গ্রুপ ঋণ নিয়ে সব টাকা আত্মসাৎ দলনেত্রীর, ৪৬ সদস্যের বিরুদ্ধে নোটিশ

সৈয়দপুর (নীলফামারী) প্রতিনিধি, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৩:১৪ | প্রকাশিত : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:৪৪

সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রুপ ঋণ নিয়ে সব টাকা আত্মসাৎ করেছেন দলনেত্রী। অথচ সেই ঋণকে ব্যক্তিগত দেখিয়ে তা খেলাপি হওয়ায় দ্রুত পরিশোধের তাগিদে নোটিশ দেয়া হয়েছে ৪৬ জন নারীকে। যাদের কেউই ওই ঋণ নেননি বা টাকা পাননি। এমনকি কেউ কেউ সমিতির সদস্যও না। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

দরিদ্র অসহায় নারীদের জিম্মি করে মোটা অংকের টাকা আত্মসাৎ করতেই এই অভিনব কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। উদোর পিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপিয়ে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার এমন তুঘলকি কাণ্ডে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। কর্মকর্তা ও দলনেত্রী পরস্পরকে দোষারোপ করে দায়ী করলেও মূলত: হয়রানির শিকার হয়েছেন ওই নারীরা। আইনি ঘোরপ্যাঁচ না বুঝে পরিবারসহ জেল জরিমানার আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন তারা।

সরেজমিনে মঙ্গলবার সকালে নীলফামারীর সৈয়দপুরে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয় থেকে দুই বছর আগে উপজেলার কাশিরাম বেলপুকুর ইউনিয়নের সাতপাই কাগজীপাড়ার নীলপল্লী মহিলা উন্নয়ন সমিতির সদস্যদের নামে ৫ লাখ টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। এই ঋণের টাকা ৪৬ জন দরিদ্র নারীর নামে পৃথক পৃথক ভাবে চেক প্রদানের মাধ্যমে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলা হলেও চেকগুলো সব দলনেত্রী তথা ওই নীলপল্লীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক (মালিক) উপজেলার বিশিষ্ট নারী নেত্রী হিসেবে পরিচিত কামরুন্নাহার ইরাকেই এককভাবে দিয়েছেন মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা।

সেই টাকা উত্তোলন করে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম চালাচ্ছেন ইরা। কিন্তু যাদের নামে ঋণ নেয়া হয়েছে সেই নারীরা কেউ জানেন না যে তাদের নামে ১৫ হাজার করে টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে। দীর্ঘ দুই বছর পর মহিলা অফিস থেকে ঋণ পরিশোধ না হওয়ায় আইনি পদক্ষেপ নেয়ার নোটিশ দেয়া হলে তারা জানতে পারেন বিষয়টি।

এলাকার মিজানুর রহমানের স্ত্রী মুক্তা বানু বলেন, আমরা অনেক নারী কাজ শিখে নীলপল্লী মহিলা উন্নয়ন সমিতির অধীনে কারচুপি, নকশিকাঁথা, পাটের তৈরি বিভিন্ন শৌখিন পণ্য, পোশাকে হাতের সেলাই কাজ করে উপার্জন করছি। পাশাপাশি হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করি। মাঝে মাঝে এই সমিতি থেকে ক্ষুদ্র ঋণও নেই। কিন্তু কোনোদিনও সরকারি সংস্থা বা এনজিও থেকে বড় অংকের কোন টাকা নেইনি বা পাইনি।

প্রায় দুই বছর আগে নারী নেত্রী ইরা আমাদের অনেককে ডেকে সরকারি অফিস থেকে উন্নত সেলাই প্রশিক্ষণ ও সেলাই মেশিন দেয়ার জন্য কিছু সাদা কাগজে স্বাক্ষর এবং ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি ও ছবি নেন। কোন চেকে কখনই স্বাক্ষর বা টিপ দেইনি। নীলপল্লী মহিলা উন্নয়ন সমিতির কর্মকর্তা সালাম ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয়ের সুপারভাইজার হামিদুর রহমান একাজে ইরাকে সহযোগিতা করেন।

কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ বা সেলাই মেশিন দেননি। অথচ আজ বলা হচ্ছে আমাদের ১৫ হাজার টাকা করে ঋণ দিয়েছে মহিলা অফিস। যা দুই বছর মেয়াদ শেষেও পরিশোধ না হওয়ায় খেলাপি হিসেবে আইন আদালত করা হবে বলে নোটিশ দেয়া হয়েছে। পর পর দুই বার নোটিশ পেয়ে আমরা হতবাক এবং উদ্বিগ্ন। যে ঋণ আমরা নেইনি বা যে টাকা পাইনি সেজন্য কেন নোটিশ দেয়া হলো এবং তা কেন আমরা দিবো?

হাছেনুরের স্ত্রী বৃষ্টি বলেন, প্রথম নোটিশ পেয়ে আমরা ইরাকে ধরলে তিনি বলেন, তোমাদের কিছুই হবে না। আমি দেখতেছি। কিন্তু আবারও নোটিশ এসেছে। এখন তিনি বলছেন, তোমাদের নামে আমি টাকা তুলে সমিতির দৈনিক ভিত্তিক ঋণ কার্যক্রম চালাচ্ছি। আমি টাকা দিয়ে দিবো। তোমরা আমার বিরুদ্ধে উপজেলায় অভিযোগ করো। তাহলে তোমরা বেঁচে যাবে।

নুর আলমের স্ত্রী রুনা লায়লা বলেন, মূলতঃ আমিসহ মাত্র ৫ জনকে দিয়ে সব চেকের মুড়িতে সই নিয়ে সেই চেক সবগুলো ইরা নিয়েছেন। অফিসের লোকজনের সহায়তায় সেই টাকা তুলে আমাদের কয়েকজনকে কিছু কিছু করে ঋণ দিয়েছেন। যা অনেক আগেই আমরা শোধ করেছি। কিন্তু তারপরও কেন সবার নামে ঋণ খেলাপির নোটিশ এসেছে বুঝতে পারছি না।

মিন্টুর স্ত্রী মিনা বলেন, আমি সমিতির সদস্য নই। কখনো কোথাও স্বাক্ষরও দেইনি। শুধু ঈদ উপলক্ষে ইরা সেমাই চিনি দেয়ার জন্য আমার ভোটার আইডির ফটোকপি নিয়েছেন। সেই আইডি দিয়েও তিনি মহিলা অফিস থেকে ঋণ তুলেছেন। আর এখন নোটিশ এসেছে আমার নামে। এটা কিভাবে সম্ভব? ওই অফিসের লোকজন ও ইরা যোগসাজশ করেই এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে। আমরা এর বিচার চাই।

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত নারী নেত্রী কামরুন্নাহার ইরার বাড়িতে গেলে নোটিশপ্রাপ্ত নারীরাও উপস্থিত হন। তাদের সামনেই তিনি সদস্যদের নামে নিজে সব টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ওই টাকাতো অনুদান হিসেবে নিয়েছি। তাই পরিশোধ করিনি। কিন্তু এখন অফিস এটাকে ঋণ বলছে।

তিনি বলেন, এর আগেও ঋণ নিয়ে পরিশোধ করেছি। কিন্তু করোনাকালে সমস্যা হওয়ায় অনুদান চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তাই দেয়া হয়েছে। তারা আমাকে ধোকা দিয়েছেন এবং সদস্যদের অহেতুক হয়রানি করছেন। বিষয়টা ম্যানেজে ইতোমধ্যে ৪৫ হাজার টাকা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে দিয়েছি। তাছাড়া জেলা কর্মকর্তাও সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।

উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নুরুন্নাহার শাহাজাদী বলেন, আমরা নীতিমালা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছি। গ্রুপ লোন নেয়ার ক্ষেত্রে সদস্যদের নামে চেক ইস্যু করে তা দলনেত্রীকে এককভাবে দেয়ার নিয়ম আছে। তাই সেভাবে দেয়ায় কোনো অনিয়ম হয়নি। টাকা নিয়েছেন ইরা অথচ নোটিশ দিয়েছেন ৪৬ নারীকে কেন? প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, তাদের নামে আবেদন, রেজিস্ট্রার ও চেক ইস্যুর ডকুমেন্টস আছে। তাই তাদেরকেই ধরা হচ্ছে।

দলনেত্রী ইরা কে ধরার মতো আপনাদের কাছে কাগজে কলমে কোনোকিছু আছে? উত্তরে তিনি বলেন না। তাহলে তাকে কিভাবে ধরবেন জানতে চাইলে নিরব হয়ে যান। পরে বলেন, ইতোমধ্যে তাকে ডেকে এনে ইউএনওর মধ্যস্থতায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল তিনি মাসে ১০ হাজার করে দিয়ে পরিশোধ করবেন। কিন্তু দেননি। এই সিদ্ধান্ত কি লিখিত নিয়েছিলেন? জবাব না। কেন? এখন একেবারে লা জবাব এই কর্মকর্তার।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের অভিযোগ, মূলত: কর্মকর্তার সাথে যোগসাজশেই এই কাজ করা হয়েছে। যে কারণে সকল সদস্যকে উপস্থিত না করেই এককভাবে ইরাকে চেক দেয়া হয়েছে, দীর্ঘ দিন থেকে টাকা পরিশোধ না করলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এখন অডিট আসায় ইরাকে না ধরে লোক দেখানো নোটিশ দেয়।

(ঢাকাটাইমস/২৭ফেব্রুয়ারি/প্রতিনিধি/জেডএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :