ড. ইউনূসের মামলায় বিচার বিভাগীয় রায় মন্টেস্কুর চেতনার উপর ১২ মার্কিন সিনেটরের কুঠারাঘাত

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী
 | প্রকাশিত : ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০১

দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার ১০০ সদস্য বিশিষ্ট উচ্চকক্ষ সিনেটের ১২ জন সদস্য ফরাসি পণ্ডিত মন্টেস্কু প্রণীত ‘সাংবিধানিক সরকার ও ক্ষমতা স্বন্ত্রীকরণ নীতি’র মূলে কুঠারাঘাত করতেও দ্বিধাবোধ করলেন না! এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ। পাশাপাশি এটি তাদের ষড়যন্ত্র এবং নিজেদের দাম্ভিকতার বহিঃপ্রকাশ। এই বিষয়টি এখন বাংলাদেশের মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে! গত ২২শে জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে মার্কিন সিনেটের ১২ জন সদস্য, রিচার্ড জে. ডারবিন, টড ইয়াং, টিম কাইন, ড্যান সুলিভান, জেফার এ. মার্কলে, এডওয়ার্ড জে. মার্কে, জীন শাহীন, পিটার ওয়েলস, শের্ড ব্রাউন, শেলডন হোয়াইটহাউস, রন ওয়াইডেন এবং করি এ. বুকার বাংলাদেশের আদালতের বিচারে দণ্ডিত ড. ইউনূসের বিচার (তাদের ভাষায় হয়রানি) না করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পত্র প্রেরণ করেছেন। এই পত্রে মার্কিন সিনেটের এই ১২জন সদস্য ড. ইউনূসের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। কিন্তু ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে বা তিনি তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিকদের যে বঞ্চিত করেছেন এবং সেই বঞ্চনার প্রতিকার চেয়ে এইসব শ্রমিকেরা যে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন- সে ব্যাপারে ১২ জন সিনেটর একদম চুপ! সেগুলোকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পাশ কাটিয়ে গিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষকদের মনে একটি ব্যাপার খুব জোরেশোরে নাড়া দিচ্ছে; আর তাহলো মন্টেস্কুর সাংবিধানিক সরকার এবং ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূলে এই ১২ জন মার্কিন সিনেটর কী কারণে কুঠারাঘাত করলেন!

ফরাসি পণ্ডিত, বিচারক, ইতিহাসবিদ এবং রাজনৈতিক দার্শনিক মন্টেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫)’র দ্য স্পিরিট অফ লজ (১৭৪৮)-এর চেতনা গ্রেট ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমাদৃত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের খসড়া তৈরিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জনকগণ প্রভাবিত হয়েছিলেন মন্টেস্কুর এই চেতনার দ্বারা।

১৭৪৮ সালে প্রথমে ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত ‘লা এসপিরিট ডি লইস’ (স্পিরিট অব লজ) শীর্ষক গ্রন্থে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ, বৈধতা এবং নাগরিক স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং দাসত্বের অবসানসহ একটি সাংবিধানিক সরকার ব্যবস্থার জন্য মন্টেস্কু আবেদন করেন। তাকে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ তত্ত্বের প্রধান উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়। যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের অনেক সংবিধানে বাস্তবায়িত হয়েছে। মন্টেস্কু’র ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি (অর্থাৎ আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ স্বতন্ত্র থেকে নিজস্ব এখতিয়ারের মধ্যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে) বাংলাদেশে সুষ্ঠুভাবে বলবত থাকুক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের এই ১২ জন সদস্য তা কি চান না?

দু’জন অবৈধ সামরিক একনায়ক জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের শাসনামল এবং তাদের সৃষ্ট রাজনৈতিক দলের শাসনকাল ব্যতীত বাংলাদেশ একটি সাংবিধানিক সরকার দ্বারা পরিচালিত হয়েছে এবং হচ্ছে। মন্টেস্কু এই সাংবিধানিক সরকার এবং সরকারের ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রধান প্রবক্তা। আমরা ছাত্র জীবনে ফরাসি জুরিস্ট মন্টেস্কুর ১৭৪৮ সালে প্রকাশিত বই-এর উপজীব্য ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি পড়েছি। আইন, সামাজিক জীবন এবং নৃবিজ্ঞানসহ অন্যান্য বিস্তৃত বিষয় সম্পর্কিত এই বই প্রস্তুত করতে মন্টেস্কু প্রায় দশ বছর গবেষণা এবং লেখার জন্য ব্যয় করেছেন।

ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বলতে একটি রাষ্ট্রের সরকারকে তিন ভাগে বিভক্ত করাকে বোঝায়। প্রতিটি বিভাগের আলাদা, স্বাধীন ক্ষমতা এবং দায়িত্ব রয়েছে। এতে একটি বিভাগের ক্ষমতা অন্য বিভাগের সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়ার ব্যাপারেও ‘চেক্স এন্ড ব্যালান্স’-এর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সরকারের এই তিনটি বিভাগের সাধারণ বিভাজন, কখনও কখনও ‘ট্রায়াস পলিটিকা মডেল’ নামে পরিচিত। এই তিনটি বিভাগ হচ্ছে আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ।

বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২২, ২৬, ৫৫, ৬৫, ৯৪(৪), ১০৭, ১০৯ এবং ১১৬ক অনুযায়ী আমরা বলতে পারি যে, বাংলাদেশের সংবিধানে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের মতবাদ সুপ্রতিষ্ঠিত। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম তিনটি অনুচ্ছেদ, আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ আমাদের সরকারের তিনটি আলাদা আলাদা বিভাগ হিসেবে গঠিত। সংবিধান স্পষ্টভাবে একটি বিচার বিভাগের ভিত্তি স্থাপন করে যা সরকারের অন্যান্য বিভাগ থেকে পৃথক এবং স্বাধীন।

বিচার বিভাগ এবং সমগ্র বিচার ব্যবস্থার দক্ষতা মূলত বিচার বিভাগের স্বাধীনতার উপর নির্ভর করে এই সত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানে এটি সন্নিবেশিত হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের এইরূপ বিন্যাস অনুসারে যে বিচারিক আদালতগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়ে দীর্ঘকাল যাবৎ ক্রিয়াশীল তার প্রতি কোনোরূপ সম্মান প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তা ১২ জন সিনেটর করেন নাই। বিচারবিভাগের রায়কে তারা নির্বাহী বিভাগের প্রধান প্রধানমন্ত্রীর উপর উদ্যেশ্যপ্রণোদিতভাবে আরোপ করেছেন! বাংলাদেশের মানুষ এ ধরনের কুমতলবপ্রসূত তৎপরতাকে তীব্রভাবে নিন্দা জানিয়ে প্রত্যাখ্যান করছে।

ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নিশ্চিত করার জন্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার তিনটি বিভাগ নিয়ে গঠিত হয়েছে দেশটির আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ এবং বিচার বিভাগ। সরকার কার্যকর এবং নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত নিশ্চিত করতে, প্রতিটি শাখার নিজস্ব ক্ষমতা এবং দায়িত্ব রয়েছে। অন্য যেকোনো ধর্মনিরপেক্ষ লেখকের তুলনায় ১৭৬০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত সময়কালে মার্কিন সংবিধানের প্রণেতাগণ মন্টেস্কুর লেখা সম্পর্কে বেশি বেশি চর্চা করতেন। বিশেষ করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং দাসত্বের কুফলগুলিকে টিকিয়ে রাখার সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষেত্রে। মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ এবং ‘বাধা দেওয়া ও ভারসাম্য রক্ষা’ (চেকস এন্ড ব্যালান্স)-এর আলোচনা আমেরিকান প্রতিষ্ঠাতাদের এবং মার্কিন সংবিধানের নক্শাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

আধুনিক যুগে ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল প্রবক্তা মন্টেস্কুর একান্ত অনুসারী একটি দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতি বাংলাদেশের সংবিধানেও অনুসৃত। বাংলাদেশের বিচার বিভাগে দায়েরকৃত ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে উত্থাপিত প্রমাণিত মামলাগুলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১২ জন সিনেটর, “অপ্রমাণিত মামলা” হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সিনেটরদের পত্রে এভাবে প্রমাণিত মামলাকে “অপ্রমাণিত” বলা সত্যের অপলাপ, মন্টেস্কুর নীতির পরিপন্থী এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নগ্ন হস্তক্ষেপ। এ সম্পর্কে শক্তিশালী মতামত প্রদান করা হচ্ছে বাংলাদেশের অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষক মহলের পক্ষ থেকে।

মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রতি সিনেটরদের এই চিঠি এ কারণে কুঠারাঘাত যে, তারা তাদের চিঠিটি দিয়েছেন বাংলাদেশে নির্বাহী বিভাগের প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে। যিনি বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। যেসব আদালতে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলাগুলো হয়েছিল সেইসব আদালতের বিচারপতিদের কাছে যদি এই চিঠিটি দিতেন তাহলেও এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের দোষে দুষ্ট হিসেবে গণ্য করা হতো। যদিও মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভিন্ন ধরনের আঘাত হিসেবে বিষয়টি বিবেচনা করার সুযোগ থাকত! এভাবে বাংলাদেশের বিচার বিভাগের মর্যাদাহানিকর এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ মার্কিন সিনেটের ১২ জন সদস্যের পত্রের প্রতি তীব্র নিন্দা জানিয়ে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ এটিকে প্রত্যাখ্যান করছে।

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :