তত্ত্বাবধায়ক ও নির্বাচন পরিস্থিতি

মো. সাখাওয়াত হোসেন
  প্রকাশিত : ১৮ জুলাই ২০২৩, ১৬:০৭
অ- অ+

ইইউর সাবেক কমিশনার ও ধর্ম বিষয়ক বিশেষ দূত ইয়ান ফিজেল বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) উচিত হবে না বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে কোনোভাবেই সমর্থন দেওয়া। দ্য ইউরোপিয়ান টাইমস ও ইইউ অবজার্ভারে প্রকাশিত ‘দ্য ইইউ মাস্ট নট সাপোর্ট আ কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক নিবন্ধে ইয়ান ফিজেল বিষয়টি তুলে ধরেন। যুক্তি হিসেবে তিনি দাঁড় করান, অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা দেওয়া হলে তা আবারও সামরিক বাহিনীর হাতে চলে যেতে পারে। যেমনটা ঘটেছিল এখন থেকে ১৭ বছর আগে ২০০৬ সালে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুটি দেশ থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের দৃষ্টান্ত দিয়ে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতা করেন।

নিবন্ধে তিনি তুলে ধরেন, সবশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তারা নির্বাচনই স্থগিত করে। ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কার্যত দেশ শাসন করে সামরিক শাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর সেই সময় প্রধান বিরোধী দল ও বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচন বয়কট করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর সব নেতাকে গ্রেফতার করা হয় এবং প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়, তা সাধারণত কোনো জান্তা সরকারই করে থাকে। সাধারণত রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদদের রাজনীতি থেকে বয়কট করার মিশনে নামে সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

বিএনপির বর্তমান দুই শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান ছাড়াও সেই সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও জেল-জরিমানা দেওয়া হয়। সেদিনের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় প্রভাবক হয়ে থাকতে পারে। ইয়ান ফিজেল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এমন একটি ব্যবস্থা যা বিশ্বের আর কোথাও নেই। ২০১১ সালে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট এই ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন। এদিকে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি নতুন আইন পাস করা হয়।

নিবন্ধে তুলে ধরা হয়, চলতি বছরের জুনে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর গাজীপুরে সাম্প্রতিক স্থানীয় নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে ও বড় কোনো অঘটন ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচনে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে কম ব্যবধানে হারিয়ে দিয়েছেন। যদিও বিএনপি এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। ইয়ান ফিজেলের মতে, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধীদের নির্বাচন বয়কটের আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে এই অঞ্চলে আরেকটি সামরিক হস্তক্ষেপের মঞ্চও প্রস্তুত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে যদি সামরিক বাহিনীকে থামাতে হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সামরিক নেতাদের এটা অবশ্যই স্পষ্ট করে দিতে হবে যে এর পরিণতি হবে দ্রুত, অত্যন্ত কঠোর এবং ব্যক্তিগত। প্রসঙ্গত তিনি তাঁর বক্তব্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুন:প্রবতর্নের বিরুদ্ধে যুক্তিসহ মতামত তুলে ধরার পাশাপাশি নেতিবাচক বিষয়াদি উপস্থাপন করে বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ ও সাধারণ জনতার মধ্যে ব্যাপারটিকে বিশ্লেষক হিসেবে তুলে ধরেছেন।

সঙ্গত কারণেই, বিএনপি নির্বাচনে না থাকলেও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। কোন কারণে বিএনপি নির্বাচনে না এলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণে বিরত নাও থাকতে পারে। গত দুটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও অন্যরা ঠিকই এসেছে। বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনে কিন্তু বিএনপি আসেনি অর্থাৎ স্থানীয় সরকার নির্বাচন, সিটি কর্পোরশনের নির্বাচন, পৌরসভার মেয়র নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে প্রার্থী দেয়নি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বিএনপিতে বিভিন্ন পদে আছেন এমন অনেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। কিছু কিছু জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে অনেকে ভোটে জয়লাভ করেছে। সে কারণেই অনুমান করা যাচ্ছে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অনেক নেতাই নির্বাচনে স্বতন্ত্র হয়ে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। উল্লেখ্য, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হয়ে যারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন তাদেরকে দল থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। আবার একটি অংশ রয়েছে যারা নির্বাচনমুখী, তাদের ভাষ্য হচ্ছে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে আবার রাজপথের আন্দোলনও সমান তালে চালিয়ে যেতে হবে। এ অংশটি কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে এবং নির্বাচনিক পরিবেশ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। মোদ্দা কথা হচ্ছে, দলীয়ভাবে বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে বিএনপির অনেক নেতাই স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।

এদিকে, কূটনৈতিকরা এখন গোলযোগহীন নির্বাচনের উপর বেশি জোর প্রদান করছেন। ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বর্তমানে সময়ে বাংলাদেশকে নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের ব্যাপক আগ্রহ। সে কারণেই আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে তাদের তৎপরতা দেখেই বোঝা যাচ্ছে; আগামী বিশ্বে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনার অংশীদার হতে চায় পশ্চিমা বিশ্ব। তারই ধারাবাহিকতায় ইইউ, যুক্তরাষ্ট্রসহ দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা দফায় দফায় দায়িত্বশীলদের সঙ্গে বৈঠক করে সুষ্ঠু নির্বাচনের আহবান জানাচ্ছেন। সরকারের পক্ষ হতে নির্বাচনে ইইউসহ অন্যান্য প্রতিনিধিদলগুলোর পক্ষ থেকে নির্বাচনে প্রতিনিধি পাঠানোর আহবান জানানো হয়েছে এবং সরকারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের। তাছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়ার সংকটের কারণে পুরো বিশ্বকে ক্ষতিপূরণ দিতে চাচ্ছে। সে জায়গা থেকে চিন্তা করলেও দেখা যায়, গোলযোগহীন নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে কূটনৈতিকগণ কাজ করছেন, সরকারও কূটনৈতিকদের সে মোতাবেক আশ্বাস দিয়েছে।

অন্যদিকে দেখা যায়, কূটনৈতিকরা এখন সংবিধান লঙ্ঘন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানাতে সরকারের ‍উপর চাপ প্রয়োগ করতে নারাজ। দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কূটনৈতিকদের সাক্ষাতের পর্যালোচনা গণমাধ্যমে উঠে আসছে। সে জায়গায় দেখা যায়, তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে কূটনৈতিকগণ কথা বলতে নারাজ, কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হবে সেটির সিদ্ধান্ত প্রকৃতঅর্থে বাংলাদেশের জনগণ গ্রহণ করবে। সংবিধান লঙ্ঘন করে নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে কোন সংস্থা কিংবা দেশ বাংলাদেশ সরকারকে বলেনি। তাদের প্রত্যাশা হচ্ছে নির্বাচনটি যেন নিরপেক্ষ হয়, সরকার প্রধানও বিভিন্ন জায়গায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন সংক্রান্তে অঙ্গীকারের ব্যাপারে তুলে ধরেছেন।

শেষত আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি না আসলে দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে বিএনপিই। প্রকৃতঅর্থে রাজনৈতিক দল মাত্রই নির্বাচনমুখী, নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের কাছাকাছি আসার সুযোগ হয়। তাছাড়া ভোটের রাজনীতির সৌন্দর্যই হচ্ছে নির্বাচন। নির্বাচন এলেই নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হয়ে উঠেন এবং দলীয় প্রচারণায় ভোটারদের নিকট প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। নির্বাচিত হয়ে নেতারা প্রদেয় প্রতিশ্রুতি পূরণে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে জনগণের মন জয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নির্বাচনিক প্রক্রিয়া জনগণের জন্যও এক ধরনের শুভ প্রেরণার অনুগ্রহ হয়ে থাকে। বিশেষ করে প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হলে সে দলের প্রার্থীকে জনগণ ভোটে পরাস্ত করে, এ ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার ইস্যু সামনে চলে আসে যার পরিপ্রেক্ষিতে ভোটাররা ভোটের গুরুত্ব পায় নির্বাচনে। সে জায়গায় বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে তাহলে জনগণের সামনে তাদের যাওয়ার ‍সুযোগ কমে আসবে। বিগত দুটি নির্বাচনে বিএনপি কিন্তু অংশগ্রহণ করেনি, নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে; জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দল নির্বাচনে এসেছে। সরকারের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে বিশ্বময়। কাজেই আসন্ন নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশগ্রহণ না করে তাহলে জনগণের নিকট হতে তাদের দূরত্বের সৃষ্টি হবে, নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভেদ ও অন্ত:কলহের সৃষ্টি হবে।

লেখক: চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে আ.লীগকে নিষিদ্ধ করলে ভালো হতো: জামায়াত আমির
জামালপুরে মাদ্রাসায় ছাত্রী ভর্তিকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষ, আহত ২০
ইউনাইটেড হাসপাতালের কাছে ডিএনসিসির কর বকেয়া ৩০ কোটি টাকা
শহীদ নিজামীর খুনিদের বিচার বাংলার মাটিতেই হবে ইনশাআল্লাহ: রফিকুল ইসলাম 
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা