জনম ও জনকল্যাণে উৎসর্গীকৃত এক জীবন শেখ হাসিনার

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
 | প্রকাশিত : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৪৪

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার শেখ পরিবারটি ঐতিহ্যগতভাবেই ছিল সমাজ এবং জনকল্যাণবাদী। ১৯ শতকেই এই পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ সেই অঞ্চলে যেসব ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন, নানাভাবে সহযোগিতাও দিতেন। এই পরিবারেরই সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি নিজেই তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “ছোট দাদার নাম শেখ আবদুর রশিদ। তিনি পরে ইংরেজের দেওয়া ‘খান সাহেব’ উপাধি পান। জনসাধারণ তাকে ‘খান সাহেব’ বলেই জানতেন।” তিনি আরো লিখেছেন, “আমার ছোট দাদা খান সাহেব শেখ আবদুর রশিদ একটা এম ই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের অঞ্চলের মধ্যে সেকালে এই একটা মাত্র ইংরেজি স্কুল ছিল, পরে এটা হাইস্কুল হয়, সেটি আজও আছে। আমি তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত এই স্কুলে লেখাপড়া করি।” (পৃ-০৮) পারিবারিক এই ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠতম উত্তরাধিকার ছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং তার স্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তারা একই বংশেরই সন্তান ছিলেন। পারিবারিকভাবেই তাদের বিয়ে হয়। সে ঘরেরই বড় সন্তান শেখ হাসিনা। জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। এ বছর তার জন্মের ৭৫ বছর পূর্ণ হচ্ছে। পিতা ও মাতা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। পিতার বয়স ৫৫, মাতার বয়স মাত্র ৪৫ ছিল। ঘাতকের হাতে তারা নিহত হলেন সপরিবারে। দেশে থাকলে শেখ হাসিনারও হয়তো জীবন কেড়ে নিতো শত্রুরা। কারণ বঙ্গবন্ধু তখন দেশটাকে একটি আধুনিক অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে নির্মিত করার এক কঠিন চ্যালেঞ্জ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। তাঁর এই রাষ্ট্র নির্মাণের চিন্তাকে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা মহল পছন্দ করেনি। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন শোষিতের রাষ্ট্রব্যবস্থা যা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক শোষক শ্রেণির পছন্দ ছিল না। সে কারণেই রক্তাক্ত ১৫ আগস্ট সংঘটিত করা। বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং ৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর যোগ্য রাজনীতির সহযোগী জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যার পর এই ঘাতকরা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকেই শুধু থামিয়ে দেয়নি, রাষ্ট্রটিকেও পরিচিত করেছিল একটি হায়েনাকবলিত ক্ষমতাকেন্দ্রিক গোষ্ঠীর। সেই সময়ের জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডট বলেছিলেন, ``Bengalis can no longer be trusted after the killing of Sheikh Mujib. Those who killed Mujib can do any heinous thing.'' এরপর বাংলাদেশ ক্ষমতা দখলকারীদের মুখে কেবলই বঙ্গবন্ধু এবং তার রাষ্ট্রনীতির সমালোচনা, ব্যর্থতা ও নিন্দাবাদ শুনেছে। কিন্তু বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ যে কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, সেই অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, শোষণহীন অর্থনৈতিক এবং আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের ছিটেফোঁটাও তারা খুঁজে পায়নি। কারণ পুরো হত্যাকাণ্ডই ছিল বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে। সেভাবেই চলেছিল দেশটি অন্তত দুই দশকেরও বেশি সময়। বাংলাদেশ সেই কঠিন কারাগার থেকে মুক্তির যেন দিশা খুঁজে পাচ্ছিল না। কারণ দিশা দেওয়ার মতো রাজনৈতিক নেতৃত্বকে হত্যা করা হয়েছিল, দলকে ভেঙ্গেচুরে তছনছ করে দেওয়া হলো এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন করে দেওয়া হলো। সামরিক শাসকরা এই একটি কাজেই শুধু পারদর্শিতা দেখাতে পারেন। রাষ্ট্র গঠন, জাতি গঠন, উন্নয়ন আর যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা নেওয়ার রাজনৈতিক দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক চিন্তা তাদের থাকার কথা নয়, থাকেওনি। তাই তারা তা পারেওনি। কিন্তু আমজনতাকে তারা কত কি স্বপ্ন দেখায়। যেমন দেখিয়েছিল আইয়ুবের সামরিক শাসনকালে। সেটিরই ধারাবাহিকতায় সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদও দেখিয়েছে। তাদের গড়া রাজনৈতিক দলগুলোও ঐ বৃত্তেই আবর্তিত হতে থাকায় বেশি কিছু কৃতিত্ব দেখাতে পারেনি। এখানেই আমাদের মতো রাষ্ট্রগুলোর স্বাধীনভাবে বিকশিত হওয়ার কঠিন সমস্যায় পড়ার অভিজ্ঞতা দেখতে হয়। বাংলাদেশ পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক সামরিক আমলা-শাসক-শোষক গোষ্ঠীর বেড়াজাল ভেঙ্গে ’৭১-এ বঙ্গবন্ধু এবং তার রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত করে সাড়ে তিন বছরের মাথায় যখন একটি স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করেছিল, তখনই সেই রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু এবং তার সুযোগ্য সহকর্মীদের হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলো পাকিস্তানের সেসব সামরিক প্রেতাত্মাই। এই ইতিহাসটি আমাদের মোটেও ভুলে গেলে চলবে না। বারবার এই পাঠটি রাজনীতি এবং রাজনীতির বাইরের দেশপ্রেমিক সকল মানুষের করা জরুরি।

বঙ্গবন্ধুর পরিবার শেখ পরিবারের ঐতিহাসিক মহৎ ঐতিহ্যকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু নিজে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছিলেন স্বাধীনতা লাভের জন্য। কিন্তু ’৪৭-এর দেশভাগ বাংলাকে স্বাধীনতা দেয়নি, পাকিস্তানের পরাধীন করেছিল। ২৩ বছর তিনি এই পরাধীন পাকিস্তান থেকে মুক্তির জন্য লড়াই-সংগ্রাম, আত্মত্যাগ, জেলজুলুম, অত্যাচার যেমন হাসিমুখে বরণ করেছিলেন, একইসঙ্গে সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন দেশকে মুক্ত করার জন্য। সেটি তিনি পেরেছিলেন। ’৭২ থেকে ’৭৫ তিনি দেশটাকে আধুনিক অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের চরিত্রদানে ব্যস্ত ছিলেন। তার জীবনকে রাজনীতির বাইরে খুঁজে পাওয়া যায় না। পরিবার তার কাছে সীমিত গণ্ডির মধ্যে থাকলেও সময় তাদের দিতে পারেননি। তবে সেই অভাব পূরণ করেছিলেন তার স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ফলে বঙ্গবন্ধুর পরিবার দেশ, সমাজ এবং মানবকল্যাণের বাইরে কোনো প্রভাবেই প্রভাবিত হয়নি। শেখ হাসিনা টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নিয়ে শৈশব কাটিয়েছেন নিভৃত সেই পল্লী গাঁয়ে। পিতৃ স্নেহ প্রতিদিন পাননি, তবে যতটা পেয়েছেন তাতেই পিতার মন ও ভালোবাসায় আপ্লুত হয়েছেন। তার ছোট ভাইদের এবং বোনকে নিয়ে তারা মায়ের সঙ্গেই কখনো ঢাকায় আবার কখনো গোপালগঞ্জে শৈশবকাল অতিক্রম করেছেন। পারিবারিক জীবনে ঝড়ঝাপটা তাতে অনেক নেমে এসেছিল। কিন্তু লেখাপড়া সামলিয়েছেন তাদেরই মা। এভাবেই শৈশব, কৈশোর এবং তরুণ বয়স তাদের কেটেছে রাজনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে। ফলে রাজনীতিকে তারা জন্মের পর থেকেই দেখেছেন, বুঝেছেন। কিন্তু তাদের পিতা বা মা কেউ তাদেরকে আলাদাভাবে রাজনীতিবিদ করে বড় করার প্রয়োজনীয়তা মনে করেননি। কারণ তাদের তখন বয়স ছিল লেখাপড়ার। শেখ হাসিনা লেখাপড়ার পাশাপাশি দেশের রাজনীতির উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে সময় অতিক্রম করছিলেন। বদরুন্নেছা কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপিও তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই সময়ের ছাত্র আন্দোলনের তিনি একজন ছিলেন। পিতা তার ছয় দফা প্রদানের কারণে জেলে ছিলেন। পিতার ইচ্ছাতেই ১৯৬৭ সালের ১৭ নভেম্বর মেধাবী গবেষক ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। দেশ তখন এক কঠিনকাল অতিক্রম করছিল। ওয়াজেদ মিয়াও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন ছাত্রনেতা ছিলেন। ফলে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে একাত্ম হলেন ওয়াজেদ মিয়াও। ড. ওয়াজেদ মিয়া দেশে-বিদেশে তখন আণবিক গবেষণায় কর্মরত ছিলেন। এরপর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে একদিকে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে পাকিস্তানের কারাগারে আটকে রাখে অন্যদিকে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ হাসিনা এবং পরিবারের সন্তানদের ধানমন্ডির একটি বাসায় বন্দি করে রাখে। সেখান থেকে পালিয়ে শেখ কামাল এবং শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শেখ হাসিনার প্রথম সন্তান জয়ের জন্ম হলো। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের মুখ দেখল। বঙ্গবন্ধু দেশের কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করলেন। শেখ হাসিনা স্বামীর সঙ্গে কখনো দেশে কখনো বিদেশে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু কখনো ভাবেননি রাজনীতিতে তার পারিবারিক উত্তরাধিকার রেখে যেতে হবে। সে কারণে তার কোনো সন্তানকেই তিনি সেভাবে রাজনীতির বড় জায়গায় নিয়ে আসার চেষ্টাও করেননি। সন্তানদের সবাই বঙ্গবন্ধু এবং তার রাজনীতি যেমন বুঝতেন, দেশ ও জাতির প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করতেন। তাদের কাউকেই আলাদা করে কিছু সেখানো বা বোঝানোর দরকার পড়েনি। শেখ হাসিনা নিজেও কখনো ভাবেননি তাকে পিতার রাজনীতির উত্তরসূরি হতে হবে। বঙ্গবন্ধু তখন জীবনের যেই পর্বে ছিলেন তখন তার সন্তানদের মাথায় তেমন কোনো চিন্তা আসার কারণ ছিল না। আর বঙ্গবন্ধুও সেই রাজনীতি করেননি যেখানে কৃত্রিমভাবে কোনো নেতা তৈরি করতে হবে। নিজেই তিনি রাজনীতির অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রপিতা এবং রাষ্ট্রনায়কের অবস্থানে উঠে এসেছিলেন। সুতরাং এমন রাজনীতিবিদের কল্পনাতেও রাজনীতির সেই পোড় খাওয়া অভিজ্ঞতার বাইরের কিছু চিন্তা করার কোনো কারণ ছিল না।

কিন্তু রাষ্ট্র ও রাজনীতি যখন ’৭৫-এর হত্যাকাণ্ড, ষড়যন্ত্র এবং ভয়াবহ রাজনৈতিক শূন্যতার বিপর্যয়ে পড়ে তখন অনেক কিছুই স্বাভাবিক নিয়মে বিবেচনা করলে চলে না। কারণ ষড়যন্ত্রকারীরা রাষ্ট্রক্ষমতায় তাদের অবস্থানকে কেবলই ক্ষমতা, অর্থ, সুবিধাবাদী এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিতে ভরিয়ে দিতে তৎপর থাকে। ’৭৫-এর পরবর্তী বছরগুলোতে বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকে পদপৃষ্ঠে হত্যা করার নীলনকশাই বাস্তবায়ন করে চলছিল, মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ রাষ্ট্র নির্মাণকারী রাজনৈতিক শক্তিকে। কারণ হত্যাকারীদের আশ্রয়দাতার অভাব ঘটে না দেশে ও বিদেশে। অর্থবিত্ত, আইন আদালত কেবলই তাদের পক্ষেই থাকে। গণতন্ত্র-মানবাধিকারের বিষয়গুলোর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মদদদাতারা মুখে তখন কুলুপ এঁটে থাকেন। বাংলাদেশ সেভাবেই তখন চলছিল। ’৭৫ সালে শেখ হাসিনা সন্তান ও ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে বিদেশে স্বামীর সঙ্গে থাকার জন্য গিয়েছিলেন বলেই বেঁচে গিয়েছিলেন। তাদেরকে আর দেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু ’৮১ সালে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যাকে তাদের সংগঠনের পুনর্জন্মের জন্য প্রয়োজন মনে করেছিল। সেটি যে এতটা কাজে লাগবে তা বোধহয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ তখন ভাবতে পারেনি। শেখ হাসিনাকে সভাপতি পদে নির্বাচিত করার ঘোষণাটি যদি আগে আগে দেওয়া হতো তাহলে আওয়ামী লীগের সম্মেলনই হয়তো পণ্ড করে দেওয়া হতো। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এমন একটি ঘোষণার কারণে নেতাকর্মী-সমর্থক এমনকি ’৭৫-এর পরবর্তী সময়ে যারা নীরবে নিভৃতে বঙ্গবন্ধুর অভাব জাতীয় জীবনে ধীরে ধীরে অনুভব করতে থাকেন, তারাও যেন উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিলেন। রাষ্ট্রশক্তি ঠিকই তাকে দেশে ফিরতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ’৭৫-এর ঘাতকরা ঢাকায় অস্ত্র উঁচিয়ে মহড়া দিয়েছিল। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নেমে আসতে দেখে অন্ধকারের হায়েনারা সেদিন ভয় পেয়েছিল। ১৭ মে বৃষ্টিভেজা বিকেলে শেখ হাসিনা তেজগাঁও বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করলেন। ঠিক ১০ জানুয়ারি ঢাকার মাটি বঙ্গবন্ধু স্পর্শ করলে যেমন বাংলাদেশ মুহূর্তের মধ্যে জেগে উঠেছিল, একইভাবে ১৭ মে, ১৯৮১ তে তাই ঘটলো। তবে তার দেশে ফেরা, রাজনীতির হাল ধরা, গণতন্ত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনার যাত্রাটি কোনোভাবেই সহজ কিংবা মসৃণ ছিল না। এটা কোনোভাবেই রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজারের ও came, I saw, I conquered মতো এত সহজ ব্যাপার ছিল না। সিজার ছিলেন যুদ্ধ বিজয়ী জেনারেল, তার ছিল সশস্ত্র বাহিনী। সে কারণে তার পক্ষে এমন উক্তি করা সহজ ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার হাতে কোনো সশস্ত্র বাহিনী ছিল না, ছিল একটি ভাঙাচোরা রাজনৈতিক দল ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী কিছু নির্ভীক মানুষ। অনেকেই ছিলেন আশপাশে, দূরে দূরে। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতায় এবং সমাজ ও রাজনীতিতে ততদিনে তার প্রতিপক্ষ গোষ্ঠী ছিল উগ্র, সশস্ত্র এবং অপপ্রচারকারী। ফলে তাকে ভয়ানক এক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রাজনীতির মাঠে নিয়মতান্ত্রিক ধারায় নিজের জায়গা করার পাশাপাশি জনগণের বৃহৎ অংশকে ঐক্যবদ্ধ করার এক কঠিন চ্যালেঞ্জ নিতে হয়েছিল। সেই চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা করে তাকে এগুতে হয়। তার প্রতিপক্ষরা তখন ক্ষমতার কলকাঠির মূলে ছিল। সে কারণেই আন্দোলন-সংগ্রামে দৃঢ় ভূমিকা রেখেও নির্বাচনে তার বিজয় নিশ্চিত করা বেশ কঠিন ছিল। ’৯৬ সালে সেই কঠিনেরে তিনি জয় করলেন। সেবার ক্ষমতায় এলেন তবে কঠিন কিছু চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করেই তাকে ৫ বছর দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। তখনই তিনি প্রমাণ দিয়েছিলেন যে তিনি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত রাজনীতির একজন ধারক-বাহক। কালো আইন ইনডেমনিটি তিনি বাতিল করলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দেশের প্রচলিত আইনেই শুরু করে দিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি করলেন, ভারত বিরোধিতার জিগির না তুলে ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি চুক্তি করলেন। তখনই দেখা গেল দেশে ’৭৫-পরবর্তী অপশক্তিরা কীভাবে ভারত বিরোধিতার জিগির তুলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। শান্তিচুক্তির ফলে যদি ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যায়, তেমন উদ্ভট কথা যে রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতার মুখে উচ্চারিত হলে সেটি লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী বিশ্বাস করে এবং লংমার্চ করে জানান দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে বুঝতে হবে এই অপশক্তির রাজনীতির আদর্শ ও উপজীব্য কি ছিল? এর সঙ্গে দেশ, জাতি এবং রাজনীতির গণতন্ত্রের কোনো ন্যূনতম সম্পর্ক থাকে কি? এটা তো সেই পাকিস্তান কালেরই অপপ্রচারকারীদের মহড়ার দৃশ্য ছিল। সেই অপশক্তির বিরুদ্ধেই তো শেখ হাসিনাকে লড়ে লড়ে প্রমাণ করতে হলো তার রাজনীতি ও প্রতিপক্ষের রাজনীতির পার্থক্যটা কোথায়? কিন্তু বাংলাদেশবিরোধী আর পাকিস্তানপন্থী ডান, বামরা এসবেই বুঁদ হয়েছিল এবং এখনো আছে। তাদেরই নেপথ্যের শক্তি ’৯১-এর নির্বাচনে কলকাঠি নেড়েছিল, ২০০১ সালেও জনগণের রায় উল্টে দিয়েছিল। এর পর আওয়ামী লীগ এবং অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে নিধনের যে মহোৎসব চলেছিল তা বাধা দেওয়ার যেন কেউ ছিল না! রাষ্ট্রশক্তি তখন ওইসব অপশক্তির প্রধান মিত্র ছিল। তারাই ২১ আগস্ট ঘটিয়ে আওয়ামী লীগকে শেখ হাসিনা এবং নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছিল। তাদের পথ আওয়ামীমুক্ত করতে চেয়েছিল। জামায়াতকে নিয়ে দেশকে একটি ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করতে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছিল। ২০০৭-এর জানুয়ারিতে নির্ধারিত নির্বাচনও একই লক্ষ্যেই তারা শেষ করতে চেয়েছিল। আজিজ মার্কা নির্বাচন কমিশন আর ইয়াজউদ্দিন মার্কা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দিয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার সব আয়োজনই একে একে সম্পন্ন করে যাচ্ছিল। নির্বাচন প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শেষ করা হচ্ছিল। বাদ সাধল ১/১১। সেটি আরেক স্বঘোষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সংবিধান আর তখন আইনের ভাষায় নেই, তত্ত্বাবধায়ক সরকারও তখন নির্বাসিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে তখন কত অপদার্থ এবং রিমোট কন্ট্রোল নির্ভরশীল হতে পারে, সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থাকার পরও তারাই আবার এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মাঠ গরম করছে। বাংলাদেশে সবই সম্ভব! এবং এসব অসম্ভবের পক্ষে অনেক যুক্তিহীন মানুষের সমর্থনও পাওয়া যায়।

২০০৮-এর নির্বাচনে শেখ হাসিনা বিপুল জনসমর্থন লাভ করতে পেরেছিলেন। এর মূলে ছিল ২০০১-পরবর্তী দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা এবং নির্বাচনে দিন বদলের সনদ নামক একটি রূপকল্প। এই রূপকল্প সম্পর্কে মানুষ হয়তো তখন ততটা উপলব্ধি করতে পারেনি। তবে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনার পরীক্ষায় যে সাফল্য দেখিয়েছিলেন, পরবর্তী সরকার যে ব্যর্থতা ও রাষ্ট্রকে লণ্ডভণ্ড করার হামলা, বোমাবাজি আর জঙ্গিবাদীদের নিয়ে উৎসব করেছিল সেই অভিজ্ঞতাই মানুষকে ২০০৮-এর নির্বাচনে এমন রায় দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। শেখ হাসিনা ২০০৯ সাল থেকে দেশের সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে এর সমাধানে যা যা করণীয় দরকার ছিল তা একে একে করছিলেন। তিনি বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধানে জরুরি পদক্ষেপ নিলেন। তাতে শিল্প উৎপাদন, ব্যবস-বাণিজ্য, গ্রামীণ অর্থনীতি এবং নাগরিক জীবন আলোয় উদ্ভাসিত হওয়ার পথ খুঁজে পেলো। এটি তিনি ’৯৬ সালেও করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার উদ্যোগ ২০০১-এর পর বন্ধ করে দেওয়া হলো। বাংলাদেশ অন্ধকারে থাকলে কিংবা ভিক্ষুকের দেশে পরিণত হলে ’৭৫ পরবর্তী শক্তির কোনো মাথাব্যথা থাকে না। কারণ তাদের ক্ষমতার মূলে থাকে বিদেশ থেকে পাওয়া অর্থ, ভারত-ভীতির জুজু দেখানো এবং ধর্ম চলে যাওয়ার মিথ্যাচার করা। সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গের বিষয়গুলো খুব কমই জানে। পাকিস্তানকাল থেকে তারা যেসব অপপ্রচার শুনে এসেছে, ’৭৫-এর পর থেকে তারা সেসব শুনেই বিশ্বাস করেছে। সে কারণেই দেশে বিদ্যুৎ আসেনি, অর্থনৈতিক উন্নতিও সাধারণ মানুষের জীবনে আসেনি, গ্রামে-গঞ্জে তেমন কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। মানুষকে অপপ্রচারে বুঁদ করে রাখার এক ট্যাবলেট তাদের হাতে ছিল। সেই ট্যাবলেট খাইয়েই ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু শেখ হাসিনা দেশের সর্বত্র বিদ্যুৎ, গ্রামীণ অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন, কৃষি, সার, বীজ সরবরাহের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন, শিল্প উৎপাদন, ব্যবস-বাণিজ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিক্ষায় পরিবর্তন, ডিজিটাল ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং বড় বড় মেগা প্রকল্প চালু করার মাধ্যমে গোটা দেশের চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছেন। যদিও শুরু থেকেই পথটা তার জন্য চ্যালেঞ্জে ভরপুর ছিল। বিডিআর বিদ্রোহ সংঘটিত করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা হয়েছিল। ২০১১-এর ডিসেম্বরের মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের অন্তরালে ছিল জামায়ত-শিবির এবং ছাত্রদলের ক্যাডারদের দিয়ে ‘আরব বসন্তের’ মতো দেশে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটানো। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার জন্য দেশে আস্তিক, নাস্তিকের এক কাল্পনিক অপপ্রচার চালিয়ে হেফাজতে ইসলামকে মাঠে নামিয়ে ৫ মে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত করার একটি পরিকল্পনাও বাস্তবায়নের চেষ্টা ছিল। সেটি ব্যর্থ হওয়ার পর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট ও প্রতিরোধের নামে ছিল ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে সরকার উৎখাতের মাধ্যমে আরেক ১/১১-এর সরকার ক্ষমতায় আনার পাঁয়তারা। এসব কিছুকে অতিক্রম করেই শেখ হাসিনাকে শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকা নয়, তার পরিকল্পিত আর্থ-সামাজিক রূপরেখাগুলো একে একে বাস্তবায়ন করতে হয়। ততদিনে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদায় উন্নীত হয়। এরপর দেশে নানা উন্নয়ন, মেগা প্রকল্প একে একে বাস্তবায়িত হতে থাকে। দেশ এখন পৃথিবীর ৩৫তম অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি লাভ করা দেশের তালিকায় আসে। আমাদের মাথাপিছু আয় ১৫ বছরে ৫ গুণ বৃদ্ধি পায়, অতি দারিদ্র্যের হার ৫-এর শতকে নেমে আসে। দেশে ভূমিহীন, আশ্রয়হীন মানুষরা এখন ঘর লাভ করছে, কর্মজীবী মানুষ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ এখন উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, সে কারণেই বিশ্বের পরাশক্তিগুলো এখন বাংলাদেশকে নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিদেশি শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দেশে আসছেন, সমুদ্রসীমানায় তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, নৌপরিবহনের সুবিধা চাচ্ছে। এই সীমানাও শেখ হাসিনাই আইনত উদ্ধার করতে পেরেছেন। বাংলাদেশ ১৫ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যা দেখছে তার অনেক কিছুই ১৫ বছর আগে কল্পনা করতে পারেনি। পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে হবে এ কথা এদেশের অর্থনীতিবিদরাই কল্পনা করতে চাননি। কিন্তু শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের উত্তরাধিকার রাজনীতির ধারক হওয়ার কারণে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার মাটি আছে, মানুষ আছে। তাই সোনা ফলানো এ দেশেই সম্ভব। বঙ্গবন্ধুর এই অমর উক্তিতে জাতির মুক্তি নিহিত রয়েছে। সেটি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি এখন বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দুর্ভিক্ষমুক্ত, উন্নত ও সমৃদ্ধিশালী এক রাষ্ট্রে পরিণত করার নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

৪২ বছরের সক্রিয় রাজনীতির অভিজ্ঞতা নিয়ে শেখ হাসিনা ২০ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশকে এক অপার সম্ভাবনার দেশে পরিণত করার উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। তার রাজনীতি হচ্ছে জনকল্যাণবাদী রাষ্ট্রগঠন, অসাম্প্রদায়িক জাতিরাষ্ট্রের যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন সেটির যথার্থ উপস্থাপনা। শেখ হাসিনার ৭৫ বছরপূর্তিতে বাংলাদেশের যে বিশ্বআসন তৈরি হয়েছে সেটিকে আরও ঊর্ধ্বে তুলে ধরার রাজনীতি এখন আওয়ামী লীগ এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনীতিবিদদের আরাধ্য হওয়া উচিত।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :