ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-২৬

ধারণা ও মন্দ উপাধিসহ যে ৬ দোষ সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করে

মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী
| আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৯:৩৫ | প্রকাশিত : ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৯:২৩

প্রিয় পাঠক,

জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল ঢাকা টাইমসের আয়োজনে আজ আমরা পবিত্র কুরআনুল কারীমের ২৬ তম পারা থেকে ধারাবাহিক তাফসির পেশ করছি। এ পারা শুরু হয়েছে সূরা আহকাফ দিয়ে।

আগের পর্ব: কেয়ামতের দিন মানুষ হাঁটু গেড়ে বসে থাকবে

সূরা আহকাফ

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৩৫। রুকু সংখ্যা: ৪

অন্যান্য মক্কি সূরার ন্যায় এ সূরায়ও ইসলামের বুনিয়াদি তিনটি আকিদা (তাওহিদ, রিসালাত ও আখেরাত) নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সূরার শুরুতে কোরআনের সত্যতা, তাওহিদ এবং হাশর দিবসের প্রমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়াও মুশরিকরা যেসব মূর্তির পূজা করত, সেগুলোর নিন্দা করা হয়েছে। এসব মূর্তি না দেখতে পারতো, না কিছু শুনতে পারতো। আর না কোনো ধরনের উপকার ও ক্ষতি পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখতো। এমনকি মূর্তিগুলো এইসব পূজারির দোয়া ও প্রার্থনাও শুনতে পেতো না। (২-৬)

সূরা আহকাফে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হয়েছে, নিম্নে তা তুলে ধরা হলো; ১. মুশরিকদের সামনে যখন কোরআন তেলাওয়াত করা হতো তখন তারা এর ওপর বিভিন্ন সন্দেহ ও আপত্তি উত্থাপন করত। কখনো এটাকে জাদু, কখনো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বানানো কথা, কখনো এর ওপর ঈমান গ্রহণকারীদের ব্যাপারে বলত যে, ঈমান যদি কোনো ভালো বিষয় হতো তা হলে এই ফকির, গরিব ও মজদুররা আমাদের আগে ঈমান আনতে পারত না। মুশরিকদের আপত্তি উল্লেখ করার পর তাদের দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হয়েছে। (৭-১২)

২. সূরা আহকাফ আমাদের সামনে দুটি বিপরীতমুখী দৃষ্টান্ত পেশ করেছে। প্রথম দৃষ্টান্ত এক সৎসন্তানের, যার অন্তর ঈমানের নূরে আলোকিত, শরিয়তের ওপর যে অত্যন্ত অটল অবিচল। তার পিতামাতা যখন তাকে লালনপালন করে বড় করে তুলেছে, যখন সে দেহ ও মেধার দিক থেকে পূর্ণতায় পৌঁছেছে, তখন সে আল্লাহর নিকট তিনটি দোয়া করেছে।

প্রথমত, হে আল্লাহ, আপনি আমাকে ও আমার মাতাপিতাকে যে নেয়ামত দিয়েছেন, তার শুকরিয়া আদায় করার তাওফিক দিন।

দ্বিতীয়ত, আপনি যে আমলে সন্তুষ্ট হন সে আমল করা আমার জন্য সহজ করে দিন।

তৃতীয়ত, আমার সন্তানদের নেককার বানান।

এমন সন্তানের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে জান্নাতের ওয়াদা রয়েছে। (১৫-১৬) দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত হচ্ছে এক অবাধ্য ও হতভাগা সন্তানের, যার পিতামাতা তাকে ঈমান আনার দাওয়াত দিলে সে অহংকারবশত বলে- উফ, তোমরা আমাকে কী যে বলো! মৃত্যুর পর আমাকে আবার জীবিত করা হবে! অথচ আমার পূর্বে কত লোক মারা গেল! তাদের কাউকে তো আমার সামনে জীবিত করা হলো না। (১৭) প্রথম দৃষ্টান্তটি ঈমান ও হেদায়েতপ্রাপ্তদের। দ্বিতীয় দৃষ্টান্তটি কাফের ও অবাধ্যদের। উভয়ে নিজ নিজ কর্মের প্রতিদান পাবে।

৩. বিপরীতমুখী দুটি দৃষ্টান্ত দেওয়ার পর এ সূরায় আহকাফ সম্প্রদায়ের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা হুদ আলাইহিস সালামকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল। যার ফলে তাদের সবাইকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য মেঘমালা পাঠানো হয়। যেহেতু কয়েকদিন যাবৎ প্রচণ্ড গরম ছিল; তাই তারা মেঘ দেখে দারুণ খুশি হয়। তারা নিশ্চিত হয়ে যায় যে, আজ মুষলধারায় বৃষ্টি হবে। তারা আনন্দের আতিশয্যে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। মেঘের সাথে প্রচণ্ড তুফান শুরু হয়।

আদ সম্প্রদায়ের দেহ অনেক বিশাল ছিল। বাতাস তাদের শূন্যে উঠিয়ে নেয়। মনে হচ্ছিল বাতাসে কোনো কীট-পতঙ্গ উড়ছে। এরপর তাদেরকে উঁচু থেকে জমিনে নিক্ষেপ করা হয়। তারা জমিনে লাশ হয়ে পড়ে থাকে।

আদ সম্প্রদায়ের ঘটনা উল্লেখ করে মক্কাবাসীদের ভীতিপ্রদর্শন করা হয়েছে যে, ‘তোমরা তাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী নও। যদি তোমরা অবাধ্যতা করো তা হলে তোমাদেরকেও আল্লাহর আজাবের মাধ্যমে পাকড়াও করা হবে।’ (২১-২৬)

৪. সূরার শেষে বলা হয়েছে, যে মহান সত্তা আসমান-জমিন সৃষ্টি করেছেন, তিনি মানুষকে পুনরায় জীবিত করতে সক্ষম। শেষ আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আপনি উলুল আজম (দৃঢ়পদ) নবীদের মতো সবর করুন। সবরের ফল সবসময় ভালোই হয়।

সূরা মুহাম্মদ

এটি মাদানি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৩৮। রুকু সংখ্যা: ৪

আমাদের প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম কোরআনুল কারিমের চারটি সূরায় এসেছে। সূরাগুলো হচ্ছে সূরা আলে ইমরান, সূরা আহজাব, সূরা মুহাম্মদ ও সূরা ফাতাহ। এ চার সূরা ব্যতীত অন্যান্য জায়গায় সম্বোধন করার ক্ষেত্রে তার কোনো সিফাত বা গুণ উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই সূরায় মুহাম্মদ সম্বোধন করা হয়েছে। এই সূরাকে সূরা কিতালও বলা হয়। কেননা এ সূরায় কাফেরদের সঙ্গে যুদ্ধের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। এর বিষয় হচ্ছে জিহাদ ও কিতাল। সূরার শুরুতে কাফের ও মুমিনদের মাঝে পার্থক্য উল্লেখ করা হয়েছে। ‘কাফেররা বাতিলের অনুসরণ করে আর মুমিনরা হকের অনুসরণ করে।’ (১-৩)

মানুষদের মধ্যে যখন এ ধরনের দুটি দল হবে তখন তাদের মধ্যে লড়াই অনিবার্য হয়ে পড়বে। যুদ্ধের ময়দান গরম হয়ে যাবে। এজন্য বলা হয়েছে, ‘যখন তোমরা কাফেরদের মুখোমুখি হবে তখন তাদের গর্দানে আঘাত করবে। যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাভূত করে ফেলবে তখন তাদেরকে শক্ত করে বাঁধবে।’ এসব বন্দিদের ব্যাপারে চার ধরনের এখতিয়ার রয়েছে।

প্রথমত বন্দিদেরকে অনুগ্রহ করে মুক্ত করে দেওয়া যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত মুক্তিপণ নিয়েও তাদের ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।

তৃতীয় পদ্ধতি হচ্ছে বন্দি-বিনিময়। মুসলিম বন্দিদের বিনিময়ে কাফের বন্দিদের ছেড়ে দেওয়া।

চতুর্থত তাদেরকে গোলাম হিসেবে রাখা হবে। তবে তাদেরকে গোলাম বানিয়ে রাখা ফরজ বা ওয়াজিব পর্যায়ের বিধান নয়। যখন তাদেরকে গোলাম বানানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছিল তখন গোটা বিশ্বে গোলাম-বাঁদির ব্যাপক প্রচলন ছিলো না; বরং জালেম লোকেরা স্বাধীন মানুষদেরও-যাদের কোনো ওয়ারিস বা শক্তিশালী বংশ না থাকত-গোলাম বানিয়ে নিয়ে যেত।

গোলাম-বাঁদিরাও সর্বপ্রকার অধিকার-বঞ্চিত ছিলো। ইসলাম তাদের অধিকার নির্ধারণ করেছে। তাদেরকে মুক্ত করে দেওয়ার ফজিলত বর্ণনা করেছে। তাদের রক্ত হারাম ঘোষণা করেছে। ইসলাম এ অধিকার দেওয়ার ফলেই মুসলিম- ইতিহাসে এমন অসংখ্য গোলামের কথা জানা যায়, যাদের কেউ মুফাসসির, কেউ মুহাদ্দিস, কেউ দেশবিজেতা, কেউবা উজির হয়েছে।

পূর্বের গোলামির কারণে মুসলমানরা তাদেরকে কখনো তুচ্ছতাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখেনি। কোরআনুল কারিমে জাকাত-সদকা আদায়ের জন্য যে কয়টা খাতের নির্দেশনা এসেছে, তার মধ্যে গোলাম-বাঁদিদের মুক্তির জন্য আর্থিক সহযোগিতা করাকেও স্বতন্ত্র খাত হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। প্রথম যুগের মুসলমানগণ গোলাম আজাদ করাতে কতটা আগ্রহবোধ করতেন তার কিছুটা অনুমান করা যায় এক বর্ণনা থেকে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবি আবদুর রহমান ইবনে আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু একাই ত্রিশ হাজার গোলাম ক্রয় করে তাদেরকে আজাদ করে দিয়েছিলেন।

এই সূরা আমাদেরকে বলছে যে, ‘মুসলমানরা যদি দীনের ওপর অবিচল থাকে, দীনের সহযোগিতার জন্য তারা দাঁড়িয়ে যায়, তা হলে আল্লাহ অবশ্যই তাদের সাহায্য করবেন। তাদের কদম অবিচলিত রাখবেন।’ (৭)

মুমিনদের সাথে জান্নাতের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, এ সূরায় তারও কিছুটা বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। (১২-১৫)

মুমিনদের পাশাপাশি মুনাফিকদের অবস্থাও বর্ণনা করা হয়েছে। ‘যুদ্ধের আয়াত শুনে মুমিনদের ঈমান বেড়ে যায়; পক্ষান্তরে মুনাফিকরা মৃত্যুর ভয়ে বেহুঁশ হয়ে যায়। (২০-২১)’

জিহাদ-কিতাল এবং আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়ের ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়ার ক্ষেত্রে পরিশেষে যেন বলা হয়েছে, ‘যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তা হলে আল্লাহ তোমাদের পরিবর্তে অন্য সম্প্রদায়কে নিয়ে আসবেন, যারা তোমাদের মতো হবে না।’ (৩৮)

সূরা ফাতহ

এটি মাদানি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ২৯। রুকু সংখ্যা: ৪

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হুদাইবিয়া থেকে প্রত্যাবর্তন করছিলেন

তখন এ সূরা অবতীর্ণ হয়।

বুখারি ও তিরমিজিতে আছে, হযরত উমর বিন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আজ সন্ধ্যায় আমার ওপর এমন এক সূরা অবতীর্ণ হয়েছে, যা দুনিয়া এবং তার মধ্যে যা কিছু রয়েছে, সব থেকে বেশি প্রিয়। এরপর তিনি সূরা ফাতাহ-এর কিছু আয়াত তেলাওয়াত করেন।

সূলহে হুদাইবিয়া ও বাইয়াতে রিদওয়ানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা

আলোচনা সহজে বোঝার জন্য সুলহে হুদাইবিয়া ও বাইয়াতে রিদওয়ানের বিষয়টি সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখ করা সমীচীন হবে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় থাকা অবস্থায় স্বপ্ন দেখেন যে, ‘আমরা মক্কায় প্রবেশ করছি। বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করছি।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের নিকট স্বপ্নের কথা উল্লেখ করলে তারা অত্যন্ত আনন্দিত হন। কেননা তারা জানতেন নবীদের স্বপ্ন সত্য হয়ে থাকে।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ষষ্ঠ হিজরির জিলকদ মাসে চোদ্দশ মতান্তরে দেড় হাজার সাহাবি নিয়ে উমরার নিয়তে মদিনা থেকে রওনা হন। যখন তিনি মক্কার কাছাকাছি পৌঁছলেন তখন বিশর বিন সুফিয়ান জানাল মক্কাবাসীরা আপনার আসার সংবাদ শুনে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা কিছুতেই মুসলমানদের মক্কায় প্রবেশ করতে দেবে না। এটা শুনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর সামনে অগ্রসর হলেন না। তিনি মক্কার অদূরে হুদাইবিয়াতে শিবির স্থাপন করেন। এরপর সেখান থেকে উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুকে দূত হিসেবে প্রেরণ করেন। তিনি মক্কাবাসীদের বলেন, ‘আমরা যুদ্ধের জন্য আসিনি। আমাদের উদ্দেশ্য উমরা করা এবং বাইতুল্লাহ জিয়ারত করা।’

ঐদিকে হজরত উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল যে, তিনি শহিদ হয়ে গেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন গাছের নিচে বসে পলায়ন না করা এবং মক্কার কাফেরদের মোকাবেলায় নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করার ব্যাপারে সাহাবিদের থেকে বাইয়াত গ্রহণ করেন। একে বাইয়াতে রিদওয়ান বলা হয়। কেননা বাইয়াতে অংশগ্রহণকারী সকলের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হয়েছেন। (১৮) উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিহত হওয়ার সংবাদটি পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। এরপর উভয় পক্ষের মাঝে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয়। কুরাইশদের পক্ষ থেকে আসে সুহাইল বিন আমর। আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে। পরিশেষে চুক্তি সম্পাদিত হয়, ইতিহাসে যা হুদাইবিয়ার সন্ধি নামে পরিচিত। চুক্তি অনুযায়ী উভয় পক্ষ পরস্পর দশ বছর পর্যন্ত কোনো ধরনের যুদ্ধে জড়াতে পারবে না। শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে তারা জীবনযাপন করবে।

চুক্তির কয়েকটি ধারার মাধ্যমে বাহ্যত মুসলমানদের দুর্বলতার বিষয়টি ফুটে উঠেছিল; কিন্তু আল্লাহ তায়ালা একে ফাতহুম মুবিন (সুস্পষ্ট বিজয়) বলে উল্লেখ করেন। এই চুক্তির সুস্পষ্ট বিজয় হওয়াটা কিছু মুসলমানের বোধগম্য হয়নি। কিন্তু পরবর্তী পরিস্থিতি প্রমাণ করে যে, প্রকৃতপক্ষেই চুক্তিটি সুস্পষ্ট বিজয় ছিলো। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত মুসলমানদের এর চেয়ে বড় কোনো বিজয় অর্জিত হয়নি। মুসলমানদের সংখ্যার মাধ্যমে বিষয়টি অনুমান করা যায়। হুদাইবিয়ার সময় মুসলমানদের সংখ্যা ছিলো চোদ্দশ। কিন্তু এর মাত্র দু বছর পরই অষ্টম হিজরিতে যখন মক্কাবিজয় হয় তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বাধীন বাহিনীতে মুজাহিদের সংখ্যা ছিলো দশ হাজার। শান্তিচুক্তির ফলে এ বিপ্লব সাধিত হয়েছিল।

সন্ধিচুক্তির পর তারা মুসলমানদের সাথে ওঠাবসা শুরু করে। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে। তখন তারা মুসলমানদের সত্যবাদিতা ও চারিত্রিক পবিত্রতা পরিলক্ষ করে। মুসলমানদের আচার-ব্যবহার মুশরিকদের ভাবতে বাধ্য করে যে, কোন সে গোপন শক্তি, যা গতকালও যেসব লোক মদখোর ও ডাকাত ছিল, তাদেরকে আজ দুনিয়াবিমুখ ও চরিত্রবান বানিয়ে দিল? নিঃসন্দেহে ঈমানি শক্তির ফলেই এমনটি হয়েছে। এ বাস্তবতা বোঝার পর আপনা-আপনিই তাদের গর্দান ঈমানের সামনে নত হয়ে যায়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সূরা ফাতাহ অবতীর্ণ হয়। এ কারণে এ সূরায় এ প্রাসঙ্গিক ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। শুরুর আয়াতগুলোতে নবীর সাহাবি ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মহাবিজয় এবং মুমিনদের জান্নাতের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়। মুনাফিকদের জন্য মারাত্মক শাস্তির হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়। (১-৬)

এই সূরায় দুটি বিপরীতমুখী দলের আলোচনা পাওয়া যায়। প্রথম দল হচ্ছে মুখলিস মুমিনদের, যারা মাতৃভূমি থেকে বহুদূরে নিরস্ত্র হওয়া সত্ত্বেও জিহাদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাতে বাইয়াত হয়েছিল। তারা অঙ্গীকার করেছিল আপনার নেতৃত্বে আমরা বিজয় বা শাহাদাত পর্যন্ত যুদ্ধ করতে থাকব। যুদ্ধের ময়দান থেকে আমরা পালন করব না। আল্লাহ তায়ালা তাদের এ প্রতিজ্ঞার বিষয়টি পছন্দ করেন এবং বলেন, ওযারা আপনার হাতে বাইয়াত হয় তারা আল্লাহর হাতে বাইয়াত হয়। তাদের হাতের ওপর আল্লাহর হাত রয়েছে।’ (১০)

সামনের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘(হে নবী) আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন, যখন তারা বৃক্ষের নিচে আপনার কাছে শপথ করেছে। তাদের অন্তরে যা ছিলো, আল্লাহ সে সম্পর্কে অবগত ছিলেন। অতঃপর তিনি তাদের প্রতি প্রশান্তি নাজিল করলেন এবং তাদেরকে আসন্ন বিজয় পুরস্কার দিলেন।’ (১৮)

দ্বিতীয় দল ছিলো মুনাফিকদের, যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে যায়নি। তারা ধারণা করেছিল যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার সঙ্গে যেসব মুসলমান যাচ্ছে, মক্কা থেকে তারা জীবিত ফিরে আসতে পারবে না। আল্লাহ তায়ালা সেসব মুনাফিকের ব্যাপারে নবীকে জানিয়ে দেন যে, ‘যখন তারা আপনার নিকট ফিরে আসবে তখন তারা না যাওয়ার বিভিন্ন অজুহাত পেশ করবে।’ (১১-১২)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদুল হারামে প্রবেশের যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে স্বপ্নের বিষয়টিও এ সূরায় উল্লেখ হয়েছে। (২৭)

সূরার শেষে তিনটি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

প্রথমত আল্লাহ তায়ালা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হেদায়েত ও দীনুল হকসহ পাঠিয়েছেন, যাতে তিনি অন্যান্য ধর্মের উপর এই ধর্মকে বিজয়ী করতে পারেন। ইনশাআল্লাহ কেয়ামতের পূর্বে এমনটি ঘটবে। উল্লেখ্য জ্ঞান ও দলিলের দিক থেকে ইসলাম আজও অন্যান্য ধর্মের ওপর বিজয়ী। (২৮)

দ্বিতীয় পর্যায়ে সাহাবিদের প্রশংসা করা হয়েছে। কাফেরদের ক্ষেত্রে তারা অত্যন্ত কঠোর। কিন্তু পরস্পরের মাঝে একে অন্যের প্রতি দয়ার্দ্র। তারা সকলেই আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি কামনা করে।

সবশেষে সেসব লোককে ক্ষমা এবং মহাপ্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ সম্পাদন করে (হে আল্লাহ, আপনি আমাদেরকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করে নিন। আমিন)।

সূরা হুজুরাত

এটি মাদানি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ১৮। রুকু সংখ্যা: ২

নামকরণ

হুজুরাত হুজরাতুন-এর বহুবচন, যার অর্থ হচ্ছে ঘর, কামরা। যেহেতু এ সূরায় সেসব লোকের আলোচনা এসেছে, যারা শিষ্টাচার ও আদব সম্পর্কে অবগত না হওয়ায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অন্য সবার মতো করে কামরার বাইরে থেকে জোরে জোরে ডাকত; তাই একে সুরা হুজুরাত বলা হয়।

এ সূরায় যেহেতু শিষ্টাচার ও উত্তম চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা এসেছে; তাই একে سورة الأخلاق والآداب আখলাক-শিষ্টাচারের সূরাও বলা হয়। এ সূরায় আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের পাঁচবার يا ايها الذين آمنوا বলে সম্বোধন করেছেন।

এ সূরার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে নিম্নে তুলে ধরা হলো;

১. সূরার শুরুতে আল্লাহ তায়ালা এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। মুমিনদের জন্য উচিত হচ্ছে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশনা সম্পর্কে জানতে না পারবে, ততক্ষণ নিজেদের অভিমত ও সিদ্ধান্ত প্রকাশ করবে না। তেমনিভাবে জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই কোরআন থেকে বিমুখ হয়ে নিজের মত অনুযায়ী চলবে না। এর পরের আয়াতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ‘তারা যেন আল্লাহর নবীকে সম্বোধন করতে গিয়ে আওয়াজ নিচু রাখে। যেভাবে তারা পরস্পরকে ডেকে থাকে সেভাবে যেন তাকে না ডাকে।’ (১-২) ২)

২. সমাজিক জীবনের নীতিমালা উল্লেখ করতে গিয়ে মুসলমানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তারা যেন গুজবে ও শোনা-কথায় কান না দেয়। যদি কেউ কোনো অনির্ভরযোগ্য ও ভিত্তিহীন সংবাদ নিয়ে আসে, তা হলে তারা যেন তা যাচাই করে নেয়। সংবাদ যাচাই করার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিদের প্রশংসা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ঈমানের মহব্বত সৃষ্টি করে দিয়েছেন এবং তা হৃদয়গ্রাহী করে দিয়েছেন। পক্ষান্তরে কুফর, পাপাচার ও নাফরমানির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। (৭)

৩. গুজবে (বা শোনা-কথায়) কান দেওয়া কখনো পরস্পর ঝগড়া-বিবাদ পর্যন্তও পৌঁছে দিতে পারে। এজন্য বলা হয়েছে, ‘মুসলমানদের দুই দল যদি পরস্পর বিবাদে জড়িয়ে পড়ে তা হলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। কেননা দুনিয়ার সকল মুসলমান, সে সাদা হোক বা কালো, আমির হোক বা গরিব, আরব হোক বা অনারব, সকলে ভাই-ভাই।’

৪. এরপর ছয়টি সামাজিক খারাবির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। যার ফলে পরস্পর সম্পর্কের অবনতি ঘটে থাকে, যারা এতে জড়িত হয় আল্লাহর নিকট তারা উত্তম বলে বিবেচিত হয় না।

প্রথম খারাবি হল একে অপরকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা। এই অসৎ কাজ থেকে বারণ করা হয়। সাধারণত মানুষ অন্যকে নীচু মনে করলে এবং নিজেকে তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করলে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে থাকে। এই কারণে বলা হয়েছে, যাকে নিয়ে তোমরা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করছ, আল্লাহর নিকট সে তোমাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ হতে পারে।

দ্বিতীয় খারাবি হল একে অপরের প্রতি দোষারোপ করা। কাউকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করা।

তৃতীয় খারাবি হল কাউকে মন্দ উপাধি দিয়ে অথবা নাম পরিবর্তন করে ডাকা।

চতুর্থ খারাবি হলো কারো ব্যাপারে প্রকৃত সত্য না জেনে খারাপ ধারণা করা বা অনুমান করে কথা বলা। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একে অত্যন্ত জঘন্য মিথ্যা বলে আখ্যা দিয়েছেন।

পঞ্চম খারাবি হলো মুসলমানদের দুর্বলতা ও গোপন দোষ অনুসন্ধান করা, ছিদ্রান্বেষণ করা।

হযরত আবু বারজা আসলামি রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন খুতবা দিতে গিয়ে বলেন, ‘ওহে যারা মুখে ঈমান এনেছ, কিন্তু তোমাদের অন্তরে ঈমান প্রবেশ করেনি, তোমরা মুসলমানদের দোষত্রুটি তালাশ কোরো না। যে এমন করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে তার ঘরে লাঞ্ছিত করবেন।’

ষষ্ঠ খারাবি হল গিবত করা। গিবতকে আল্লাহ তায়ালা মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। আল্লাহ তায়ালা এ জঘন্য কাজের এমন দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, বিবেকবান ও সুস্থ মনের মানুষ মাত্র যা ঘৃণা করে থাকে- গিবতকারী কোনো প্রাণীর নয়; বরং মানুষেরই গোশত খেয়ে থাকে।

যার গোশত খেয়ে থাকে সে আর কেউ নয়; তার আপন ভাই। কোনো জীবিত মানুষের নয়; বরং মৃত মানুষের গোশত খেয়ে থাকে।

৫. পরস্পর সম্পর্কের অবনতি ঘটার প্রধান কারণ হচ্ছে ধনসম্পদ, বংশ- প্রতিপত্তি নিয়ে গর্ব-অহংকার করা। এজন্য সুরা হুজুরাতে এর দ্বার রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, জাতিগোষ্ঠী, জাতপাত, বর্ণ-বংশ প্রভৃতি বিষয় মানুষকে কখনো আল্লাহর নিকট সম্মানিত বানায় না। আল্লাহর নিকট সম্মানিত হওয়ার একমাত্র মানদণ্ড হচ্ছে তাকওয়া তথা খোদাভীরুতা। অর্থাৎ সকল ধরনের শিরক ও হারাম থেকে বেঁচে থাকা। আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করা।

হাদিস শরিফে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা তোমাদের থেকে জাহেলিযুগের পিতৃপুরুষদের নিয়ে গর্ব-অহংকার খতম করে দিয়েছেন। জেনে রাখ, মানুষ দুই প্রকার। কিছুলোক নেককার, মুত্তাকি এবং আল্লাহর নিকট সম্মানিত। আর কিছু লোক হতভাগা, আল্লাহর নিকট লাঞ্ছিত। আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিঃসন্দেহে অধিক মুত্তাকিরাই আল্লাহর নিকট বেশি প্রিয়।

৬. শেষ আয়াতে বলা হয়েছে, মৌখিক ঈমানের কোনো মূল্য নেই; বরং যে ঈমান অন্তরের গভীরে থাকে, আল্লাহর নিকট তা গ্রহণযোগ্য। এ ছাড়াও মুমিনদেরকে আল্লাহর রাস্তায় জানমাল কোরবান করার প্রতি উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।

সূরা কাফ

এটি মক্কি সুরা। আয়াত সংখ্যা: ৪৫। রুকু সংখ্যা: ৪

এই সূরাতে ইসলামের মৌলিক আকিদা-বিশ্বাস নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সাধারণত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের মতো বড় জামাতে তা তেলাওয়াত করতেন। সূরার শুরুতে কোরআনুল কারিমের শপথ করা হয়েছে। কসমের উত্তর উল্লেখ করা হয়নি। এর উত্তর প্রচ্ছন্নভাবে উল্লেখ আছে। আর তা হচ্ছে, তিনি অবশ্যই মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করবেন। সূরার মাধ্যমে জানা যায়, মৃত্যু-পরবর্তী জীবন এবং একজন মানুষকে নবী হিসেবে প্রেরণ করা মুশরিকদের নিকট বড় আশ্চর্যের বিষয় ছিল। (২-৩)

অথচ এই পার্থিব দুনিয়ায় বিস্ময়কর অনেককিছু আছে, যাতে চিন্তাভাবনা করার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহ তায়ালার অসীম কুদরতের কথা জানতে পারে। (৬-১১)

এটা তো নতুন কিছু নয়; কারণ তাদের পূর্ববর্তী হজরত নুহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়, আদ-সামুদ ও ফেরাউনের সম্প্রদায়, এবং হজরত লুত ও শোয়াইব আলাইহিমুস সালামের সম্প্রদায়ও এভাবে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। (১২-১৪)

এ সূরা মানুষকে জানাচ্ছে যে, তাদের মনে যেসব ওয়াসওয়াসা ও কল্পনা- জল্পনা আসে, তার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর কাছেই আছে। প্রত্যেক মানুষের সাথে দুজন ফেরেশতা নির্ধারিত রয়েছে, যারা প্রমাণস্বরূপ তাদের কাজকর্ম ও কথাবার্তার হিসাব রাখে। যখন মৃত্যু চলে আসবে তখন তিনি তাদের আমলনামা ভাঁজ করে আনবেন। এরপর হাশরের ময়দানে এসব আমলের হিসাব করা হবে। তাকে এর জবাব দিতে হবে। (১৬-৩৭)

সূরার শেষে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুশরিকদের অনর্থক কার্যকলাপের ব্যাপারে ধৈর্যধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়। সকাল-সন্ধ্যা তাসবিহ ও ইবাদতের নির্দেশ প্রদান করা হয়। (৩৯-৪০)

শেষ আয়াতে বলা হয়েছে, এসব লোক যা বলে থাকে, আমি তা ভালোভাবেই জানি। আপনি এ ব্যাপারে জোরজবরদস্তকারী নন। যে আমার শাস্তির ভয় করে, তাকে আপনি কোরআন দ্বারা নসিহত প্রদান করুন। (৪৫)

সূরা যারিয়াত

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৬০। রুকু সংখ্যা: ৩

সূরার শুরুতে চার ধরনের বাতাসের শপথ করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের সঙ্গে যে বিষয়ে প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে, তা সত্য এবং ইনসাফের দিন অবশ্যই আসবে।’ (১-৬)

এরপর আকাশের শপথ করে বলা হয়েছে, তোমরা বিরোধপূর্ণ বিষয় নিয়ে পড়ে আছ। কালকের ও আজকের কাফের কেউ-ই কোনো বিষয়ের ওপর একমত নয়। কেয়ামত, কোরআন ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন কথা বলে থাকে। এরপর মুত্তাকিদের শুভ পরিণাম এবং তাদের উত্তম গুণাবলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা সৎকাজ করে। রাতে কম ঘুমায়। শেষরাতে তাওবা-ইসতিগফার করে। তাদের ধনসম্পদে ভিক্ষুক ও বঞ্চিত উভয় শ্রেণির অধিকার রয়েছে।

আল্লাহ তায়ালার মহত্ত্ব ও তার কুদরতের তিনটি নিদর্শন

মুত্তাকিদের গুণাবলি উল্লেখ করার পর আল্লাহ তায়ালার মহত্ত্ব ও তার কুদরতের তিনটি নিদর্শন উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রথম নিদর্শন হচ্ছে পৃথিবী। বলা হচ্ছে, পৃথিবীতে বিশ্বাসীদের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে। (২০)

পৃথিবী গোলাকার হওয়া সত্ত্বেও একে এমনভাবে বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেন কেউ পরিকল্পিতভাবে কোনো বিছানা পেতে রেখেছে। এতে চলাফেরার রাস্তা রয়েছে। রয়েছে মাঠ-ঘাট, পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র ও ঝরনাধারা। এ ছাড়াও এতে সোনা, রুপা, কয়লা, পেট্রোল প্রভৃতি মূল্যবান খনিজ পদার্থ রয়েছে। জীবনযাপনের জন্য মানুষের যা কিছু প্রয়োজন, পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা তার সব কিছুর ব্যবস্থা করেছেন।

দ্বিতীয় নিদর্শন মানুষ নিজেই। প্রকৃতপক্ষে এটি আশ্চর্য এক বিষয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের চেহারা-সুরত, চলনভঙ্গি, স্বভাব-চরিত্র, জ্ঞানবুদ্ধি সব ভিন্ন ভিন্ন। দেখা, শোনা, বলা, চিন্তাভাবনা, শ্বাস-প্রশ্বাস, হজম, রক্ত সঞ্চালন, গোটা শরীরের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম রগ-এতসব সুশৃঙ্খল ব্যবস্থার বিপরীতে হাল জমানার অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি কোনো মূল্যই রাখে না। এজন্য বলা হয়েছে, তিনি তোমাদের মধ্যে নিদর্শন রেখেছেন তোমরা কি তা দেখতে পাও না? (২১)

হজরত কাতাদা রহ. বলেন, যে-ব্যক্তি নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সৃষ্টি-কুশলতা নিয়ে চিন্তাভাবনা করবে সে নিজের সৃষ্টির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পারবে। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ইবাদতের জন্য নরম হয়ে যাবে।

তৃতীয় নিদর্শনের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তোমাদের রিজিক এবং তোমাদের সঙ্গে যে বিষয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে তা আকাশে রয়েছে। (২২)

মানুষের জীবনযাপনের উপকরণ আকাশ থেকে ব্যবস্থা হয়। বৃষ্টি বর্ষিত হয়। যার ফলে জমিন উর্বর হয়। তাতে বিভিন্ন ফল উৎপন্ন হয়। মানুষ তার মাধ্যমে জীবন ধারণ করে। যদি সূর্য উদিত না হতো, তা হলে কোনো শস্য উৎপন্ন হতো না। কোনো প্রাণী দুধ দিত না। বোঝা গেল, মানুষের জীবন বৃষ্টি ও চন্দ্র-সূর্যের উপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন মৌসুমের পরিবর্তনও এর মাধ্যমে হয়ে থাকে, শস্য উৎপন্ন হওয়া ও পরিপক্ক হওয়ার ক্ষেত্রে যার সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে।

ছাব্বিশতম পারার শেষে ফেরেশতাদের কথা আলোচনা করা হয়েছে। যারা ইবরাহিম আলাইহিস সালামের নিকট মেহমান হিসেবে এসেছিলেন। তিনি তাদেরকে মানুষ মনে করে নিজের উত্তম স্বভাববশত বাছুর জবাই করে তৎক্ষণাৎ তাদের পানাহার ও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। (২৪-২৭)

চলবে ইনশাআল্লাহ...

লেখক: আলেম ও ওয়ায়েজ; খতিব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।

(ঢাকাটাইমস/৫এপ্রিল/এসআইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :