ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-২৫

কেয়ামতের দিন মানুষ হাঁটু গেড়ে বসে থাকবে

মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী
| আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৯:৩৩ | প্রকাশিত : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৯:২৯

প্রিয় পাঠক,

জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল ঢাকা টাইমসের আয়োজনে আজ পবিত্র কোরআনুল কারীমের ২৫ তম পারা থেকে ধারাবাহিক তাফসির করছি।

চবিবশতম পারার শেষে আল্লাহ তায়ালার পূর্ণ ইনসাফের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, কেয়ামতের দিন কারো ওপর কোনো ধরনের জুলুম করা হবে না। এখন পঁচিশতম পারার শুরুতে কেয়ামতের ব্যাপারে বলা হয়েছে, এই দিবসের তারিখ সম্পর্কে আল্লাহ ব্যতীত কারো কোনো জ্ঞান নেই। মানুষজন ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসা-বাণিজ্য ও আমোদ-ফুর্তিতে মত্ত থাকবে এ অবস্থায় হঠাৎ কেয়ামত চলে আসবে।

আগের পর্ব: তাওবার দরজা খোলা রাখা বিশেষ রহমত

ঐদিন আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদের প্রশ্ন করবেন, তোমরা যাদের ইবাদত করতে তারা আজ কোথায়? তারা অত্যন্ত অনুশোচনার সাথে উত্তর দেবে, আজ আমাদের কেউ-ই আপনার সাথে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করার পক্ষে নয়। (৪৭)

আল্লাহ তায়ালার ওয়াদা সম্পূর্ণ সত্য

সূরার শেষে আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের সাথে ওয়াদা করেছেন, তিনি বিশ্বজগতে এবং মানুষের নিজেদের সত্তার মধ্যেই তাদেরকে বিভিন্ন নিদর্শন দেখাবেন। যখন তারা এসব নিদর্শনের কথা জানতে পারবে তখন বুঝতে পারবে যে এই কিতাব সত্য। (৫৩)

আল্লাহ তায়ালার ওয়াদা সম্পূর্ণ সত্য। চোদ্দশ বছর ধরেই এ ওয়াদা বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিশ্বজগৎ এবং মানুষের ব্যাপারে এমন তথ্য উদঘাটিত হচ্ছে, আগেকার যুগের মানুষ যা কল্পনাও করতে পারত না। বিশেষত গবেষণা, অনুসন্ধান ও আবিষ্কারের এ যুগে এমন কোনো দিন যায় না, যেদিন মানুষ এবং বিশ্বজগতের ব্যাপারে কোনো নতুন তথ্য ও আবিষ্কার সামনে আসে না।

বলুন তো, কে কল্পনা করেছিল যে, মানুষ এক সময় চাঁদ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে! পৃথিবী নামক এ গোলাকার গ্রহের চতুর্দিকে তারা প্রদক্ষিণ করবে!! কারও কল্পনায় ছিলো না যে, প্রাচ্যে বসবাসকারীদের কথাবার্তা পাশ্চাত্যের কেউ শুনতে পাবে। পাশ্চাত্যের কারও কথা প্রাচ্যের কেউ শুনতে পাবে। বর্তমানে তো শুধু আওয়াজই নয়; বরং তাদের চেহারা-আকৃতি, নড়াচড়া সবকিছুই দেখা যায়।

একটা সময় ছিলো মানুষ যখন সূর্যকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বস্তু মনে করে তার সামনে মাথানত করত। মানুষ এখন জানতে পেরেছে যে, সূর্য গোটা বিশ্বের ও মহাশূন্যের ছোট্ট এক নক্ষত্র মাত্র। এর চেয়েও কয়েকশ মিলিয়ন বড় সূর্য (নক্ষত্র) দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেছে।

মানুষ এখন নদী ও সমুদ্রের পেটে প্রবেশ করেছে। তার লুক্কায়িত বস্তুনিচয় প্রত্যক্ষ করেছে। মানবদেহ, তার গঠন-প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও তার রহস্যাদির ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পেরেছে। নফসের ব্যাপারেও তারা কিছু রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে।

কিন্তু এসব সত্ত্বেও একমাত্র আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত এমন কে আছে, যে দাবি করতে পারবে সে মানুষ এবং তাবৎ বিশ্বের যাবতীয় সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক রহস্যের শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।

কোরআনের অলৌকিকতা

জ্ঞান ও গবেষণার অগ্রগতি সত্ত্বেও কোরআন ব্যতীত কোনো গ্রন্থই কখনো এমন দাবি করতে পারবে না। এটাই কোরআনের সর্বদার জন্য মুজিজা হওয়ার কথা প্রমাণ করে।

এ কোরআন হযরত মুসা আলাইহিস সালামের লাঠি ও সুলাইমান আলাইহিস সালামের হাওয়াই-সিংহাসনের মতো বস্তুগত কোনো মুজিজা নয়; বরং এটা জ্ঞানময় যুগের এক জ্ঞানগত মুজিজা। মানুষ জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যতই উৎকর্ষ সাধন করবে, তাদের নিকট ততই কোরআনের সত্যতা স্পষ্ট হতে থাকবে। অচিরেই সে সময় ঘনিয়ে আসবে যখন সকল নিরপেক্ষ মানুষ কোরআনের সামনে নিজেদের মাথা নত করে দেবে, ইনশা আল্লাহ।

সূরা শুরা

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৫৩। রুকু সংখ্যা: ৫

অন্যান্য মক্কি সূরার ন্যায় এতেও আকিদাগত বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তবে ওহী ও রিসালাতের উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

কোরআনের মুজিজা হওয়া এবং বিরোধীদের তার অনুরূপ কোনো কিতাব আনতে অক্ষম হওয়ার বিষয়টি ফুটিয়ে তোলার জন্য ‘হরফে মুকাত্তায়াত’ দ্বারা তা শুরু করা হয়েছে। এ হরফগুলোর মাধ্যমেই তো পুরো কোরআন লেখা হয়েছে। কোরআন যদি মানবরচিতই হয়ে থাকে তা হলে তোমরাও এসব হরফের সমন্বয়ে কোরআনের মতো কোনো কিতাব তৈরি করে দেখাও। পূর্ণ কোরআন না পারো কমপক্ষে কোরআনের মতো ছোট্ট থেকে আরও ছোট্ট কোনো সূরাই বানিয়ে দেখাও। তোমাদের এ কাজের ফলে নাউজুবিল্লাহ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা যাবে। তখন তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে কোনো প্রোপাগান্ডার আশ্রয় নিতে হবে না। অর্থ-সম্পদ ব্যয় করতে হবে না। সন্তান ও ভাইদের যুদ্ধের ঝুঁকিতে ফেলতে হবে না। কিন্তু কোরআনের এ চ্যালেঞ্জ গতকালের কাফেররা যেমন গ্রহণ করেনি তেমন আজকের কাফেররাও তা গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়।

‘হরফে মুকাত্তায়াত’ দ্বারা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে, এমনিভাবে আপনার নিকট এবং আপনার পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের নিকট পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাবান আল্লাহ ওহী প্রেরণ করতেন। অর্থাৎ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবার ক্ষেত্রেই ওহীর ঝরনাধারা একটাই। মাঝে আল্লাহ তায়ালার মহত্ত্ব বর্ণনা করার পর পুনরায় ওহী ও কোরআনের আলোচনা করা হয়েছে।

ইরশাদ হচ্ছে, এমনিভাবে আমি আপনার প্রতি আরবি ভাষায় কোরআন নাজিল করেছি, যাতে আপনি মক্কা ও তার আশপাশের লোকদের সতর্ক করেন এবং সতর্ক করেন সমাবেশের (কেয়ামতের) দিন সম্পর্কে, যাতে কোনো সন্দেহ নেই। (৭)

ওহী ও রিসালাতের বিষয়কে দৃঢ় করার জন্য বলা হয়েছে, আল্লাহর নিকট ধর্ম একটাই। সকল নবী-রাসূল এক ধর্মের দিকে দাওয়াত দিয়েছেন। তাদের শরিয়ত যদিও ভিন্ন ভিন্ন ছিল; কিন্তু তাদের সবার দীন এক ছিলো। অর্থাৎ সবার ধর্ম ছিল ইসলাম। হযরত নুহ, হযরত ইবরাহিম, হযরত মুসা, হযরত ঈসা আলাইহিমুস সালামকে এই দীনের প্রতি আহ্বান করার জন্যই দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছিল।

তাদের অনুসারীদেরকে বিভেদ-বিভক্তি করা থেকে বারণ করা হয়েছিল। কিন্তু কিতাবিরা হিংসা ও বিদ্বেষবশত দলাদলি সৃষ্টি করেছে। তাদের এসব মতভিন্নতা ও মতবিরোধ মেটানোর জন্য এবং বিভেদ দূরীভূতকারী সিদ্ধান্ত শোনানোর জন্য আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাঠানো হয়।

তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়; সুতরাং আপনি এর প্রতিই দাওয়াত দিন। আপনাকে যে বিষয়ের হুকুম দেওয়া হয়েছে তার উপর দৃঢ় ও অবিচল থাকুন। তাদের খেয়াল- খুশির অনুসরণ করবেন না। বলুন, আল্লাহ যে কিতাব নাজিল করেছেন, আমি তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমি তোমাদের মধ্যে ন্যায়বিচার করতে আদিষ্ট হয়েছি। (১৫)

এই সূরায় সামনে যতই আলোচনা করা হয়েছে ওহী ও রিসালাতের বিষয়টি তত্তই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ওহী ও রিসালাত ছাড়াও পৃথিবীতে ঈমানের যেসব দায়াটি ও নিদর্শন রয়েছে, তার প্রতি মনোনিবেশ করা হয়েছে।

মুমিনদের কয়েকটি গুণ

মুমিনদের কয়েকটি গুণ উল্লেখ করা হয়েছে, নিম্নে তা পত্রস্থ করা হল:

ক. তারা নিজেদের রবের উপর ভরসা রাখে।

খ. পাপাচার ও অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকে।

গ. কারো ওপর রাগ চলে এলে তাকে ক্ষমা করে দেয়।

ঘ. রবের আনুগত্য করে।

ঙ. নামাজের প্রতি যত্নবান থাকে।

চ. পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করে।

ছ. আল্লাহপ্রদত্ত ধনসম্পদ তার রাস্তায় ব্যয় করে।

জ. যদি তাদের ওপর কেউ কোনো জুলুম ও বাড়াবাড়ি করে তা হলে তারা উত্তমভাবে তার বদলা নেয়।

মুসলমানরা যদি এসব বিষয় নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে পারে তা হলে তাদের ব্যক্তিগত ও সমাজ-জীবনে বিপ্লব সাধিত হবে।

সূরা শুরার শেষ দুই আয়াতে ওহী ও রিসালাত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। অর্থাৎ সূরার শুরু ও সমাপ্তি উভয়টি একই বিষয়ের আলোচনার মাধ্যমে হল।

সূরা যুখরুফ

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৮৯। রুকু সংখ্যা: ৭

নামকরণ

যেহেতু এ সূরায় যুখরুফ (স্বর্ণ ও সৌন্দর্য) শব্দটি এসেছে; তাই একে সূরা যুখরুফ বলা হয়। ঈমানের মৌলিক বিষয়গুলোই এ সূরার আলোচ্য বিষয়। অন্যান্য হা-মীম এর মতো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থায়ী মুজিজা- কোরআনের আলোচনা দিয়েই সূরাটি শুরু হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট উজ্জ্বল এই কিতাবের শপথ করে বলেন, আমি একে আরবি ভাষায় কোরআন বানিয়েছি, যাতে তোমরা বুঝতে পারো। নিশ্চয় এই কোরআন আমার কাছে সমুন্নত অটল রয়েছে লাওহে মাহফুজে।

এরপর সূরা যুখরুফে আল্লাহর কুদরতের দলিল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। নীল আকাশ, বিস্তৃত জমিন, অত্যুচ্চ পাহাড়, প্রবাহিত নদী-নালা, বিস্তৃত সমুদ্র, আকাশ থেকে বর্ষিত ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি, পানির উপর চলমান নৌযান, সকল ধরনের চতুষ্পদ জন্তু, যার কিছু গোশত খাওয়ার কাজে আসে, আর কিছু দ্বারা ভারী ভারী বোঝা বহন করা যায়, এ সবকিছু নিজেদের স্রষ্টার অপার কুদরত ও হেকমতের সাক্ষ্য দিচ্ছে। শহরে-গ্রাম্য, জ্ঞানী-মূর্খ নির্বিশেষ সকলেই এ সাক্ষ্য বুঝতে পারে। তাদের সাক্ষ্য পূর্বে যেমন বিদ্যমান ছিল, আজও তেমনি বিদ্যমান। প্রয়োজন শুধু কানের, যা এই সাক্ষ্য শুনবে। প্রয়োজন কিছু চক্ষুর, যা এই সাক্ষ্য প্রত্যক্ষ করবে। প্রয়োজন কিছু অন্তরের, যা এই সাক্ষ্য গ্রহণ করে নেবে।

এ সূরায় জাহেলি যুগের অত্যন্ত ঘৃণ্য একটা বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তা হচ্ছে, কন্যাসন্তানকে তারা অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখত। যদি কারো কন্যাসন্তান জন্ম নিতো, তা হলে সে লোকদের থেকে চেহারা লুকাতো। তাকে জীবন্ত পুতে ফেলার চিন্তা করত। অন্যদিকে তারা আল্লাহর দিকে এসব মেয়েকে সম্বোধিত করত। ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর কন্যা বলে আখ্যা দিত তারা। (১৫-১৬)

সূরা যুখরুফে আবুল আমবিয়া হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের আলোচনা করা হয়েছে, যার ব্যাপারে মুশরিকরা বলে থাকে, আমরা তার দীন ও শরিয়তের অনুসরণ করে থাকি। এখানে তাদের এ দাবি খণ্ডন করে বলা হয়েছে, মূর্তিপূজারিরা কীভাবে নিজেদেরকে তার শরিয়তের অনুসারী মনে করে; অথচ তিনি একত্ববাদের পতাকাবাহী ছিলেন, আর তারা পা থেকে মাথা পর্যন্ত শিরকে ডুবে আছে? হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তার সন্তানদের একত্ববাদের শিক্ষাই দিয়েছেন। (২৬-২৮)

শেষনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুশরিকদের কালিমার দাওয়াত দিয়েছেন তখন তারা এ দাওয়াতকে জাদু এবং তাকে জাদুকর বলে আখ্যা দিয়েছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে তাদের এসব বক্তব্য নিরেট মূর্খতা বৈ কিছু নয়। তারা বলে, ‘এ কোরআন কেন দুই বড় জনপদের কারো ওপর অবতীর্ণ হল না?’ (৩১)

আল্লাহ তায়ালা কি নবী বানানোর জন্য এই এতিম, গরিব মানুষটিকেই পেলেন? তায়েফ এবং মক্কার কোনো সরদার কি তার নজরে পড়ল না? এর জবাবে যা বলা হয়েছে, তার সারমর্ম হল, জীবনযাপনের উপকরণের ওপর যাদের নিজেদের কোনো অধিকার নেই, তারা নিজেরাই নিজেদের রিজিকের মালিক নয়। যেখানে রিজিক বণ্টনের ক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছার কোনো দখল নেই, সেখানে নবুওয়াতের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কীভাবে তাদের ইচ্ছাধিকার থাকতে পারে? (৩২)

এরপর এ সূরায় হযরত মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। যার মাধ্যমে মুশরিকদের বোকামি ও মূর্খতার চিত্র ফুটে ওঠে। ফেরাউনের নিজের ধনসম্পদ, সোনা-দানা অর্থকড়ির উপর অনেক অহংকার ছিল। সে নিজেকে মিসরের জমিন, নদী-নালার প্রকৃত মালিক মনে করত। আর মুসা আলাইহিস সালামকে অত্যন্ত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত। পরিশেষে যেসব নদীর ব্যাপারে মনে করত যে, তার নির্দেশ ছাড়া প্রবাহিত হতে পারে না, তাকে সেসব নদীতেই ডুবিয়ে মারা হয়েছে। (৪৬-৫৬)

সূরার শেষে আল্লাহ তায়ালা নিজ নবীকে মূর্খদের থেকে বিমুখ হয়ে ধৈর্যধারণের নির্দেশ দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আপনি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন এবং তাদের সালাম বলুন। অচিরেই তারা নিজেদের পরিণাম সম্পর্কে জানতে পারবে।’ (৮৯)

সূরা দুখান

এটি মক্কি সুরা। আয়াত সংখ্যা: ৫৩। রুকু সংখ্যা: ৩

দুখান অর্থ ধোঁয়া। এ সুরায় যেহেতু চরম দুর্ভিক্ষের কারণে মুশরিকদের চোখে ধোঁয়া দেখার বিষয়টি উল্লেখ হয়েছে; তাই একে ‘সূরা দুখান’ বলা হয়।

সূরার শুরুতে আল্লাহ তায়ালা কিতাবুম মুবিন তথা সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ করেছেন। মুজিজার দিক থেকেও এই কিতাব সুস্পষ্ট এবং বিধান ও বিষয়ের দিক থেকেও সুস্পষ্ট। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা এ ব্যাপারে শপথ করেছেন যে, আমি এই কিতাবকে মোবারক রাতে অবতীর্ণ করেছি। এর দ্বারা লাইলাতুল কদর উদ্দেশ্য, যা সকল রাতের চেয়ে উত্তম। আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের উপর রহমতস্বরূপ তা অবতীর্ণ করেছেন। অন্যথায় তিনি তো বান্দার কোনো ইবাদতের মুখাপেক্ষী নন। বান্দাকে হেদায়েত থেকে বঞ্চিত না করাটা তার রুবুবিয়্যাতের তাকাজা। (১-৮)

মক্কার ফেরাউনদেরকে সেই ফেরাউনের পরিণামের ব্যাপারে সতর্ক করা কিন্তু মুশরিক ও কাফেররা কোরআন ও পুনরুত্থানের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের ফেরাউনদেরকে মুসা আলাইহিস সালামের যুগের বিরোধিতাকারী ফেরাউনের পরিণামের ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে, যার মালিকানায় সোনা-রুপা, বাগবাগিচা, অসংখ্য অট্টালিকা, সোনা-ফলা জমিন, হাজার হাজার গোলাম-বাঁদি, লক্ষ লক্ষ সৈন্যের বাহিনী ছিল।

মোটকথা মিসরে যা ছিলো তার সবই তাদের ছিলো। তারা নিজেদের সকল সপ্রাণ ও নিষ্প্রাণ জিনিসের মালিক ভাবত। কিন্তু এসব তাদের কোনো কাজে আসেনি। তারা নিজেদের শাসিত ও নির্যাতিতদের সামনে সমুদ্রের নির্দয় ঢেউয়ের মুখে اصلت آمنت (ঈমান আনলাম, ঈমান আনলাম) বলতে বলতে মারা যায়। কিন্তু ওই চিৎকার তাদের কোনো কাজে আসেনি। বনি ইসরাইলকে তারা পেছনে ফেলে আসা সবকিছুর উত্তরাধিকারী বানিয়ে যায়। গতকালের শাসিতরা আজকের শাসক বনে যায়। আর গতকালের মালিকরা আজকের গোলামে পরিণত হয়। (১৭-২৯)

সূরার শেষে সেই ভয়ঙ্কর আজাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, প্রত্যেক নাফরমান বান্দাকে যার মুখোমুখি হতে হবে। এ ছাড়াও আল্লাহ তায়ালার সেসব নেয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা নেককার বান্দাদের দেওয়া হবে, মানুষ যার কল্পনাও করতে পারে না। (৪৩-৫৭)

সূরা জাসিয়া

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৩৭। রুকু সংখ্যা: ৪

আশাকরি আপনারা জেনে থাকবেন যে, যেসব সূরা ‘হরফে মুকাত্তায়াত’ দ্বারা শুরু হয় তার অধিকাংশের শুরুতেই আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে বড় মুজিজা কোরআনুল কারিমের আলোচনা করা হয়ে থাকে। সূরা জাসিয়ায় এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।

নামকরণ

জাসিয়া অর্থ হাঁটু গেড়ে বসা। কেয়ামতের দিন মানুষ যেহেতু ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আল্লাহর সামনে হাঁটু গেড়ে বসবে, আর এ সুরায় সেই ভয়ংকর দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তাই একে সূরা জাসিয়া বলা হয়।

কোরআনুল কারিমের শ্রেষ্ঠত্বের আলোচনার পর এ সূরায় সেসব তাকবিনি (সৃষ্টিগত) নিদর্শনের কথা বলা হয়েছে, যার প্রত্যেকটি আল্লাহ তায়ালার কুদরত, একত্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের জীবন্ত সাক্ষ্য। (৩-৬)

এরপর সেসব অপরাধীর নিকৃষ্ট চেহারা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যারা আল্লাহর আয়াত শোনা সত্ত্বেও তা অস্বীকার করে থাকে। অহংকারবশত তারা নিজেদের অবস্থা এরকম করে রাখে যেন তারা কোনো আয়াত শুনতেই পায়নি। (৭-৮)

এ ছাড়াও বনি ইসরাইলকে কিতাব, হেকমত, নবুওয়াত, উত্তম রিজিক, বিশ্ববাসীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব, সম্মান প্রভৃতি যেসব নেয়ামত প্রদান করা হয়েছিল তাও আলোচিত হয়েছে। উচিত ছিল তো এসব নেয়ামতপ্রাপ্তির কারণে আল্লাহ তায়ালার অনুসরণ করা। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তারা ক্রমাগত অবাধ্যতা ও পাপাচারে মত্ত ছিলো। (১৬-১৭)

মক্কার কাফের; বরং প্রত্যেক যুগের কাফেরদের বোঝানোর জন্য অতীতের এসব ঘটনা বর্ণনা করা হয়। কাফের সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের হোক বা বর্তমান যুগের, তাদের অস্বীকৃতির সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে তারা দুনিয়ার জীবনকেই সবকিছু মনে করে থাকে। (২৪-২৫)

পক্ষান্তরে কোরআন বারবার সেই দিনের ওপর ঈমান আনতে বলে যেদিন সৎ- অসৎ প্রত্যেককেই তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান দেওয়া হবে। কোরআন কোথাও কঠোরভাবে, কোথাও নরম ভাষায় উপদেশমূলক আলোচনা করেছে। কোথাও সংবাদ দেওয়ার রীতিতে, কোথাও প্রশ্নোত্তরের রীতিতে এ আলোচনা করা হয়েছে। কোথাও এমন চিত্র তুলে ধরা হয় যে, কোরআনের পাঠক যেন দুনিয়াতে অবস্থান করেই কেয়ামতের সে ভয়ানক দৃশ্য নিজ চোখে দেখতে পায়।

এ সূরার শেষেও কেয়ামত দিবসের সেই ভয়ানক চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। মনে হয় কেয়ামত এখনই সংঘটিত হয়ে গেছে। হাশরের ময়দান কায়েম হয়ে গেছে। মানুষ ভয়ে ভীত-বিহ্বল হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। আল্লাহ তায়ালা বান্দাদের সম্বোধন করছেন। তিনি বলছেন, ‘তোমরা এইদিনকে ভুলে ছিলে, আজ তোমাদের ভুলে যাওয়া হবে। তোমরা আল্লাহর আয়াত নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে, আজ তোমরা নিজেরাই ঠাট্টার পাত্র হয়ে যাবে।’ (২৮-৩৫)

চলবে ইনশাআল্লাহ...

লেখক: আলেম ও ওয়ায়েজ; খতিব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।

(ঢাকাটাইমস/৪এপ্রিল/এসআইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :