বঙ্গবন্ধুর মানবতাবোধই বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবিকল্প সমার্থক

একটি সুনির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী যখন বহুকাল ধরে প্রচলিত কোনো নির্দিষ্ট ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, শিক্ষা, শিল্প ও সমাজব্যবস্থাকে নৈমিত্তিক চর্চায় সহজাত করে নেয়, তখন সেই জনপদে একটি স্বতন্ত্র বোধের সৃষ্টি হয়, যা তাদের একক জাতি হিসেবে চিহ্নিত করে। আবহমানকালের এই সহজাত বোধই হলো জাতীয়তাবাদ। মানবতার প্রকৃত সুখের সন্ধান মেলে সেখানে, যেখানে মানুষ জন্ম নিয়ে তার মায়ের ভাষায় কথা বলতে শেখে, পরিবার সমাজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে অর্জিত জ্ঞান-গরিমা ও মূল্যবোধের নির্যাস থেকে নির্মিত একটি নিজস্ব সংস্কৃতিতে তার সমস্ত বিচরণকে অনুভব করতে পারে। এই ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক স্বাধীনতাই প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি নাগরিকের ব্যক্তিস্বাধীনতার চূড়ান্ত রূপ। জন্মগতভাবে আরোপিত যে কোনো বিষয়, যা মানুষের নিজস্ব স্বাধীনতার সাথে বৈরীভাবাপন্ন মনে হয়, তা কখনই প্রকৃত জাতীয়তাবাদের আদর্শ হতে পারে না। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক বিস্তারে সকল মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করাই একটি প্রকৃত মানবিক জাতীয়তাবাদের মূল আদর্শ।
১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হওয়ার পর থেকেই খণ্ডিত ভারতবর্ষে অঞ্চলভিত্তিক ভিন্ন সম্প্রদায়ভুক্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে এই সাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রবলতর হয়ে উঠলে তার বিরাট প্রভাব পড়ে সমগ্র সমাজ তথা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়। সুযোগসন্ধানী মৌলবাদীরা সাধারণ মানুষের ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করে নিজেদের ক্ষমতাশীল করে তোলে। ধীরে ধীরে নষ্ট হতে থাকে একটি সুপ্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এ ইতিহাস আমাদের বঙ্গভূমির। সম্পূর্ণভাবে সংস্কৃতিনির্ভর একটি জনপদের জাতিগত সাম্যতা বিনষ্ট হয়ে একটি মুসলিম রাষ্ট্রের অংশে রূপান্তরিত হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশ।
এ অভিশাপ থেকে মুক্ত করে আবহমান বাংলার সংস্কৃতিনির্ভর সেই ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার করতেই যেন শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হয়েছিল। প্রখর প্রজ্ঞাশীল এই জননেতা তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে কখনই এই ধর্মভিত্তিক বিভাজনকে মেনে নিতে পারেননি। একটি রাষ্ট্র বিভিন্ন শ্রেণি-ধর্মের জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গঠিত হয়। একই মাটিতে জন্ম নিয়ে একই ভাষায় কথা বলে কিছু মানুষ যদি শুধুমাত্র ধর্মমতের পার্থক্যের জন্য নিজ মাতৃভূমিতেই নিজেকে অবাঞ্ছিত মনে করে, তাহলে সে রাষ্ট্র কখনই একটি সুষ্ঠু জাতীয়তাবাদের জন্ম দিতে পারে না। আর তা হলে সেই জাতিরাষ্ট্র অচিরেই নিজের অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে পড়ে যাবে সুনিশ্চিতভাবেই।
এ উপলব্ধি থেকে বঙ্গবন্ধু প্রথমেই মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততার ওপর গুরুত্ব দেন। "উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা"-পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের এই অন্যায় ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে রচিত হয় এক অমর ইতিহাস। স্বৈরশাসকদের নির্দেশে গুলি করা হয় প্রতিবাদকারী ছাত্রজনতার ওপর। রক্তাক্ত হয় বাংলার মাটি। এই বর্বরতার বিরুদ্ধে ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর প্রথম বাংলার আমজনতাকে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আবার মানসিকভাবে একাত্ম হতে দেখা যায়। এই একাত্মবোধের উদ্দীপনায় একটি স্বাধীন সার্বভৌম স্বতন্ত্র বাঙালি রাষ্ট্র নির্মাণের অভীষ্ট লক্ষ্যে আরও এক ধাপ এগিয়ে যান বঙ্গবন্ধু। ছাত্রলীগ গঠনের পর আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করেন আওয়ামী লীগ। অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা, সৃষ্টিশীল নির্দেশনা, সুষ্ঠু পরিকল্পনা, সাংস্কৃতিক মনন ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের প্রভাবে জনমনে শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রহণযোগ্যতা অতীতের সমস্ত নেতাকে ছাড়িয়ে আরও বহুদূর বিস্তৃত হয়ে যায়।
পাকিস্তানিদের অন্যায় শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থান ও আপসহীন নেতৃত্বের প্রভাব বাংলার মানুষদের আবার শুধুমাত্র বাঙালি হিসেবে একাত্ম করতে সক্ষম হয়। বঙ্গবন্ধু জানতেন সমগ্র জাতিকে এক করতে না পারলে মুক্তির সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে। তাই মানবতার বরপুত্র শেখ মুজিব ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালির সমান অধিকার রক্ষার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে অসাম্প্রদায়িক একটি জাতীয়তাবাদের আদর্শে সমগ্র জাতিকে অনুপ্রাণিত করেন। শুরু হয় বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম। বিশ্বের সুপ্রতিষ্ঠিত পরাশক্তিদের সম্মিলিত জোটকে শুধুমাত্র অবিচল দেশপ্রেম, অখণ্ড জাতীয়তাবাদের আদর্শ, সাধারণ মানুষের আস্থা ও নির্ভরতা এবং মহান সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদের শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করে ১৯৭১ সালে মাতৃভূমিকে পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত করেন বঙ্গবন্ধু। পৃথিবীর মানচিত্রে খচিত হয় স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের সীমারেখা।
' বঙ্গবন্ধু ' থেকে ' বিশ্ববন্ধু ' রূপে বিকশিত হতে বিশেষ কোনো সময় লাগেনি বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের। সমগ্র বিশ্বের রাজনৈতিক পরাশক্তিদের কটাক্ষকে উপেক্ষা করে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি অবিচল আস্থা রেখে তিনি নির্ভীকভাবে ঘোষণা করেছেন - " আমি শোষিতের পক্ষে। "
পৃথিবীর প্রতিটি নির্যাতিত নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রেরণার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন তার অলৌকিক ব্যক্তিত্বগুণে। কোনো এক সম্মোহনী শক্তির প্রভাবে তার সামনে অপ্রতিভ হয়ে যেত সমসাময়িক স্বনামধন্য বহু বিশ্বনেতা। বিশ্বমানবতার এই ক্ষণজন্মা মঙ্গলদূত অতি অল্প সময়কালের মধ্যেই ত্বরিতগতিতে তার নবগঠিত যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রের ক্ষুধার্থ হতদরিদ্র সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো যথাসম্ভব নিশ্চিত করেন। একই সাথে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য একটি অসাম্প্রদায়িক সংবিধান রচনা করেন। বাংলার মুসলিম, সনাতনী, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, উপজাতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিটি মানুষই একজন একক বাঙালি, স্বাধীন বাঙালি। একটি প্রবল ধর্মপ্রাণ জাতির সিংহভাগ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তিত করে সাংবিধানিকভাবে একটি অবাধ, ধর্মনিরপেক্ষ, সংস্কৃতিপ্রবণ মানসিকতায় নিয়ে আসতে পারার কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু ব্যতীত পৃথিবীর আর কোনো রাষ্ট্রনায়কের নেই। মানবতার এক অনন্য নিদর্শন স্থাপন করে তিনি এই অসাধ্য সাধন করেছেন। শূন্য হাতে ক্ষমতায় এসেও তিনি প্রথমেই গ্রামবাংলার অসহায় হতদরিদ্র কৃষকদের ঋণমুক্ত করেছেন, সার ও বীজ সরবরাহ করেছেন। ধনী শ্রেণির হাত থেকে মুক্ত করে ব্যাংক পরিসেবার আওতায় এনেছেন সাধারণ মানুষদের। যুদ্ধবিধ্বস্ত, বুদ্ধিজীবীশূন্য, অর্থশূন্য, অসহায় একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রকে মাত্র সাড়ে তিন বছরের পুনর্গঠনকালের সময়সীমার মধ্যে তিনি সগৌরবে বিশ্বদরবারে নতুন কলেবরে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। অলৌকিক শক্তিধর না হলে কোনো স্বাভাবিক ক্ষমতার সাধারণ মানুষের পক্ষে এই মহাযজ্ঞ সম্পন্ন করা একেবারেই অসম্ভব। বিশ্বমানবতার বরপুত্র, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই অসাম্প্রদায়িক নন্দনতত্ত্বের ঐশ্বরিক প্রভাবেই একাত্তরের সেই উত্তাল রণসমুদ্র আমরা জাতিগতভাবে ঐক্যের মাধ্যমে পাড়ি দিতে পেরেছিলাম। তাই নিঃসংকোচে বলা যায়, বঙ্গবন্ধুর সাম্য ও মানবতাবোধই প্রকৃত বাঙালি জাতীয়তাবাদের অবিকল্প সমার্থক।
লেখক: পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

মন্তব্য করুন