বাংলা ভাষার স্বাধীনতা সংগ্রামে তরুণ বিপ্লবী নেতা শেখ মুজিব

এস এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
 | প্রকাশিত : ১৩ আগস্ট ২০২৩, ০৯:৩৭

১৯৪২ সালে ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন ভারতবর্ষের বিজ্ঞ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক আলাপচারিতার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর তারুণ্য শৌর্যবীর্য বিজ্ঞনেতাকে মুগ্ধ করে। সে সময় এম.ভাস্করণ তাকে "সোহরাওয়ার্দীর ছত্রতলে রাজনীতির উদীয়মান বরপুত্র" হিসেবে আখ্যায়িত করেন। রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকে বাম ডান এমনকি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বৈশিষ্ট্যসহ ভারতবর্ষের নামজাদা রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক দর্শন ব্যক্তিগত আদর্শ বিভিন্ন সময়ে কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ নানান বিষয়ে রাজনীতিতে সৌভাগ্যের বরপুত্র খুব অল্প সময়ের মধ্যে অভাবনীয় প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা অর্জন করেন। এক পর্যায়ে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় আবেশিত হয়ে গরিব-দুঃখী ও নিগৃহীত বঞ্চিত মানুষের মুক্তির অন্যতম উপায় হিসেবে গ্রহণ করে অমিত সম্ভাবনাময়ী ভাগ্মিতা অর্জন করেন এবং বক্তৃতায় সম্মোহনী শক্তি প্রাপ্ত হন। ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী চরিত্র নিয়ে ভারত পাকিস্তান বিভাজিত হলে পাকিস্তানপন্থী মুসলিম লীগের কেন্দ্রিয় চরিত্রের নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য বিশেষ করে ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা শুধুমাত্র উর্দু হবে, তৎকালীন পাকিস্তানের নেতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ স্পর্ধা সহকারে এমন বক্তব্য প্রদান করলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের নতুন করে টনক নড়তে শুরু করে। যদিও পূর্ব থেকেই দাবি করা হচ্ছিল বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদা দিতে হবে। নানারকম বিমাতাসুলভ আচরণ প্রত্যক্ষ করে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে নতুন সংগঠন এ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম যোগদান করেন। শেখ মুজিবকে দলের পূর্ব পাকিস্তান অংশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।

ভাষার প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দৃষ্টিভঙ্গি ও ঔদ্ধত্য প্রদর্শনে ঢাকাকেন্দ্রিক ছাত্র জনতার অসন্তোষ এর তীব্রতা যথাযথভাবে অনুধাবন করে তরুণ নেতা শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনকে সফল করতে অসন্তোষের ঢেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সচেতন নাগরিকদের মধ্যে স্বল্প সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে সফলতার লক্ষ্যে কার্যকরী প্লাটফর্ম তৈরি করে যে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেন, তা বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ভাষাসংগ্রামী তরুণদের চূড়ান্ত লক্ষ্য. অর্জন ২১শে ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত হয়। বরাবরের মতই চূড়ান্ত আন্দোলনের রুপরেখা বিশ্লেষণ করে আন্দোলন জমাতে বাস্তবে যেন রূপ নিতে না পারে সে লক্ষ্যে পাকিস্তানি শাসকরা শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে। কারাবন্দি থেকেও শেখ মুজিব আন্দোলন সফল করতে নানা বিধ দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন এমনকি একটানা ১৩ দিন জেলখানায় থেকে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে অনশন করেছেন। ভাষার প্রশ্নে জেলখানায় অনশন এ বিষয়টি শেখ মুজিব ব্যতীত আর কোন বিশ্বনেতার রেকর্ডে আছে বলে আমার জানা নেই। অবশেষে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে সালাম রফিক জব্বার সফিক সহ বেশ কয়েকজন ভাষা সৈনিকের প্রাণ কেড়ে নেন বন্দুকের নল ব্যবহার করে। তবুও এ তরুণদের দমিয়ে রাখতে পারেনি পাকিস্তানি শাসকেরা। এ বাংলার দামাল ছেলেদের আন্দোলন সফল হয়। আমরা পাই আমাদের বাংলা ভাষা ব্যবহারের স্বাধীনতা। একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা স্বাধীনতা, বাঙালি জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির লক্ষ্যে স্বাধীনতার উত্তম বীজ বপন করেছিল তরুণ নেতা শেখ মুজিবের বিপ্লবী চেতনায়। ২৬ শে ফেব্রুয়ারি তারিখে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয়।

ভাষা আন্দোলন এর যাত্রা শুরু থেকে ভাষা স্বাধীনতার চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত সময়টাতে কতটা চড়াই-উৎরাই জেল-জুলুমের মধ্যে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবন অতিবাহিত হয়েছে তার কিছু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট প্রাসঙ্গিকভাবে জানা প্রয়োজন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ২৩ শে ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে উর্দু বা ইংরেজিতে বক্তব্য দেওয়ার প্রস্তাব নাকচ করেন পূর্ব পাকিস্তানের কংগ্রেসের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা করার দাবি তুলে ধরেন। সেসময়ের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বাংলা ভাষার বিরোধিতা করলে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের একুশে মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। প্রতিবাদী-

১. শেখ মুজিব মুসলিম লীগের পূর্বপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।

২. এমনটি ঘটতে পারে জেনে জিন্নাহর ঘোষণার পূর্বে একই বছর ১৯৪৮' র ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের অংশগ্রহণে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

৩. মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নীতিমালা আলোচনায় শেখ মুজিব একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের প্রস্তাব করেন।

৪. ১১ই মার্চ ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহবানে ধর্মঘট পালিত হয়।

৫. ধর্মঘট চলাকালে শেখ মুজিবসহ আরো কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

৬. ছাত্রসমাজের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৫ ই মার্চ শেখ মুজিব সহ অন্যান্যদের মুক্তি দেওয়া হয়।

৭. মুক্তি উপলক্ষে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শোভাযাত্রা হয় যাতে শেখ মুজিব সভাপতিত্ব করেন।

৮.১৫ ই মার্চ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা হয় এবং ১৭ ই মার্চ সারা দেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘটের ঘোষণা দেন।

৯. ১৯৪৮ সালেই ১৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন পরিচালনা করেন।

১০. ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি তাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।

১১. জেল থেকে বেরিয়ে তিনি চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে আবার জড়িয়ে পড়েন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার জরিমানা করেন। এ জরিমানা অবৈধ ঘোষণা করে তিনি তা প্রদান করা থেকে বিরত থাকলে এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।

১২. চলমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বরাতে তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করে ২৬ জুন ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে আবার মুক্তি দেয়া হয়।

১৩. ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের পূর্ব-পাকিস্তান আগমনকে উপলক্ষ্য করে ঢাকা দূর্বিক্ষোভবিরোধী মিছিল বের করেন। এ মিছিলে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে শেখ মুজিবকে আবার আটক করা হয়।

১৪. দুই(০২) বছর জেলে আটক রেখে ১৯৫২'র শে জানুয়ারি মুজিবের মুক্তির আদেশ পাঠ করার কথা থাকলেও খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন 'উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে'।

১৫. এ ঘোষণা শুনে জেলে থেকেও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কে পরোক্ষভাবে পরিচালনার মাধ্যমে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আয়োজনে তিনি সাহসী ভূমিকা রাখেন এবং একুশে ফেব্রুয়ারিকে রাষ্ট্রভাষার দাবি আদায়ের দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত হয়।

১৬. বাইরে চলমান আন্দোলনকে গতিশীল রেখে জেলখানায় অবস্থান করেই বঙ্গবন্ধু কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিয়ে আন্দোলনের ঢেউকে আরো শক্তিশালী করতে নিজে ১৪ ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন পালন করেন একটানা ১৩ দিন। অবশেষে ২৬ শে ফেব্রুয়ারি তাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।

একের পর এক মুসলিম লীগের নেওয়া ভুল সিদ্ধান্ত বাংলার সুর্যোদয়ের গতি ত্বরান্বিত করেছে বলতেই হয়। বঙ্গবন্ধুকে যতো বেশি জেলে পুরে রেখে আন্দোলনকে নিষ্প্রাণ করার চেষ্টা বারংবার করেছে ততটাই বেশি আন্দোলন গতিপ্রাপ্ত হয়েছে। কারণ বঙ্গবন্ধু নেতা হিসেবে ততোদিনে ছাত্রজনতা ও সাধারণ মানুষের জন্য আস্থার প্রতিক হিসেবে পরিপূর্ণতা অর্জন করে ফেলেছেন। ফলে বাইরের বঙ্গবন্ধুর চেয়ে জেলখানার বঙ্গবন্ধু দিনে দিনে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও আন্দোলন সফল নেতৃত্বের এক অগ্নিপুরুষ হিসেবে পাকিস্তানীদের জন্য যেমন ভয় ও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাড়াতে থাকলো, বিপরীতে সমগ্র বাঙালির হৃদয়ে ততোবেশি মুক্তির দূত হিসেবে আস্হা অর্জন করতে থাকলো।

সৃষ্টিকর্তার আশির্বাদ যেনো শ্রাবণের বাদল হয়ে ঝরতে থাকলো বঙ্গবন্ধুর জীবনে। ভাষা আন্দোলনে গুলি করার মতো ঘৃন্য জঘন্যতম ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। বঙ্গবন্ধুর সে সময়ের দুই বছর জেলজীবন বাঙালি জাতির জন্য আশির্বাদ হিসেবে দেখতে চাই আমি কেননা, ভাষা আন্দোলনে তিনিই হতেন পারতেন প্রধান টার্গেট। সে শঙ্কা অহেতুক ভাবার কোনও সুযোগ নাই । পাকিস্তানী মুসলিম লীগের ভুল সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তা বাঙালির প্রাণপুরুষকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন যেনো তাঁরই বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বেঁচে ছিলেন। অত্যাচারীদের হাত থেকে বাংলার মুক্তির মহানায়ক বিবেচনায় তাঁর পরবর্তী আবশ্যক বৈপ্লবিক প্রতিনিধি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকেই তিনি মনোনীত করে রেখেছিলেন বলেই ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি । অর্থাৎ এখানে, এখনই যেনো শেষ নয়, যেতে হবে অনেক দুর তাই। সেকল দিক ভাবতে গেলে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির জন্য সৃষ্টিকর্তার ডিভাইন আশির্বাদ হিসেবে ধরনীতে ক্ষণজন্মা মানুষ হয়ে এসেছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নাই।

লেখক: পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :