ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে এক বছরে নিহত ৬৩, এতো দুর্ঘটনার কারণ কী?

ঢাকা টাইমস ডেস্ক
 | প্রকাশিত : ২৪ জুন ২০২৩, ২৩:১৮

দেশের একটি নতুন মহাসড়ক ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে গত এক বছরে দুর্ঘটনায় অন্তত ৬৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। একটি যথাযথ মহাসড়ক হিসেবে তৈরি করা এই পথে কেন এতো দুর্ঘটনা ঘটছে? এই মহাসড়কে সর্বশেষ দুর্ঘটনাটি ঘটে শনিবার, যাতে আটজন নিহত হয়েছে। ভাঙ্গার মালিগ্রাম ফ্লাইওভার এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি বাস রেলিংয়ের সাথে ধাক্কা দিলে সেটিতে আগুন ধরে যায়।

দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে এবং অন্যতম প্রধান এই সড়কটিতে গত এক বছরে এর আগে আরও অনেক দুর্ঘটনায় মোট ৫৫ জনের মৃত্যু ঘটে, আহত হয়েছে শতাধিক মানুষ। সর্বশেষ দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা হিসেবে ধরলে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় পাঁচ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এই মহাসড়কে।

গত এক বছরে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব দুর্ঘটনার পেছনে যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যাওয়া, সামনে বা পেছন থেকে ধাক্কা দেয়া, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা, পথচারীদের গাড়ি চাপা পড়ার মতো ঘটনা রয়েছে।

বাংলাদেশের প্রচলিত সড়ক ব্যবস্থাপনার তুলনায় এই এক্সপ্রেসওয়েটি উন্নত দেশের আদলে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে আলাদা দ্বিমুখী লেন, রাস্তার নিচ থেকে ইউটার্ন, স্বল্পগতির যানবাহনের জন্য আলাদা সার্ভিস লেন রয়েছে। তারপরেও কেন এই মহাসড়কটিতে এতো দুর্ঘটনা ঘটছে?

গতিসীমার লাগাম টানবে কে?

ফরিদপুরের বাসিন্দা নাজমুল হক প্রায়ই নিজের গাড়ি নিয়ে ঢাকা থেকে যাতায়াত করেন। তিনি বলেন, ‘আমার গাড়ি সবসময়েই ৮০ কিলোমিটারের গতিসীমার মধ্যে থাকে। কিন্তু এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার পর সবসময়েই দেখি, বাস, মাইক্রোবাস এমনকি মোটরসাইকেল আমাকে ওভারটেক করে মিনিটের মধ্যে চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে। তাহলে এসব গাড়ি কতো কিলোমিটার বেগে যাতায়াত করছে? আমার মতো মনে হয় না তাদের কেউ একশো কিলোমিটারের নিচে গাড়ি চালাচ্ছে।’

এই মহাসড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৮০ কিলোমিটার। কিন্তু বেশিরভাগ গাড়ি এর অনেক বেশি গতিতে চলাচল করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, হাইওয়েতে যতো মামলা হচ্ছে,তার ৪৫ শতাংশই হচ্ছে গতিসীমা লঙ্ঘনের মামলা। এর বেশিরভাগ মামলাই হচ্ছে এক্সপ্রেসওয়েতে।

হাইওয়ে পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে এই মহাসড়কে দুর্ঘটনা হয়েছে ৩৮টি, যাতে ৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে আরও ৫৫ জন। এ বছরের গত পাঁচ মাসেই ২৪টি দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৩৮টি সাধারণ ডায়রি আর ১১টি মামলা হয়েছে।

শনিবার একটি মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় মুত্যৃ হয়েছে দুই শিশুসহ আটজনের। পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগে দুর্ঘটনা ঘটলে নিহত বা আহতদের স্বজনরা মামলা করতে চাইতেন না। কিন্তু এখন এরকম ক্ষেত্রে পুলিশ নিজেরাই মামলা করে ব্যবস্থা নিচ্ছে। ফলে এ বছরের জানুয়ারির পর থেকে আইনি ব্যবস্থার সংখ্যা অনেক বেড়েছে।

পুলিশের কর্মকর্তারা মনে করছেন, এই মহাসড়কে দুর্ঘটনার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ গতিসীমা মেনে না চলা।

মাদারীপুর অঞ্চল হাইওয়ে পুলিশের সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যারা শিক্ষিত, যারা অশিক্ষিত, সমাজের নিম্নবিত্ত আর উচ্চবিত্ত- সবাই এখানে যেটা অমান্য করে, সেটা হচ্ছে গতিসীমা। এখানে যতগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে, তার মূল কারণ হলো ওভারস্পিডিং। আজকেও যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেটাও গতিসীমার ওপরে চলছিল।’

এক্সপ্রেসওয়েতে ঘটা দুর্ঘটনার মধ্যে যেমন পথচারীদের পারাপার হতে গিয়ে নিহত বা আহত হওয়া, ছোটখাটো মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা রয়েছে, আবার বড় আকারের বাস দুর্ঘটনা রয়েছে। এই মহাসড়কে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটেছিল চলতি বছরের ১৯ মার্চ, যখন ঢাকাগামী একটি বাস খাদে পড়ে গেলে অন্তত ১৯ জন নিহত আর ২৫ জন আহত হয়।

সেই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে প্রশাসনের যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেখান দুর্ঘটনার জন্য তিনটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে বাসটির বেপরোয়া গতি, বাসটির ফিটনেস না থাকা এবং বৃষ্টির কারণে মহাসড়ক পিচ্ছিল থাকা।

অন্যদিকে বুয়েট যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল, তারা বলেছে, চাকা ফেটে গেলে এক্সপ্রেসওয়ের পাশে টানা গার্ড বেইল বা নিরাপত্তা বেষ্টনী না থাকায় বাসটি মহাসড়ক থেকে নিচে পড়ে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়। নিম্নমানের টায়ার ব্যবহারকেও সেখানে দায়ী করা হয়।

অভিযোগ রয়েছে, একাধিক ট্রিপ ধরার জন্য বাসচালকরা দ্রুতগতি গাড়ি চালান। অনেক সময় গন্তব্যে যাওয়ার জন্য যাত্রীদের তরফ থেকেও চাপ দেয়া হয়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জুবায়ের জাকিরের দাবি, ‘এটাও অস্বীকার করবো না, আমাদের কিছু কিছু চালক বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালান। পদ্মা সেতু হওয়ার পর যেসব গাড়ি চলাচল করছে, অনেক গাড়ির রুট পারমিট নেই। যখন কোন দুর্ঘটনা ঘটে, তখন এ নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু ফিটনেস আছে কিনা, দ্রুত গতিতে চলছে কিনা, সেটা দেখার দায়িত্ব তো বিআরটিএ আর পুলিশের। তারা কেন ব্যবস্থা নেয় না?’

এই প্রসঙ্গে হাইওয়ে পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা সেই চেষ্টা সবসময়েই করছি, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমরা কতজনকে বাধ্য করতে পারি? আমাদের লোকবল কম, প্রতিদিন এখানে ১২ হাজার গাড়ি চলে, এদের সবাইকে নজরদারি করা সম্ভব না। কিন্তু সবাই যদি সচেতন হতেন, সবাই যদি গতিসীমা মেনে চলতেন, তাহলে কিন্তু এতো দুর্ঘটনা ঘটতো না।’

‘দুর্ঘটনা কমাতে আমাদের সবার একটি সমন্বিত প্রয়াস দরকার, আমাদের সোশ্যাল ভ্যালু সিস্টেমের মধ্যে সেটা ইন্টিগ্রেড করতে না পারলে এই এক্সপ্রেসওয়ে কিন্তু আমাদের জন্য ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনবে,’ বলছেন মোস্তাফিজুর রহমান।

বর্তমানে এই মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে গতিসীমা নজরদারির জন্য ক্যামেরা বসানো হয়েছে, যদিও সেগুলো এখনো কার্যকর হয়নি।

আধুনিক হয়েছে, নিরাপদ হয়নি

বাংলাদেশের ঢাকা থেকে ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েটি ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। গত বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরেই এই মহাসড়কে নিয়মিত যান চলাচল শুরু হয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার যোগাযোগের প্রধান সড়ক হয়ে উঠেছে এই এক্সপ্রেসওয়ে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আধুনিক সড়ক বানানো হলেও দক্ষতার সাথে সেটার ব্যবস্থাপনা হচ্ছে না।

বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘আধুনিক বিশ্বের সর্বোৎকৃষ্ট রোডের মতো করে আমরা এক্সপ্রেসওয়ে বানিয়েছি, কিন্তু এই ধরনের অবকাঠামো হজম করার ক্ষমতা হয়নি। এটার পরিবেশ রক্ষা করার জন্য যে নিবিড় নজরদারি থাকার কথা, গাড়ি চালানোর পরিবেশ রক্ষা করার জন্য যে নীতি সহায়তা নেয়া দরকার, তার কিছুই নেয়া হয়নি।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনা কমাতে বড় বিনিয়োগ করে এক্সপ্রেসওয়ে করা হয়, যাতে যানবাহন নিরাপদ চলতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এরকম সড়ক বানানো হয়েছে, কিন্তু অন্য কোন দিকে মনোযোগ দেয়া হয়নি।

বিশেষ করে এই মহাসড়কে যেসব যানবাহন চলাচল করবে, সেগুলোর ফিটনেস ঠিক আছে কিনা, মহাসড়কের গতিসীমার সঙ্গে তাল রেখে চলতে সক্ষম কিনা ইত্যাদি বিষয় যাচাই করা হয় না। দ্রুত গতির এই মহাসড়কে ঝুঁকিপূর্ণ মোটরসাইকেল চলতে দেয়া, সড়কের মাঝখান দিয়ে লোকজন পারাপার হওয়ার কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে। এসব কারণে মহাসড়কটি আর নিরাপদ হয়ে ওঠেনি।

‘আমাদের দেশে সড়ক খাতে যে চরম অব্যবস্থাপনা রয়েছে, সেখানে সর্বশেষ দাওয়াই বা ওষুধ হচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ে। কিন্তু আমাদের দেশে সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে যেভাবে এক্সপ্রেসওয়ে চলছে, তাতে খুব খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এরপরে আমাদের হাতে কিন্তু নিরাপদ, দুর্ঘটনামুক্ত অবকাঠামো উন্নয়নের আর কোন ট্রিটমেন্ট নাই,’ বলছেন ড. হক। -বিবিসি

(ঢাকাটাইমস/২৪জুন/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :