মন্ত্রণালয় থেকে বন্ধ করলেও ‘অদৃশ্য ক্ষমতায়’ চলছে বিএনপি নেতার তিনতারকা হোটেল ‘সুইট ড্রিম’
বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে বন্ধ করে দেওয়ার পরেও অদৃশ্য ক্ষমতাবলে বনানীতে এখনো চলছে তিনতারকা হোটেল ‘সুইট ড্রিম। হোটেলটির মালিক বিএনপির এক শীর্ষ নেতা, যিনি বিদেশে থাকেন। অথচ অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা এবং শর্ত ভঙ্গের দায়ে গত ৭ ফেব্রুয়ারি হোটেলটির লাইসেন্স বাতিল করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। এর আগে ২০১৭ সালে হোটেলটির বার লাইসেন্স স্থগিত করা হয়। ২০২০ সালে এই হোটেলে এক চাঞ্চল্যকর খুনের ঘটনা ঘটেছিল। এরপর নতুন করে হোটেলটি আলোচনায় আসে। প্রথম অবৈধ ভিওআইপি আবিস্কার হয়েছিল এই হোটেল থেকেই। এদিকে সরকারি নির্দেশনা থোড়াই কেয়ার করে আগের মতোই বিদেশি মদ আমদানির ক্ষেত্রে জালিয়াতি, গভীর রাত পর্যন্ত বার খোলা রাখা, অনৈতিক ব্যবসা, ঘণ্টা চুক্তিতে রুম ভাড়া দেওয়া, হোটেল বারের নিয়ম কানুন ভেঙে রাতভর তরুণ-তরুণীদের নৃত্য আর অসামাজিক কার্যকলাপসহ নানা অপরাধের সূতিকারগার হয়ে হয়ে এখনো চলছে হোটেলটি।
বুধবার সন্ধ্যায় সরেজমিনে বনানীর কামাল আতার্তুক এভিনিউয়ে অবস্থিত হোটেল সুইট ড্রিমে গিয়ে এমন সব দৃশ্যই দেখতে পায় ঢাকা টাইমসের প্রতিবেদক। সে সময় রাস্তার সঙ্গে লাগোয়া রিসিপশনের মূল ফটকটি হাফ র্সাটার করা ছিল। পাহারায় ছিলেন দুজন নিরাপত্তারক্ষী।
হোটেলের ভেতরে প্রবেশ করতেই রিসিপশনে দেখা মেলে মেহেদী হাসান রনি নামে এক যুবকের। হোটেলটি খোলা নাকি বন্ধ জানতে চাইলে ওই যুবক সাফ জানিয়ে দেন, তিনি কিছু জানেন না। উল্টো অফিসের অপারেশন ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
এরপর একজন সিকিউরিটি র্গাড এসে ঢাকা টাইমস প্রতিবেদককে পাঁচতলায় নিয়ে একটি অফিস রুমে বসান। সেখানে হোটেল সুইট ড্রিম হোটেলের অপারেশন ডিরেক্টর সামছুল আহসান মজুমদারের দেখা মেলে। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, মাসখানেক আগেই হোটেলের সব ধরনের কার্যক্রম মন্ত্রণালয় থেকে বন্ধ ঘোষণার পরও এখনো কীভাবে হোটেলের সব কার্যক্রম চলমান রয়েছে।জবাবে ওই অপারেশন ডিরেক্টর বলেন, ‘এসব বিষয় মন্ত্রণালয় আর আমরা (হেড অফিস) বুঝব। এটা নিয়ে কথা বলার কিছু নেই।’ হেড অফিস বা মালিক পক্ষের নম্বর বা যোগাযোগের মাধ্যম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি রুমের পাশে বাউন্সার রেখে কক্ষ ত্যাগ করতে উদ্যত হন। এরপর একপ্রকার জোর করেই ঢাকা টাইমস প্রতিবেদক ওই অপারেশন ডিরেক্টরের সঙ্গে কক্ষ থেকে বের হয়ে লিফটে উঠে পড়েন। এ সময় তিনি তার মুঠোফোন বের করে সেখানে থাকা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মিটিং, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিটিং করেছেন বলে কিছু ছবি ও মেসেজ দেখিয়ে হোটেল মালিকের ক্ষমতা জাহির করেন প্রতিবেদকের কাছে। সঙ্গে পরার্মশ দেন অন্যদিন দুপুরে আসতে। আজ আর কথা বলতে পারবেন না। তিনি দাবি করেন, হোটেল খোলা নেই বা কোনো অপারেশনাল কাজ চলছে না। হোটেলটির পুনর্নির্মাণ হচ্ছে জানিয়ে রিসিপশনের পেছনে থাকা সুড়ঙ্গের মতো সুরু রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে যান।
ঢাকা টাইমস খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, সেদিনও হোটেলটির ৩০টিরও বেশি ছোট-বড় রুমে গেস্ট ছিল। সারাদিন গেইট অর্ধখোলা রেখে গেস্ট রিসিভ ও রুম বুকিং চলে। রাত ৯টার পর বার থেকে সুড়ঙ্গ পথ বা একাধিক উপায়ে চলে দেশি-বিদেশি মদের পার্সেল। পাঁচতলা হোটেলটির কিচেনে চলছিল রান্না। যেটি থেকে খাবার কিনতে পারবেন শুধু হোটেলে অবস্থানরত গেস্ট এবং স্টাফরা।
এই হোটেলে সকাল শিফটে ১০ জন ও ইভিনিং শিফটে ১৫ জন কাজ করে। হোটেলটিতে প্রবেশের দুটি দৃশ্যমান পথের বাইরেও গুপ্ত একটি প্রবেশপথ রয়েছে। রিসিপশন থেকে রুমে বা বারে যেতে দুটি লিফট থাকলেও কোনো সিঁড়ি নেই। ১৮ তলা ভবনটিতে দ্বিতীয় তলায় রয়েছে আইএফআইসি ব্যাংকের একটি শাখাসহ নিশো ট্রাভেল এজেন্সি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়।
এ ব্যাপারে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (হোটেল ও রেস্তোরাঁ সেল) মো. মনোয়ার হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য তাদেরকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কীভাবে তারা এখনো হোটেলটি খোলা রেখেছে সে বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখব।’ তার দাবি, ‘হোটেলটি খোলা রাখতে আমরা কোনো পারমিশন দেইনি। তারা যদি বলে থাকে, সেটা ভুল।’
সুইট ড্রিম হোটেলকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে তিন তারকামানের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। যার নম্বর ঢাকা-১৩/২০০৭। লাইসেন্সে বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ আইন ২০১৪ এবং বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ বিধিমালা ২০১৬ এবং বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ সংশোধিত বিধিমালা ২০১৯ অনুসরণ করে হোটেল পরিচালনার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু সেই নির্দেশনা ভঙ্গ করে প্রতিষ্ঠানটি আবাসিক হোটেল হিসেবে ব্যবহারের পরিবর্তে বার এবং স্পা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। যা বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্তোরাঁ আইন, ২০১৪ এর ১৭ ধারার (খ) সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ কারণে গত ৭ ফেব্রুয়ারি হোটেলটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
এই হোটেলে ২০২০ সালের মার্চে ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট ব্যবসায়ী শেহজাদ খান খায়রুল হত্যাকাণ্ড ঘটে। সে সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গুলশান সার্কেল হোটেল সুইট ড্রিমসের বিরুদ্ধে বিদেশি মদ আমদানির ক্ষেত্রে জালিয়াতি এবং গভীর রাত পর্যন্ত বার খোলা রাখার প্রমাণ পায়। সে কারণে হোটেলটির বার লাইসেন্স স্থগিত করা হয়।
আলোচিত করোনা পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফয়সাল আল ইসলামকে এই হোটেল থেকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সে সময় তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, ধরা পড়ার আগে ফয়সাল প্রতিদিন সন্ধ্যায় সুইট ডিমস হোটেলের ১৬ তলায় মাদকের আড্ডা বসাতেন। তেমনই এক আড্ডায় খুন হয়েছিলেন ব্যবসায়ী শেহজাদ খান খায়রুল। ২০২০ সালের ১১ মার্চ সকালে তার লাশ উদ্ধার করে বনানী থানা পুলিশ। সেই মামলার তদন্ত এখনো চলছে। এই হোটেলে বসেই ফয়সাল করোনা পরীক্ষার জালিয়াতিসহ নানা কুকর্মের পরিকল্পনা করতেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
তারও আগে ২০১৭ সালে ২০ নভেম্বর রাতে হোটেল সুইট ড্রিমসের ৮০৫ নম্বর কক্ষে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে কুশান ওমর সুফি নামে এক ব্যক্তি এক তরুণীকে ধর্ষণ করেন বলে অভিযোগ আছে। ওই ঘটনায় মামলা হয় বনানী থানায়।
এখানেই শেষ নয়, ২০১৯ সালে এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পরই রাজউক সুইট ড্রিমস হোটেলটিকে অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করলেও তারা সে শর্ত মানেনি। বর্তমান সময়ে তাদেরকে কয়েক দফায় ফায়ার সার্ভিসের সেফটি লাইন্সেস নবায়ন করার কথা বললে সেটিও তারা করেনি।
(ঢাকাটাইমস/১৫মার্চ/এএম/এজে/এসআইএস)