আজো বাংলা ভাষা অনাদরেই লালিত হচ্ছে

আলী রেজা
  প্রকাশিত : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:১৯
অ- অ+

বাঙালির ভাষা কোনোকালেই মর্যাদা পায়নি। তবে নিজেদের ভাষার প্রতি এই অমর্যাদা বাঙালি জাতি কখনো নীরবে সয়েও যায়নি। ব্রিটিশ শাসনামলেই বাঙালি জাতির মনে জাতীয়তাবাদী চেতনা দানা বেঁধে ওঠেছিল। ব্রিটিশ শাসনের অবসানে সেই চেতনা আরো সমৃদ্ধ হয়েছে। এই সমৃদ্ধ চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে পূর্ব বাংলার মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী ও নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষ ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করলো। শাসকগোষ্ঠীর সকল অপকৌশলকে ধূলিস্মাৎ করে বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারিকে করে তুললো জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের প্রথম মাইলফলক। বাঙালির ভাষা বাংলা পেল রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা।

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল খুবই স্বাভাবিক ও যৌক্তিকভাবে। পাকিস্তানের ভাষাভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলা ভাষাভাষী লোকের সংখ্যা ছিল ৫৬.৪০%। এই ৫৬.৪০% মানুষের ভাষা বাংলার পরিবর্তে ৩.২৭% মানুষের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার করার পরিকল্পনা ছিল অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক ও উদ্দেশ্যমূলক। তাই হয়তো সেই অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে যুগে যুগে যারা বাঙালিকে শাসন করেছে, শাসনের নামে শোষণ করেছে তারা কেউ বাঙালির ভাষা বাংলাকে মর্যাদা দেয়নি। বাংলা কখনো শাসক শ্রেণির আনুকূল্য পায়নি। কারণ একটাই, একাত্তরের পূর্বে বাঙালি কখনো শাসক ছিল না। তাই শাসক শ্রেণি বাঙালির ভাষাকে কখনো রাজভাষার মর্যাদা দিতে চায়নি। শাসক শ্রেণি সব সময় চায় শাসিত শ্রেণি থেকে দূরে থাকতে। এই দুরত্ব দূরে গিয়ে সৃষ্টি করার প্রয়োজন হয় না। একসাথে থেকেই বোঝাতে হয় আমরা শাসক আর তোমরা শাসিত। আমরা রাজা আর তোমরা প্রজা। তাই রাজভাষা কখনো আমজনতার ভাষা হয় না। আমজনতা যেমন রাজাকে সমীহ করে তেমনি রাজভাষাকেও সমীহ করে। এই সমীহ করার বিষয়টা আমজনতার মগজে এমনভাবে স্থিত হয়ে গেছে যে, তারা আর সেটা মুছে ফেলতে পারছে না।

একাত্তরে বাঙালির বিজয় হয়েছে। বাংলাদেশ বাঙালির হয়েছে। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। যদিও অফিসিয়ালি বাংলা ভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছে পাকিস্তান আমলেই। তবে স্বাধীন বাংলাদেশেই বাংলা ভাষা পেল জাতীয় ভাষার সম্মান। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিলেন। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের উদ্যোগ নিলেন। কিন্তু এ সম্মানও শেষমেশ টেকসই হলো না। পঁচাত্তরের মধ্যআগস্টে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। নতুন করে শাসকশ্রেণি হিসেবে যারা আবির্ভূত হলেন তারা শাসিত জনগণ থেকে মানসিক দুরত্ব রক্ষা করে চলা শুরু করলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে উৎসারিত ‘বাংলাদেশ বেতার’কে করলেন ‘রেডিও বাংলাদেশ’। যুগে যুগে শাসক শ্রেণির আলাদা ভাষা ছিল। তুর্কিরা তাদের ভাষা নিয়ে এসেছিল, আফগানরা তাদের ভাষা নিয়ে এসেছিল, মোগলরা তাদের ভাষা নিয়ে এসেছিল, ইংরেজরাও তাদের ভাষা নিয়ে এসেছিল, পাকিস্তানিরাও শাসন করার জন্য চাপিয়ে দিয়েছিল ইংরেজি ও উর্দু। প্রত্যেক শাসকগোষ্ঠীই আলাদা ভাষা দিয়ে তাঁদের রাজসম্মান প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু বাঙালিই যখন বাঙালির শাসক হলো তখন সে আলাদা ভাষা কোথায় পাবে। শাসক ও শাসিতের ভাষা এক হবেই-বা কী করে। তাই ‘বেতার’ থেকে ‘রেডিও’তে এলেন। ভাষা আন্দোলনের ভ্রুণ থেকে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশে তো উর্দু চালাতে সম্ভব নয়। তাই অগত্যা ইংরেজির আশ্রয় নেওয়া হলো। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলেও রাজসম্মান থেকে বিস্মৃত হয়ে সাধারণ মানুষের ভাষাই হয়ে রইল। উচ্চ আদালতে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, উচ্চতর দাপ্তরিক কাজে আবার ইংরেজির কদর বাড়তে থাকলো। তারই ধারাবাহিকতায় এখনও অনেকে ইংরেজিতে দু’কথা বলে নিজের আভিজাত্য প্রদর্শন করতে চায়।

বাংলা ভাষার স্মৃতি বিজড়িত একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। বাংলায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষা এখন বিশ্বঐতিহ্যের দলিল হিসেবে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্ত। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক জাতিসংঘে প্রদত্ত বাংলায় ভাষণ আজ বিশ্ব-ইতিহাসের অংশ। তারও অনেক আগে (১৯১৩) বাঙালি কবি, বাংলা ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার অর্জন বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু তারপরও আবহমান বাংলার দুঃখিনী মায়ের মতো হাজার বছর ধরে বাঙালির ভাষা অনাদরে, অবহেলায়, অমর্যাদায়। নিবিড় পল্লিতে মায়ের আদরে, মায়ের শাসনে লালিত সন্তানটিই মাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। মায়ের কোল ছেড়ে যাওয়া শহুরে সন্তানটি উচুঁতে উঠতে উঠতে একসময় মাকে ভুলেই যায়। একই কথা খাটে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে। আমার এক শিক্ষক বলেছিলেন, বাঙালি দু’শ বছর ইংরেজের অধীনে ছিল, আর ইংরেজি ভাষার অধীনে থাকতে হবে অনন্তকাল। এটা বাঙালির মানসিক দীনতা।

এক শ্রেণির বাঙালি মানসিক দীনতা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে নিজে যেমন পূর্ববর্তী শাসক শ্রেণির ভাষার প্রতি অতিভক্তি প্রদর্শন করে তেমনি নিজের সন্তানদেরও শাসক শ্রেণির মতো করে গড়ে তুলতে চায়। ঔপনিবেশিক শিক্ষা বাঙালির সেই মনোভাবকেই ধারণ করে প্রণীত হয়েছিল। সাথে যোগ হয়েছিল পুঁজিবাদী চিন্তা-চেতনা। তাই ঔপনিবেশিক শিক্ষায় বাঙালি মহৎ হয়নি, বৃহৎ হওয়ার দিকেই ঝুঁকে পড়েছে। আমাদের সন্তানরা শিখেছে ‘লেখাপড়া করে যে/ গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে’। বাবা-মা, দাদা-দাদির কাছে এই বাক্যটি শুনতে শুনতে বড়ো হয়েছে আমাদের সন্তানরা। তাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়া। গাড়ি-ঘোড়ায় চড়তে হলে টাকা রোজগার করতে হবে। ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে টাকা রোজগার করা। বৈধ কিংবা অবৈধ- যেকোনো উপায়েই হোক। এই শিক্ষা আমাদের যতটা উপরে তুলেছে ততটা নিচেও নামিয়েছে। আমরা শেকড়কে দুর্বল করেছি। তাই শিখরে উঠতে পারিনি।

আমরা স্বাধীনতা অর্জন করে শাসক হতে চেয়েছি। শাসক হয়েছিও। কিন্তু শাসনের হাতিয়ার আনতে হয়েছে বাইরে থেকে। নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি যে শোষিত শ্রেণির ভাষা-সংস্কৃতি তা আমরা কখনো ভুলতে পারিনি। তাই মনে করেছি এই ভাষা দিয়ে শাসন চলে না। বাংলার কবি মধুসূদন দত্ত ফ্রান্সে বসেও বাংলা ভাষায়ই লিখেছেন। তারও আগে কবি আবদুল হাকিম বাংলা ভাষার শত্রুদের বিদেশে চলে যেতে বলেছেন (দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়/ নিজ দেশ তেয়াগি কেন বিদেশে ন যায়’- আবদুল হাকিম, বঙ্গবাণী)। রবীন্দ্রনাথও তাঁর মেঝদাদার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি। তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আমার ছেলেবেলা)। কিন্তু এসবকে কোনো কাজের মনে করেনি জাতে ওঠার জন্য মরিয়া বাঙালি সমাজ। বাংলা ভাষাকে দূরে রেখেই বাঙালি অভিজাত হতে চেয়েছে।

বাংলা শুধু একটি ভাষা নয়; বাংলা একটি ভূখণ্ড, বাঙালি একটি জাতিসত্তা। একটি ভাষা একটি জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের সঙ্গে এমন অবিচ্ছিন্নভাবে মিশে থাকার নজির মানবজাতির ইতিহাসে খুব একটা নেই। তাই বাংলা ভাষার সাথে বাঙালির সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের মতোই দৃঢ়। তবে বাঙালির রক্তও তো মিশ্র। তাই সম্পর্কের অবনতি ঘটতেও সময় লাগে না। তাই বাঙালির ভাষাপ্রীতির ইতিহাস যেমন আছে তেমনি ভাষার প্রতি অবজ্ঞার ইতিহাসও আছে। বাংলা ভাষার শত্রু শুধু বাইরে নয়, ভেতরেও ছিল। আজও আছে। ভেতরের শত্রুই বেশি ক্ষতিকর। ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ কথাটি বাঙালি সমাজে এমনিতেই এত জনপ্রিয় হয়নি। আরবি হরফে বাংলা লেখার একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের সাথে কিছু ঘরের লোকও জড়িত ছিল। রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ হলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে- এটা জেনেও শাসকগোষ্ঠীর সিদ্ধান্তের (১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত হয়) সাথে একমত পোষণ করে বিবৃতি দেন একদল বাঙালি বুদ্ধিজীবী। এরাও বাংলা ভাষার ঘরের শত্রু।

বিশ্বায়নের এই যুগে ভাষা ও সংস্কৃতির আদান-প্রদানের প্রয়োজনীয়তা আমি দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করি। স্বীকার করি আমাদের নতুন প্রজন্মকে বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠতে হবে। তাই বলে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে নয়। শেকড় দুর্বল হলে বৃক্ষ খুব বড়ো হওয়ার আগেই উপড়ে পড়ে। আমাদের ভাষাপ্রীতি এখন একুশে ফেব্রুয়ারিতে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। একুশের আনুষ্ঠানিকতার অলংকার হয়ে উঠছে বাংলা ভাষা। সারা বছরের দায়বদ্ধতা এড়ানোর জন্য ফেব্রুয়ারিকে আমরা বানিয়েছি ভাষার মাস। তাই শুধু ফেব্রুয়ারি এলেই আমাদের বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক ও সচেতন মহল জেগে ওঠেন। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিয়ে কথা বলেন। আমরা বিশুদ্ধ বাঙালি হয়ে ওঠার চেষ্টা করি। বাংলা বর্ণমালা খচিত পোশাক পরি। আমাদের সন্তানদের বাঙালি বানানোর উৎসবে মেতে উঠি। কিন্তু ফেব্রুয়ারি চলে গেলেই আমরা বাঙালিয়ানার সেই খোলস ছুড়ে ফেলে দেই। রক্ত দিয়ে কেনা ভাষার প্রতি এমন অনাদর প্রকৃত বাঙালিকে ব্যথিত করবেই।

ভাষা আন্দোলনের সাত দশক ও স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেছে। কিন্তু বাংলা ভাষার মর্যাদা বেড়েছে কি? আজও আমরা শুদ্ধ বাংলায় কথা বলি না। আজও আমরা ভুল বানান ব্যবহার করে বা ব্যবহৃত হতে দেখে বিচলিত হই না। ভাষার সৌন্দর্য নষ্ট হলে আমরা কষ্ট পাই না। একটি আদরে লালিত ভাষা ঐ ভাষাভাষীদের মধ্যে যেমন আত্মার বন্ধন সৃষ্টি করতে পারে তেমনি একটি অবহেলিত ভাষা ঐ ভাষাভাষীদের মধ্যে কোনো আত্মিক বন্ধন সৃষ্টি করতে পারে না। হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষা ছিল শাসক শ্রেণির কাছে অবহেলিত। অতীতে বাঙালি জাতির শাসকগোষ্ঠীরা বাঙালি ছিল না। কিন্তু এখন বাঙালি জাতি আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন করেছে। এখনও বাংলা ভাষা আদরে লালিত হচ্ছে না কেন?

আলী রেজা: কলেজ শিক্ষক, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বেনাপোল সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশের সময় দুজন আটক
সচিবালয় ও যমুনার আশপাশে সভা-সমাবেশে  নিষেধাজ্ঞা
জেডআরএফ’র ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোর্শেদ
শ্রীপুরে ফুটবল খেলা নিয়ে দ্বন্দ্বে ছুরিকাঘাতে স্কুলছাত্র খুন
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা