃত্যু অনিবার্য।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে কেউ ধূমপান করছেন না, তা-ও আপনার ক্ষতি হতে পারে! কী করে? যারা ধূমপান করেন না, তারাও যে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক থেকে রেহাই পাচ্ছেন, এমনটা কিন্তু নয়। অন্তঃসত্ত্বা ও খুদেদের জন্য নিতে হবে বাড়তি সতর্কতা।

যারা পরোক্ষভাবে ধূমপান করেন, তাদের ক্ষতি কতটা— সেটি অনেকেরই অজানা। যারা ধূমপান করেন না, তারাও যে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক থেকে রেহাই পাচ্ছেন, এমনটা কিন্তু নয়। বিভিন্ন গবেষণা জানা গিয়েছে পরোক্ষ ধূমপান এবং সরাসরি ধূমপানে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সমান। এরই মধ্যে হালে উঠে এসেছে আরও একটি বিষয়— তৃতীয় স্তরের ধূমপান বা ‘থার্ড হ্যান্ড স্মোকিং’। এই ধূমপানে ক্ষতির পরিমাণ নাকি পরোক্ষ ধূমপানের চেয়েও বেশি।

বদ্ধ ঘর বা গাড়ির মধ্যে ধূমপান করলে, সেই বাতাসে মিশে যায় ধূমপানের ফলে তৈরি হওয়া নানা রাসায়নিক। যা বাতাসে ভেসে থাকা ধূলিকণা, দূষিত পদার্থের সঙ্গে বিক্রিয়া করে আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। ধরুন, কেউ ঘরে বসে ধূমপান করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। সেই ঘরে পরবর্তী সময়ে অন্য কেউ ঢুকলে, তিনি হয়তো খালি চোখে ধোঁয়া দেখতে পান না, কিন্তু ধূমপানের ফলে তৈরি হওয়া ক্ষতিকারক রাসায়নিক তাঁর শরীরে ঢুকতে থাকে। ঘরের দেওয়াল, কার্পেট, সোফা, মেঝে, আসবাবপত্রের উপর নিকোটিনের আস্তরণ তৈরি হয়। বাতাসে অন্যান্য দূষিত কণার সঙ্গে মিশে গিয়ে সেই নিকোটিনের আস্তরণ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে শরীরের উপর। একেই বলা হচ্ছে তৃতীয় স্তরের ধূমপান।

পরোক্ষ ধূমপানের সময়ে নিজে ধূমপান না করলেও অন্যের ধূমপানের ধোঁয়া মানুষের শরীরে ঢোকে। ধূমপায়ীর যা যা ক্ষতি হয়, পরোক্ষ ধূমপানেও তার সমপরিমাণ ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু তৃতীয় স্তরের ধূমপানে ক্ষতি বেশি হতে পারে। এমনই আশঙ্কার কথা বলছেন বিজ্ঞানীরা। কারণ ধূমপানের ধোঁয়ার চাইতে বিক্রিয়ার ফলে তৈরি হওয়া ভাসমান কণাগুলো আরও ক্ষতিকারক বলে বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা। তৃতীয় স্তরের ধূমপান ক্যানসার, হৃদ্‌রোগের মতো অসুখের আশঙ্কা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়।

চিকিৎসকদের পরামর্শ, বাড়িতে শিশু, অন্তঃসত্ত্বা মহিলা বা ধূমপায়ী নন এমন সদস্য থাকলে, যে সব ঘরে তাদের যাতায়াত, সেখানে ধূমপান করবেন না। খোলা জায়গায় ধূমপান করুন। তাদের বিপদের আশঙ্কা আরও বেশি। হাঁপানি, কানের সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্টের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

যখন কেউ এসি ঘরে ধূমপান করছেন, ঘরের অন্যান্য লোকেরা দ্বিতীয় হাতের ধোঁয়াতে আক্রান্ত হন। ধোঁয়ায় থাকা রাসায়নিক যৌগগুলো ফুসফুসের ক্যানসার এবং অন্যান্য রোগের কারণ হতে পারে। সেই হিসাবে, এসি ঘরে ধূমপান নিষিদ্ধ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

এসি কোনও ঘরে দৃশ্যমান ধোঁয়া অপসারণ করতে পারে তবে সিগারেটের ধোঁয়া থেকে এটি বেশিরভাগ ক্ষতিকারক কণাকে ফিল্টার করতে সক্ষম হয় না। এই কণা বা রাসায়নিকগুলো শ্বাসকষ্টের সময় আমাদের দেহের ক্ষতি করে কক্ষটি আবদ্ধ থাকায় ধূমপায়ী ঘরের মধ্যে আরও ধূমপান ছড়িয়ে দেওয়ার সাথে সাথে এই ক্ষতিকারক রাসায়নিক বা কণাগুলির ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। এর অর্থ ঘরের অভ্যন্তরের লোকেরা আরও বেশি করে রাসায়নিক এবং কণাগুলি নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ক্ষতিকারক রাসায়নিক এবং কণার পাশাপাশি সিগারেটের ধোঁয়া থেকে আসা গন্ধগুলো আপনার আসবাব, কার্পেট, দেয়াল ইত্যাদির পৃষ্ঠের বাইরেও প্রবেশ করবে। গন্ধটি সহজেই মুছে যাবে না। ফলে মাথা-ব্যাথা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ঠাণ্ডা এবং এলার্জি জনিত রোগ হতে পারে।

অন্যদিকে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের বেশিরভাগই ধূমপান দিয়ে পরে নেশায় জড়িয়েছে। একজন ধুমপায়ীর সাধারণত একাধিক ধূমপায়ী বন্ধু থাকে। এভাবেই একজনের প্রভাবে অন্য বন্ধুরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। একবার যখন কেউ কোনও মাদক গ্রহণ করে, তখন সে একটির পর অন্য একটি মাদক গ্রহণ করে। দেশের সব বড় বড় শহর, বাজার, স্কুল-কলেজের আশপাশের মতো ব্যস্ত এলাকায় বা জনসম্মুখে বেপরোয়া ধূমপায়ীরা।

গণপরিবহন, পার্ক, সরকারি-বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, রেস্তোরাঁ, শপিং মল, পাবলিক টয়লেটসহ বিভিন্ন জনসমাগমস্থলে হরহামেশায় ধুমপান করতে দেখা যায় বিভিন্ন বয়সীদের। অথচ, জনসমাগমস্থলে ধূমপান বন্ধে ২০০৫ সালে একটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। কিন্তু সে আইন মানা হচ্ছে না?

ধুমপান বন্ধে ২০০৫ সালে প্রণিত আইন অনুযায়ী, প্রকাশ্যে ধুমপানের জরিমানা ধরা হয়েছিল ৫০টাকা। কিন্তু পরে ২০১৩ সালে ধুমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের সংশোধনী এনে জনসমাগমস্থলে ধুমপানের শাস্তির অর্থ ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয়। কিন্তু আইন না জানা ও ভাঙায় অভ্যস্ত লোকজনের অবস্থা তাতে বদলায়নি এতটুকু।

গবেষণার দেখা, যায় ৩০ ও তদূর্ধ্ব ব্যাক্তিদের মধ্যে তামাকজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। তামাকসেবীদের মধ্যে হৃদরোগ, স্ট্রোক, শ্বাসযন্ত্রের দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা, যক্ষা, ফুসফুসের ক্যান্সারসহ প্রধান সাতটি রোগের ঝুঁকি ৫৭ শতাংশ বেশি। আর ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ১০৯ শতাংশ বেশি ঝুঁকি থাকে।

৩০ ও তার বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে বর্তমানে ৭০ লাখের বেশি লোক তামাকজনিত রোগে ভোগে। এদের মধ্যে ১৫ লাখের রোগাক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে তামাকের প্রত্যক্ষ সংশ্লেষ রয়েছে।

১৫ বছরের কম বয়সী ৪ লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি শিশু তামাকজনিত নানান রোগে ভুগছে, যাদের মধ্যে আবার ৬১ হাজারের বেশি শিশু বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার।

দীর্ঘদিন একজন অধূমপায়ী ব্যক্তি ধূমপায়ীর সঙ্গে অবস্থান করলে তার ফুসফুসের ক্যানসার ও হৃদরোগের ঝুঁকি শতকরা ২০-৩০ ভাগ বেড়ে যায়। ধূমপান না করেও কাছের মানুষটি না জেনে প্রতিনিয়ত এর অশুভ প্রতিক্রিয়ার শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে ধূমপায়ী স্বামীরা তাদের অধূমপায়ী অসহায় স্ত্রী ও প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানদের প্রতি ধূমপানের মাধ্যমে বড়ই নিষ্ঠুর আচরণ করছেন।

অধূমপায়ীদের রক্ষায় বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বা ‘ডেজিগনেটেড স্মোকিং জোন’ বিলুপ্ত করা এখন সময়ের দাবি। চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ নয় এমন রেস্তোরাঁসহ সব ধরনের হোটেল, পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র এবং একাধিক কামরাবিশিষ্ট যান্ত্রিক পরিবহন ও সকল অ-যান্ত্রিক গণপরিবহনে ধূমপান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে গড়ে ওঠেছে সামাজিক প্রতিরোধ। প্রতিবছর সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী পালিত হয় বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হয় দিবসের স্লোগানে। সারা বছর ধরেই চলুক তামাকবিরোধী প্রচারণা। ধূমপানে মৃত্যু ঘটে- সবাই তাই তামাক থেকে দূরে থাকুন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :