ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-৮
আদম (আ.)-কে আল্লাহ যে দোয়া শিখিয়েছিলেন

প্রিয় পাঠক, রহমতের সময়গুলো দ্রুতই ফুরিয়ে যাচ্ছে। কোরআনকে জানার মধ্য দিয়ে আসুন সময়গুলো অতিবাহিত করি। আজ আমরা অষ্টম পারা থেকে কোরআনকে জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। অষ্টম পারায় সুরা আরাফ আলোচিত হয়েছে।
আগের পর্ব: সপ্তম তারাবির প্রথম আয়াতেই হৃদয়স্পর্শী যে ঘটনার ইঙ্গিত পাবেন
সূরা আরাফ মক্কায় অবতীর্ণ সবচেয়ে দীর্ঘ আয়াতের সূরা। নবী-রাসূলদের ইতিহাস এবং ভুল বিশ্বাসের অপনোদন ইত্যাদি আলোচিত হয়েছে এই সূরায়। জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী স্থানকে আরাফ বলা হয়। মুমিনদের মধ্যে যাদের ভালো ও মন্দ কাজের পাল্লা সমান হবে, তাদের স্থান হবে আরাফে। এই সূরায় আরাফবাসীদের সাথে জান্নাতীদের কথোপকথনের দৃশ্য উঠে এসেছে। এ কারণে এই সূরাকে আরাফ নামে নামকরণ করা হয়েছে। ৮/৪৪-৪৯
ঘটনাবলি
আদম (আ.)-কে সৃষ্টির পর আল্লাহ সবাইকে সিজদা করতে নির্দেশ করেন। ইবলিস অস্বীকৃতি জানায়। আল্লাহ ইবলিসকে অভিশপ্ত ঘোষণা করে জান্নাত থেকে বিতাড়িত করেন। ইবলিস মানবজাতিকে পথভ্রষ্ট করার সংকল্প করে। এরপর আদম ও হাওয়া (আ.) জান্নাত থেকে পৃথিবীতে আগমন করলে পৃথিবী আবাদ হয়। মানবজাতির সূচনালগ্নের গুরুত্বপূর্ণ এই ইতিহাস উঠে এসেছে সূরা আরাফের প্রথম দিকের কয়েকটি আয়াতে। ৭/১১-২৫
অষ্টম পারার শেষ চার পৃষ্ঠা এবং নবম পারার শুরুতে ধারাবাহিকভাবে সাতজন নবীর দাওয়াতি মিশন এবং তাদের কওমের অবাধ্যতা ও পরিণতির ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। নূহ (আ.)-এর দাওয়াত অস্বীকারের পরিণামে তার অবাধ্য জাতি মহাপ্লাবনে নিমজ্জিত হয়। হুদ (আ.)-এর প্রতি আদ জাতির ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের শাস্তি-সুরূপ ঝঞ্ঝাবায়ু প্রেরণ করা হয়। ছামুদ জাতি সালেহ (আ.)-এর অবাধ্যতা এবং আল্লাহর উটনী হত্যার পরিণামে প্রলয়ংকারী ভূমিকম্পে নিঃশেষ হয়। লুত (আ.)-এর জাতি পৃথিবীতে প্রথম সমকামিতার মতো নোংরা ও জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হয়। নোংরা অপকর্ম ও নবীর অবাধ্যতার পরিণামে (প্রস্তর) বৃষ্টি বর্ষণ করে তাদেরকে সমূলে শেষ করে দেওয়া হয়। মাদায়েনবাসীর প্রতি প্রেরিত হন শুআইব (আ.)। ব্যবসায় জালিয়াতি এবং নবীর অবাধ্যতার কারণে তার কওমও আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়। কুরআনের এই অংশে সবচেয়ে দীর্ঘ পরিসরে উঠে এসেছে বনী ইসরাইল এবং মূসা (আ.)-এর ঘটনা। বনী ইসরাইলের প্রতি আল্লাহ অনেকগুলো বিশেষ অনুগ্রহ দান করেছিলেন। তা সত্ত্বেও পদে পদে তারা আল্লাহর নবী মূসা ও হারুন (আ.)-এর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়। সামেরী নামক ব্যক্তির মাধ্যমে তারা পৃথিবীতে বাছুর পূজার সূচনা করে। এইসব অপকর্মের সতর্কতাস্বরূপ আল্লাহ অনেকগুলো নিদর্শন প্রেরণ করেন। ৭/১২-১৭১
বদর যুদ্ধের প্রতিকূল সময়ে ঈমানদারদের ফরিয়াদ এবং আল্লাহর আলৌকিক সাহায্যের বিবরণ উঠে এসেছে এই সূরায়। ৮/৯-১৮
ঈমান-আকীদা
সূরা আরাফের অন্তত পাঁচটি স্থানে আল্লাহর একত্ববাদ, একত্ববাদের যৌক্তিকতা, শিরকের ভয়াবহতা এবং মূর্তিপূজার অসারতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
কিয়ামতের দিন বান্দার যাবতীয় কর্ম ওজন ও পরিমাপের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে সূরা আরাফে। ৭/৮, ৯
গায়েব বা অদৃশ্য বিষয়ক সবকিছু একমাত্র আল্লাহই জানেন। রাসূল (সা.) বা অন্য কোনো মাখলুক গায়েব বা অদৃশ্যের খবর জানেন না। ৭/১৮৮
রাসূল (সা.)-কে পৃথিবীর সকল ধর্ম, বর্ণ ও ভাষার মানুষের প্রতি রাসূল হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। ৭/১৫৮
এই সূরায় বর্ণিত আদেশ
■ ইনসাফ করা। ৭/২৯
■ প্রত্যেক সালাতে কিবলামুখী হওয়া। ৭/২৯
■ আল্লাহকে একনিষ্ঠভাবে ডাকা। ৭/২৯
■ সালাতের সময় উত্তম পোশাক পরিধান করা। ৭/৩১
■ আল্লাহকে কাকুতি-মিনতি করে ও চুপিসারে ডাকা। ৭/৫৫
■ ভয় ও আশা নিয়ে আল্লাহকে ডাকা। ৭/৫৬
■ আল্লাহর ইবাদত করা। ৭/৫৯
■ আল্লাহর অনুগ্রহসমূহের কথা স্মরণ করা। ৭/৭৪
■ মাপ ও ওজন ঠিকভাবে দেওয়া। ৭/৮৫
■ আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা এবং ধৈর্য ধরা। ৭/১২৮
■ আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আনা এবং তার অনুসরণ করা। ৭/১৫৮
■ ক্ষমাপরায়ণ হওয়া, সৎ কাজের আদেশ দেওয়া এবং অজ্ঞদের এড়িয়ে চলা। ৭/১৯৯
■ সকাল-সন্ধ্যায় বিনয় ও ভীতি সহকারে প্রতিপালককে স্মরণ করা। ৭/২০৫
■ আল্লাহকে ভয় করা ও পারস্পরিক সম্পর্ক শুধরে নেওয়া। ৮/১
■ ফিতনা দূরীভূত হওয়া এবং দীন পরিপূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হওয়ার আগ পর্যন্ত জিহাদ করা। ৮/৩৯
সুরা আনফাল: হে মুমিনগণ!
সূরা আনফালের কয়েক স্থানে আল্লাহ মুমিনদেরকে পরম মমতা নিয়ে ‘হে মুমিনগণ’ বলে সম্বোধন করে কিছু নির্দেশ দিয়েছেন, যা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।
■ যুদ্ধের ময়দানে শত্রুদের পৃষ্ঠপ্রদর্শন করো না। ৮/১৫
■ আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করো এবং তার নির্দেশ শোনা সত্ত্বেও তা থেকে বিমুখ হয়ো না। ৮/২০
■ আল্লাহ ও তার রাসূলের ডাকে সাড়া দাও। ৮/২৪
■ আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করো না। ৮/২৭
■ তাকওয়ার ওপর চললে আল্লাহ সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করার শক্তি দেবেন, পাপমোচন ও ক্ষমা করবেন। ৮/২৯
নিষেধ
■ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ না করা। ৭/৩
■ অপচয় না করা। ৭/৩১
■ পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পর ফাসাদ সৃষ্টি না করা। ৭/৫৬
■ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করা। ৭/৮৫
■ ওজনে কম না দেওয়া ও মানুষের অধিকার খর্ব না করা। ৭/৮৫
■ দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টিকারীদের পথে না চলা। ৭/১৪২
■ গাফেলদের অন্তর্ভুক্ত না হওয়া। ৭/২০৫
■ আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করা। ৮/২৭
হালাল-হারামের বিধান
আল্লাহ হারাম করেছেন প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য অশ্লীল বিষয়সমূহ, সব গুনাহ, অন্যায়ভাবে কারো প্রতি সীমালঙ্ঘন করা, আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক সাব্যস্ত করা ও না জেনে আল্লাহ সম্পর্কে মন্তব্য করা। ৭/৩৩
দৃষ্টান্ত
অনুধাবনের জন্য অন্তর, দেখার জন্য চোখ এবং শোনার জন্য কান থাকার পরও যারা সত্য উপলব্ধি করে না, তাদেরকে চতুষ্পদ প্রাণীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে; বরং চতুষ্পদ প্রাণীর চেয়েও তারা বেশি বিভ্রান্ত। ৭/১৭৯
যারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে এবং অহংকারবশত তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের জান্নাতে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করা হবে। এর দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘যেভাবে সুচের ছিদ্র পথে উটের প্রবেশ অসম্ভব, তেমনি এইসব লোকের জন্য জান্নাতে যাওয়াও অসম্ভব।’ ৭/৪০
সুসংবাদ ও সতর্কীকরণ
ঈমান ও তাকওয়া অবলম্বন আসমান-জমিনের বরকতের দুয়ার উন্মোচনের কারণ। ৭/৯৬
আল্লাহ মানবজাতিকে শয়তানের ধোঁকা ও প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। ৭/২৭
আল্লাহ যাদের অপছন্দ করেন
আল্লাহ অপচয়কারী (৭/৩১) এবং সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না। ৭/৫৫
আল্লাহর লানত
জালিমদের ওপর আল্লাহ লানত করেছেন। ৭/৪৪
সবচেয়ে বড় জালিম
যে আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে, তার আয়াতসমূহকে প্রত্যাখ্যান করে, সে সবচেয়ে বড় জালিম। ৭/৩৭
প্রকৃত মুমিনের পাঁচটি গুণ
১. আল্লাহর স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় বিগলিত হয়।
২. কুরআন তিলাওয়াত করা হলে তাদের ঈমান আরও বৃদ্ধি পায়।
৩. তারা তাদের রবের ওপরই ভরসা করে।
৪. (সময়মত সঠিকভাবে) সালাত আদায় করে।
৫. আল্লাহর দেওয়া রিযিক হতে ব্যয় করে। ৮/৩-৪
হে আদম সন্তান সূরা আরাফে আল্লাহ চারবার ‘হে আদম সন্তান’ বলে সম্বোধন করে চারটি উপদেশ দিয়েছেন।
১. তাকওয়ার পোশাক সর্বোত্তম পোশাক। ৭/২৬
২. শয়তান যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত না করে, যেভাবে তোমাদের পিতামাতাকে জান্নাত থেকে বের করেছিল। ৭/২৭
৩. সালাতের সময় সুন্দর পরিচ্ছদ গ্রহণ করো এবং পানাহার করো, কিন্তু অপচয় করো না। ৭/৩১
৪. রাসূলগণের পথনির্দেশ গ্রহণ করে যারা তাকওয়া অবলম্বন ও আত্মসংশোধন করে তাদের কোনো ভয় নেই এবং চিন্তাও নেই। ৭/৩৫
আদম আলাহিস সালামকে আল্লাহ তাআলা যে দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন
আদম (আ.)-কে আল্লাহর শেখানো দোয়া; যে দোয়ার মাধ্যমে তিনি ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলার শেখানো এই দোয়া আমাদের জন্য ইহসান।
رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَّمْ تَغْفِرُ لَنَا وَ تَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَسِرِينَ
অর্থ: ‘হে আমাদের রব, আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। আর যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদেরকে দয়া না করেন তবে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’ ৭/২৩
رَبَّنَا أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَ تَوَفَّنَا مُسْلِمِينَ
অর্থ: হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের পরিপূর্ণ ধৈর্য দান করুন এবং আমাদেরকে আত্মসমর্পণকারী হিসাবে মৃত্যু দান করুন। ৭/১২৬
চলবে, ইনশাআল্লাহ...
লেখক: আলেম ও ওয়ায়েজ; খতীব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।
(ঢাকাটাইমস/১৮মার্চ/এসআইএস/এআর)

মন্তব্য করুন