বাংলাদেশের অর্জন বিস্ময়কর

মো. খসরু চৌধুরী সিআইপি
| আপডেট : ২৫ নভেম্বর ২০২৩, ১০:৩৩ | প্রকাশিত : ২৫ নভেম্বর ২০২৩, ১০:১৮

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয়ের পর ৫২ বছর কেটে গেছে। একটি জাতির জন্য ৫২ বছর খুব বড়ো কিছু নয়। শত শত বছর ধরে ভিনদেশিদের দ্বারা শাসিত ও শোষিত হয়েছে বাংলাদেশ। একসময় পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, বুড়িগঙ্গা পাড়ের জনপদ ছিল বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশ। কর্নাটক থেকে আসা সেনা এবং তুর্কি, পাঠান, মুঘল শাসকরা এ দেশকে তাদের স্বদেশ বলে গ্রহণ করলেও বাঙালিরা শাসকের অবস্থান থেকে দূরে ছিল শত শত বছর ধরে। ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর বাংলাদেশ পাকিস্তান নামের কিম্ভূতকিমাকার রাষ্ট্রের অংশে পরিণত হয়। জনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও পাকিস্তান আমলের ২৩ বছর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের দ্বারা বাঙালিদের শাসিত ও নির্যাতিত হওয়ার ইতিহাস। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি জাতির বিজয় সে কালো অধ্যায়ের অবসান ঘটায়। মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও গত ৫২ বছরে বাংলাদেশের অর্জন বিস্ময়কর।

বিশ্বে বাংলাদেশকে পরিচিত করার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে তৈরি পোশাক (গার্মেন্ট) শিল্প। পৃথিবীতে এখন এমন কোনো দেশ নেই যেখানে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ লেখা পোশাক পাওয়া যায় না। গার্মেন্ট রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। পোশাকের পাশাপাশি বাংলাদেশের ওষুধ এখন ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার ৮০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। দেশীয় ওষুধ কারখানাগুলো দেশের মোট চাহিদার শতকরা ৯৭ ভাগ ওষুধ জোগান দিচ্ছে। বাংলাদেশের তৈরি ওষুধ জীবন বাঁচাচ্ছে বিশ্বের আনাচে-কানাচের মানুষের। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশি তরুণ-যুবারাই তৈরি করছে বিভিন্ন দেশের গর্বের কাঠামো, ঘুরিয়ে দিচ্ছে তাদের অর্থনীতির চাকা।

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অবস্থান অগ্রগণ্য। যুদ্ধবিগ্রহের বিশ্বকে হেলমেট মাথায় দিয়ে বুক চিতিয়ে রক্ষা করছে বাংলাদেশের দুর্বার সেনারা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে প্রথম। ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনের ৮৬ শতাংশই হয় এ দেশে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। পাট উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। তবে পাট রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশই প্রথম। ছাগল উৎপাদনেও অবস্থান চতুর্থ। আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে পঞ্চম। আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ষষ্ঠ। চা উৎপাদনে অবস্থান নবমে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে আম উৎপাদনে অষ্টম। কাঁঠাল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে। পেয়ারা উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অষ্টম। সার্বিক ফল উৎপাদনে রয়েছে দশম অবস্থানে। গবাদিপশু পালনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে দ্বাদশ অবস্থানে রয়েছে।

রেমিট্যান্স গ্রহণকারী দেশের তালিকাতেও বাংলাদেশ আছে শীর্ষ দশে। বর্তমানে প্রায় সোয়া কোটি প্রবাসী বাংলাদেশির প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন অষ্টম। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ছয় লাখ, যা শতকরা হারে বিশ্বের প্রায় ২৭ শতাংশ। এই বদৌলতে বাংলাদেশ এ খাতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে কটাক্ষ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন মার্কিন মদদপুষ্ট বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার সবচেয়ে বড়ো প্রকল্প পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছে নিজস্ব অর্থায়নে। স্বাধীনতার মাত্র ৫২ বছরে এই পরিবর্তন বাংলাদেশের। পাকিস্তানের চেয়ে এখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। অনেক ক্ষেত্রে ভারত-চীনের থেকেও এগিয়ে। স্বাস্থ্য-শিক্ষার দিক দিয়ে ছাড়িয়ে গেছে ভারত-পাকিস্তানকে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জিডিপি ও মাথাপিছু জিডিপিতে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। গ্রস সেভিংস জিডিপিতে ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ শীর্ষে। শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভারত-পাকিস্তানের তুলনায় অনেক উচ্চতায় বাংলাদেশ। জন্মহার নিয়ন্ত্রণে প্রতিবেশীদের গড় আয়ুর ক্ষেত্রেও ভারত-পাকিস্তান দুই দেশের তুলনায় এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ।

মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের এই ঢল নামলে সীমান্ত খুলে দেয় বাংলাদেশ। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এই বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে এক নতুন মানবিক পরিচয় পায় বাংলাদেশ। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে বাংলাদেশের মানবিকতার প্রশংসা আসছে এখনো। আজকের বিশ্বে এত বিপুল সংখ্যক আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও জায়গা পেত কি-না এ নিয়ে সংশয় আছে সবারই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও এক সংকটকাল অতিক্রম করছে। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছিল। সেই বাধা অতিক্রম করে নতুনভাবে পথচলা শুরু করতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেখা দেয় নতুন সংকট। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো মূল্যস্ফীতির ধাক্কা লাগে দেশের অর্থনীতিতেও।

বৈশ্বিক সংকট যখন অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণ হয়, তখন সেই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে। ইউরোপের অনেক দেশই এখনো এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশ মোটামুটিভাবে সংকট কাটিয়ে ওঠার পথে রয়েছে। সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সংকট উত্তরণের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলার কথা উল্লেখ করে বর্তমান বৈশ্বিক সংকট উত্তরণের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি। জনগণকে গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের বিনিয়োগ, রেমিট্যান্সপ্রবাহ এবং আমদানি-রপ্তানি পরিস্থিতি- সবকিছু স্বাভাবিক রয়েছে। বাংলাদেশ খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, গত ১৪ বছরে দেশ আর্থসামাজিক উন্নয়নের এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে পেরেছে। আজকের বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ঐক্য ছিল সবচেয়ে জরুরি। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা মুখে যতই গণতন্ত্রের কথা বলি না কেন, আমাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব এখন পর্যন্ত রয়ে গেছে। অতীতেও এমনটি দেখা গেছে যে, যখনই একটু একটু করে স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়েছে বাংলাদেশ, প্রতিবারই হোঁচট খেয়েছে। কখনো কখনো রাজনীতি উন্নয়নের প্রতিপক্ষ হয়েছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখনই জটিল হয়েছে, তখনই ত্বরান্বিত হয়েছে অর্থনীতির ক্ষতি। রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে কখনো কখনো জঙ্গি তৎপরতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বেড়েছে সাধারণ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডও।

আমাদের ভাবতে ভালো লাগে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করে। দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। বেড়েছে সাক্ষরতার হারও। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পেয়েছে। এখন নির্বিঘ্নে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার মতো পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তবে সব রাজনৈতিক দলেরই দায় ও দায়িত্ব রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশের মানুষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের ইতিবাচক সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছে। এটা ঠিক যে, গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত ও সুসংহত করতে হলে বহুমতের রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচি যেন কোনোভাবেই অর্থনীতি ও জননিরাপত্তার প্রতিপক্ষ হয়ে না দাঁড়ায়, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে সচেতন থাকতে হবে। রাজনীতি পরিচালিত হোক জনস্বার্থে, এর চেয়ে বড়ো প্রত্যাশা মানুষের নেই। রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় নতুন করে পরিবর্তন আনতে হবে। গণমানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিঘ্ন ঘটায় এমন কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে এসে জনসম্পৃক্তি বাড়ানোর দিকে রাজনৈতিক দলগুলোকে সচেষ্ট হতে হবে। আর তাতেই জনগণের মঙ্গল। মনে রাখা দরকার, আদর্শচ্যুত রাজনীতি সমাজ ও রাষ্ট্রকে কিছু দেয় না। রাজনীতি পচনশীল হলে রাষ্ট্র উন্নয়নের বদলে উল্টোপথে হাঁটে। সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি সুস্থ গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। উন্নয়নের স্বার্থেই সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণে ভূমিকা রাখতে হবে।

লেখক: রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা। শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :