বাংলাদেশের নির্বাচনে ‘হস্তক্ষেপ’: ইরানের রাষ্ট্রীয় টিভিতে যুক্তরাষ্ট্রকে তুলোধুনা

ঢাকা টাইমস ডেস্ক
 | প্রকাশিত : ০৮ জুলাই ২০২৩, ২০:০৩

বাংলাদেশে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের ‘হস্তক্ষেপ’ নিয়ে আলোচনা হয়েছে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম প্রেস টিভির অনুষ্ঠানে। চীন-রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইরান। দেশটির সংবাদভিত্তিক ২৪ ঘন্টার চ্যানেলটির শুক্রবারের (০৭ জুলাই) এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনেকটা ‘তুলোধুনা’ করা হয়েছে।

প্রেস টিভিতে প্রচারিত ভিডিও ক্লিপটির শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করছে যুক্তরাষ্ট্র’। অনুষ্ঠানের শুরুতে উপস্থাপক বলেন, বিশ্বজুড়ে তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে নিজের স্বার্থে সরকার পরিবর্তনের ইতিহাস রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি সংসদে উল্লেখ করেছেন এভাবে- ‘তারা গণতন্ত্র হরণের চেষ্টা করছে। (তারা) এমন একটি সরকার আনতে চাইছে যাদের গণতান্ত্রিক ভিত্তি নেই। এমনটি করা হলে তা অগণতান্ত্রিক হবে।’

অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) এশিয়া এবং বাংলাদেশ বিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ড এর একটি টুইট প্রদর্শন করা হয়। সেখানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বক্তব্য সংক্রান্ত নিউজ লিংক পোস্ট করে তিনি লিখেছেন- বাংলাদেশের মানবাধিকার রেকর্ডের সমালোচনা করে হোয়াইট হাউসে চিঠি লেখার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মার্কিন কংগ্রেসের সদস্যদের বাংলাদেশের ‘শত্রু’ বলেছেন।

অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য হিন্দুর বিদেশ বিষয়ক সম্পাদক স্ট্যানলি জনির টুইটটি ছিল- ‘যুক্তরাষ্ট্র সেইসব বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের ভিসা প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়েছে যারা তাদের মতে দেশটির নির্বাচনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের পেছনে লেগেছে কেন আমেরিকা?’

অনুষ্ঠানের প্রতিবেদনে ২০২১ সালে র‍্যাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং চলতি বছর গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাধা প্রদানকারী যে কোনো বাংলাদেশির বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গ উঠে আসে। এতেই বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ক্রোধের মাত্রাটি বোঝা যায়। কিউবা, হাওয়াইসহ বেশকিছু ক্যারিবিয়ান দেশের সরকারকে হটানোর ইতিহাস রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। এক্ষেত্রে দেশটি তার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ'র সহায়তা নেয় উল্লেখ করে বলা হয়, অন্য দেশের উপর যুক্তরাষ্ট্রের এসব হস্তক্ষেপের নেপথ্যে বিভিন্ন বিষয় কাজ করে। দেশটি বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং মানবাধিকার রক্ষার নামে এসব করে থাকে। উক্ত 'নেপথ্যের বিষয়গুলো'র মধ্যে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত।

ওয়াশিংটন তার বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের প্রভাব কমাতে চায়। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়াশিংটন নিজ স্বার্থে দেশটির গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত এবং এগুলোর উপর হস্তক্ষেপ করার মাধ্যমে ওই দেশের মূল্যবান সম্পদ, বাণিজ্য রুট, কৌশলগত অবস্থানকে ব্যবহার করতে চায়।

বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদারে পরিণত হয়েছে চীন। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। কৌশলগত কারণে বাংলাদেশ চীনের বিআরআই (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাওয়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে। র‍্যাবের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার পর চীন প্রকাশ্যে বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন করেছে।

বিগত এক দশকে বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, মানব উন্নয়ন এবং দারিদ্র বিমোচন হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, টানা ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার সরকার আগামী বছরের শুরুতে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে, যার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে চীন।

যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছে চীন। তবে, বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত দেশটির নির্বাচন নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। আগের নির্বাচনগুলোর সময় বাংলাদেশে ভারতীয় মিশন সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল এবং গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও এবার তারা নিজেদের এসব থেকে বিরত রেখেছে।

প্রেস টিভির অনুষ্ঠানে বলা হয়, নির্বাচনের দিকে নজর রেখে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কর্মকর্তারা ঘনঘন বাংলাদেশে আসছেন। বৈশ্বিক আর্থিক ঝুঁকি বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক মূলত চীনকে কাউন্টার করতে দেশটির ইচ্ছারই প্রতিফলন। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন 'পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ' এবং 'রিজিওনাল ডায়নামিক' নির্ধারণ করবে।

পাকিস্তান থেকে ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৈয়দ মোহাম্মদ আলী স্কাইপেতে সংযুক্ত হয়ে বলেন, আমেরিকানরা পাঁচটি উপায়ে বিশ্বজুড়ে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে চায়। প্রথমটি অবশ্যই ভ্যালিউ সিস্টেম, এটিকে মূল্যবোধকেন্দ্রিক কিংবা আদর্শিক বলা যায়। দ্বিতীয়টি পলিটিকাল সিস্টেম। তৃতীয়টি তাদের ইকোনমিক সিস্টেম বা কারেন্সি ডমিনেন্স। চতুর্থটি ডিপ্লোম্যাসি অ্যান্ড ল এবং পঞ্চমটি হলো সিকিউরিটি ডোমেইন।

সৈয়দ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘বাংলাদেশের পলিটিকাল সিস্টেম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের দিকে যদি তাকাই, তাহলে অবশ্যই আমাদের শুধু ভ্যালু সিস্টেমের কথা বললে চলবে না। কারণ, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরানসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো চায় পশ্চিমা আধিপত্যবাদ কমুক, এটা তাদের কমন ইন্টারেস্ট। চীনা বিনিয়োগ এবং সম্পৃক্ততাকে তারা আশার আলো হিসেবে দেখে।’

বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন চায় যুক্তরাষ্ট্র, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের বিষয়ে সৈয়দ মোহাম্মদ আলী বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের সবজায়গাতেই রেজিম চেঞ্জের চেষ্টা একটা বাস্তবতা। কোনো উন্নয়নশীল দেশ যদি পশ্চিমাদের নীতি অনুসরণ না করে সেক্ষেত্রে রেজিম চেঞ্জ একটি 'অপশন'। তারা সেটা পারুক বা না পারুক, সেটা ভিন্ন আলাপ। কিন্তু, বাংলাদেশকে এখন নিজ দেশের রাজনীতি এবং আঞ্চলিক রাজনীতির পাশাপাশি চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করার চ্যালেঞ্জকে সামলাতে হচ্ছে।

পাকিস্তানের এই ভূরাজনীতিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে তিনটি ডোমেইন দিয়ে বিচার করতে হবে: নিরাপত্তা, অর্থনীতি এবং বৈদেশিক নীতি। আপনাকে মানতে হবে, বাংলাদেশ এ দিক থেকে তুলনামূলকভাবে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছে। দেশটি কোনো ইস্যুতে কারো বিরুদ্ধে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বা চীন কারো পক্ষ নেয়নি। যদিও তাকে চীনা বিনিয়োগ কমানোর জন্য নানা চাপ সহ্য করতে হচ্ছে। চীন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় বিনিয়োগেকারী দেশ হলেও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বৃহৎ রপ্তানি গন্তব্য।

সৈয়দ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির ধরন চীনের তুলনায় খুবই ব্যতিক্রম। চীন কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করা ছাড়াই বিনিয়োগ, যৌথ উদ্যোগ এসবে বিশ্বাস করে। কিন্তু, যুক্তরাষ্ট্র জবরদস্তি, চাপ প্রয়োগ, নিষেধাজ্ঞাসহ যতো উপায়ে সম্ভব নিজ নীতি মানতে উন্নয়নশীল বিশ্বকে বাধ্য করে।’

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র‍্যাটেজি এবং চীনের বিআরআইয়ের কারণে দুই দেশের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্বের প্রেক্ষাপটে দেশটির বৈদেশিক নীতি সামনের বছরগুলোতে কেমন হতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ মোহাম্মদ আলী বলেন, বাংলাদেশকে আমরা এতোদিন দুই দেশের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে দেখেছি। যুক্তরাষ্ট্রের নীতি চীনের তুলনায় অনেক বেশি আগ্রাসী হলেও অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশ এভাবেই চলে আসছে।

(ঢাকাটাইমস/০৮জুলাই/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

জাতীয় এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :