ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-২৪

তাওবার দরজা খোলা রাখা বিশেষ রহমত

​​​​​​​মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী
| আপডেট : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৭:৫৮ | প্রকাশিত : ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৮:১৭

প্রিয় পাঠক,

জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল ঢাকা টাইমসের আয়োজনে আজ আমার পবিত্র কোরআনুল কারীমের ২৪ তম পারার ধারাবাহিক তাফসির নিয়ে আলোচনা করছ, ইনশাআল্লাহ।

সূরা যুমার-এর যে অংশ চব্বিশতম পারায় স্থান পেয়েছে, তার কিছু অংশ নিয়ে তুলে ধরা হল:

১. কোরআন গোটা দুনিয়ার মানুষকে দুই ভাগ করেছে। এক ভাগ কাফের, যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করে। কোরআন ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম। দ্বিতীয় ভাগ হল নবী এবং তার অনুসারীগণ। তাদের ঠিকানা জান্নাত। (৩৩-৩৪)

তাওবার দরজা খোলা রাখা বিশেষ রহমত

২. বান্দার উপর আল্লাহ তায়ালার বিশেষ রহমত ও অনুগ্রহের মাঝে এটাও যে, তিনি পাপাচারী, অনাচারী ও কাফেরদের জন্য রহমত ও তাওবার দরজা খোলা রেখেছেন। তিনি তাদেরকে তাওবা এবং আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের দাওয়াত দিয়েছেন। পাপাচারীদেরকে তিনি নিরাশ করেন না; বরং তাদের অন্তরে আশার প্রদীপ প্রজ্বলিত করেন। তিনি বলেছেন, আপনি বলে দিন, হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের উপর সীমালঙ্ঘন করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। নিঃসন্দেহে তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল এবং পরম দয়ালু।

বলা হচ্ছে, তোমাদের উপর আজাব আসার পূর্বে তোমরা তোমাদের পালনকর্তার অভিমুখী হও এবং তার সমীপে আনুগত্য প্রকাশ করো। এরপর তোমরা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না। তোমাদের কাছে অতর্কিতে ও অজ্ঞাতসারে আজাব আসার পূর্বে তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ উত্তম বিষয়ের অনুসরণ করো। (৫৩-৫৫)

৩. বান্দার তাওবা কবুলকারী আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনের দাওয়াত দেওয়ার পর কেয়ামতের বিভিন্ন দৃশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। যখন আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপকারীদের চেহারা কালো হয়ে যাবে, শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হবে, সবাই যখন আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে, জীবনের হিসাব নেওয়া হবে এরপর কাফেরদের টেনে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে আর মুত্তাকিদের জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে তখন ফেরেশতারা তাদেরকে সালামের মাধ্যমে অভিবাদন জানাবে। তারা আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে নিজেদের ঠিকানায় প্রবেশ করবে। (৬০-৭৩)

আগের পর্ব: কোরআনে বর্ণিত হাজার বছর আগের ভবিষ্যদ্বাণী ও কেয়ামতের ভয়ংকর দৃশ্য

সূরা গাফির

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৮২। রুকু সংখ্যা: ৯

এ সূরার বিষয় হল হক-বাতিল, হেদায়েত ও গোমরাহির মধ্যকার যুদ্ধের বর্ণনা দেওয়া। এই সূরাকে সূরা মুমিনও বলা হয়।'

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্থায়ী মুজিজা কোরআনের মাধ্যমে সূরার সূচনা হয়েছে, বহু শতাব্দী অতিক্রম করার পরও যা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতের সাক্ষ্য দিচ্ছে। আল্লাহ তায়ালার জ্ঞান কখনো সেকেলে হয় না। তা আজও সঠিক ও নির্ভুল। আধুনিক বিজ্ঞানও তার সমর্থন করে। প্রতিনিয়ত এ জ্ঞান-বিজ্ঞানের যত উৎকর্ষ সাধন হবে, ততই তা কোরআনুল কারিম মুজিজা হওয়ার স্বীকৃতি দেবে। তবে শর্ত একটাই। এজন্য সুস্থ বিবেক এবং ঘৃণা-বিদ্বেষ ও দলান্ধতামুক্ত অন্তর থাকতে হবে।

কোরআনের ওহী হওয়ার আলোচনার পর এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালার চারটি গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তা হচ্ছে তিনি গুনাহ ক্ষমাকারী, তাওবা কবুলকারী, কঠোর শাস্তিদাতা এবং বান্দাদের উপর অনুগ্রহকারী। (৩)

এ ছাড়াও এ সূরায় যেসব বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে নিম্নে তার কিছু তুলে ধরা হল:

আরশ বহন বেষ্টনকারী ফেরেশতাদের হামদ

১. যেসব ফেরেশতা আরশ বহন করে থাকে এবং যারা আরশ বেষ্টন করে আছে, তারা সকলেই আল্লাহ তায়ালার হামদ ও তাসবিহ পাঠ করার সাথে সাথে মুমিনদের জন্য দোয়া করে থাকে। তারা বলে, 'হে আমাদের প্রতিপালক, আপনার জ্ঞান ও রহমত প্রত্যেক জিনিস পরিবেষ্টন করে আছে। তাই যারা তাওবা করে এবং আপনার পথের অনুসরণ করে তাদেরকে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা করুন। হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি তাদেরকে যে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেখানে তাদেরকে এবং তাদের পিতৃপুরুষ, সন্তানসন্ততি ও স্ত্রীদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল, তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন। নিশ্চয় আপনি মহাপরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়। এবং আপনি তাদেরকে অমঙ্গল থেকে রক্ষা করুন। যাকে সেদিন অমঙ্গল থেকে রক্ষা করবেন, তার প্রতি আপনি অনুগ্রহই করবেন। এটাই মহাসাফল্য'। (৭-৮)

জাহান্নাম

২. কোরআনের এক বিশেষ রীতি হচ্ছে, এতে সুসংবাদ প্রদানের পর ভীতিপ্রদর্শন করা হয়। জান্নাতের পর জাহান্নাম, মুমিনদের পর কাফেরদের আলোচনা করা হয়। আলোচ্য সুরায়ও এ রীতি অবলম্বন করা হয়েছে। প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নিকটবর্তী ফেরেশতারা মুমিনদের জন্য দোয়া করে থাকে। এখন উল্লেখ করা হচ্ছে, পাপাচারী-অনাচারীদের যখন উত্তপ্ত আগুনে নিক্ষেপ করা হবে তখন তারা নিজেদের কৃতকর্মের মন্দ পরিণতি দেখতে পাবে। সেসময় তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠবে। নিজেদের তারা মন্দ বলতে থাকবে। বিভিন্ন ওজর পেশ করতে থাকবে। দুনিয়ায় তারা যে দম্ভ ও অহংকার প্রদর্শন করেছিল তা ভুলে গিয়ে তখন লাঞ্ছনা-অপদস্থতার সাথে আগুন থেকে বের হওয়ার আবেদন করবে। কিন্তু তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হবে। জাহান্নামের দারোগা তাদেরকে বলবে, আজকে নিজেদের প্রতি তোমাদের যে ক্ষোভ, এর চেয়েও অধিক ছিল আল্লাহর ক্ষোভ, যখন তোমাদেরকে ঈমান আনতে বলা হতো, আর তোমরা কুফুরি করতে। (১০-১২)

কেয়ামতের দিবস তো বান্দাদের মধ্যে ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার দিন। আজ প্রত্যেককে তার ভালো-মন্দ কর্মের প্রতিদান দেওয়া হবে।

ফেরাউনের ঘটন

৩. কাফেরদের উপর আল্লাহর আজাবের কথা আলোচনা করে জুলুম ও অবাধ্যতা-হেতু কুখ্যাত ফেরাউনের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, মুসা আলাইহিস সালামের সাথে যা সংঘটিত হয়েছিল। একটি বাস্তবতা বোঝানোর জন্য ঘটনাটি বর্ণনা করা হয়েছে; অত্যাচারী ও অহংকারীদের পরিণাম কখনো ভালো হয় না।

একজন মুমিন বান্দার আলোচনা

হজরত মুসা আলাইহিস সালামের ঘটনা বহু সুরায় বিভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু সুরা গাফিরে সে ঘটনার পাশাপাশি একজন মুমিন বান্দার আলোচনা করা হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে এ সুরাকে সুরা মুমিনও বলা হয়। এই মানুষটি গোপনে ঈমান এনেছিল। যখন মুসা আলাইহিস সালামকে হত্যার ব্যাপারে পরামর্শ হতে থাকে তখনই মুমিন ব্যক্তি তাকে রক্ষা করার জন্য দাঁড়িয়ে যায়। সে বলতে থাকে, তোমরা কি শুধু এই কারণেই একজনকে হত্যা করবে, যিনি বলেন 'আল্লাহ আমার রব'? তিনি তো তোমাদের নিকট সুস্পষ্ট দলিল ও উজ্জ্বল মুজিজা নিয়ে এসেছেন। কিন্তু ফেরাউন আপন সিদ্ধান্তে অটল থাকে। পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেয়, আমার সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত এটাই যে, মুসাকে হত্যা করা হবে। এটা ছাড়া কোনো কথা গ্রহণযোগ্য হবে না।

(প্রিয় পাঠক, যদি আপনি বর্তমান পরিস্থিতির উপর একটু নিরীক্ষণ চালান, তা হলে দেখতে পাবেন, আজকের স্বৈরশাসকদের চিন্তা-চেতনাও এরকম। গতকাল এবং আজকের স্বৈরশাসকদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। তারা নিজেদের মুখ থেকে বের হওয়া প্রত্যেক কথাকে সর্বশেষ কথা বলে মনে করে। গোটা বিশ্ব এভাবেই স্বৈরশাসকদের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে। মুসলিম উম্মাহর ঘাড়ে এমন অহংকারী শাসকরা চেপে বসে আছে, যারা নিজেদেরকেই সবকিছু মনে করে। কোনো আলেমের সিদ্ধান্তেরই তারা পরোয়া করে না।

এই মুমিন ব্যক্তিটির বক্তব্য ও আলোচনা এতটাই মর্মস্পর্শী ছিল যে, ফেরাউন এতে ভয় পেয়ে যায়। সে আশঙ্কা করে কখন যেন আমার সভাসদবর্গ তার কথায় সায় দিয়ে বসে। সে তাই প্রথমেই নিজের সিদ্ধান্ত শুনিয়ে দেয় যে, এখন মুসা ও হারুন- কারও অস্তিত্ব সহ্য করা হবে না। এরপর মুমিন ব্যক্তির হৃদয়স্পর্শী কথাকে ঠাট্টাচ্ছলে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য সে নিজের উজির হামানকে নির্দেশ দেয় যে, আমার জন্য এক বিশাল অট্টালিকা তৈরি করো। যেন আমি দেখতে পারি মুসা যে

খোদার কথা বলে থাকে আসলে তার কোনো অস্তিত্ব আছে কি না?

এটাই চতুর শাসকদের অভ্যাস। তারা কখনো হুমকি-ধমকি উচ্চারণ করে আবার কখনো বিরুদ্ধবাদীদের মতকে ঠাট্টা-মশকরার পাত্র বানিয়ে সে কথার গুরুত্বও লোকদের নিকট থেকে কমিয়ে ফেলে।

ফেরাউনের এই হাসি-ঠাট্টা সত্ত্বেও মুমিন ব্যক্তি নিজ আলোচনা চালিয়ে যায়। কিন্তু এটা তো স্পষ্ট যে, ফেরাউন মুসা আলাইহিস সালামের উপর ঈমান আনার মতো ব্যক্তি ছিল না। আর সে তার সভাসদদের কাউকে তার প্রতি ঈমান আনার সুযোগও দেয়নি। ফল এই হয়েছে যে, মুমিন ব্যক্তি আল্লাহর আজাব থেকে পরিত্রাণ পেয়ে গেছে। কিন্তু ফেরাউন ও তার সহযোগীরা আজাবে ডুবে গেছে। এই আজাব কবরেও তাদের পিছু ছাড়বে না। সকাল-সন্ধ্যা তাদের নিকট তা আসতে থাকবে। পরকালে তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি। (২৮-৪৬)

এসব হচ্ছে তার নেয়ামত

৪. ফেরাউনের মতো অকৃতজ্ঞ, অহংকারী ও অত্যাচারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আলোচনার পর আল্লাহ তায়ালা কিছু নেয়ামতের আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, প্রশান্তির জন্য আল্লাহ তায়ালা রাত, এবং জীবিকা উপার্জন ও দেখার জন্য দিনের ব্যবস্থা করেছেন। চলাফেরার জন্য জমিন প্রস্তুত করেছেন। আকাশকে ছাদ বানিয়েছেন। তিনি তোমাদেরকে উত্তম আকৃতিতে গঠন করেছেন। তোমাদের জন্য উত্তম রিজিকের ব্যবস্থা করেছেন। এসব হচ্ছে তার নেয়ামত। কিন্তু মানুষ এসব নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে না। যে উদ্দেশ্যে এসব নেয়ামত দান করা হয়েছে, সেই উদ্দেশ্যে তারা তা ব্যবহার করে না। তা নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করে এর স্রষ্টা পর্যন্ত তারা পৌঁছে না। (৬১-৬৫)

মানুষ যদি শুধু নিজের সৃষ্টি নিয়েই চিন্তাভাবনা করে, তা হলে এতেই সে আল্লাহর পরিচয় লাভ করতে পারবে। জন্মের সময় প্রতিটি মানুষই কয়েকটি স্তর অতিক্রম করে থাকে। আর প্রতিটি স্তরই অত্যন্ত বিস্ময়কর, যা চিন্তা করলে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। প্রাণহীন মাটি থেকে শুরু হয়, এরপর বীর্য, বীর্ষ থেকে জমাট রক্ত, মাংস, হাড্ডি, এরপর একটি শারীরিক কাঠামো, বিবেক, চক্ষু, কান, শরীরে ছড়ানো হাজার হাজার মাইল দীর্ঘ রগ, রক্তের সঞ্চালন, হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন, তিনশ ষাট জোড়া সবকিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন।

জন্মের সময় নিতান্ত দুর্বল, বাক ও বোধ-বিবেচনাশক্তিহীন থেকে আল্লাহ তায়ালা তাকে জ্ঞানবুদ্ধি ও বিচার-বিবেচনা দান করেছেন। সে শৈশব অতিক্রম করে যৌবনে পদার্পণ করে। এরপর বার্ধক্য তাকে জেঁকে ধরে। সে শৈশবে যেমন দুর্বল ছিল তেমনি দুর্বল হয়ে যায়। তার দৃষ্টি ও বিবেকশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে দুর্বলতা চলে আসে। পঞ্চেন্দ্রিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। চলতে- ফিরতে, উঠতে-বসতে সমস্যা হয়। একসময় মৃত্যু চলে আসে। মৃত্যু সৃষ্টিরই এক স্তর। মৃত্যুর পর দ্বিতীয় এক জীবন লাভ হয়। এর মাধ্যমে যেন সৃষ্টির অবশিষ্ট ধাপ পূরণ হয়।

নিজেদের সৃষ্টির এই আশ্চর্য অবস্থা এবং আল্লাহর কুদরতের জীবন্ত নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও মানুষ আল্লাহর আয়াতের ব্যাপারে বিবাদে লিপ্ত হয়। তা অস্বীকার করে। মাটি ও বীর্য থেকে সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টি তারা ভুলে যায়। জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সৃষ্টির প্রতিটি ধাপ যিনি পরিচালনা করেন, তার কথাও বিস্মৃত হয়ে যায়। ইরশাদ হচ্ছে, আপনি কি তাদেরকে দেখেননি, যারা আল্লাহর আয়াত সম্পর্কে বিতর্ক করে, তারা কোথায় ফিরছে? (৬৭-৬৯) সুরার শেষাংশে প্রথমে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ধৈর্যধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরপর মিথ্যাবাদীদের পৃথিবী ভ্রমণ করে ধ্বংসপ্রাপ্ত সম্প্রদায়ের পরিণাম দেখে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এসব সম্প্রদায়ের নিজেদের বস্তুগত শক্তি-সামর্থ্যের উপর অনেক অহংকার ছিল। তারা নবীদের সুস্পষ্ট মুজিজা ও নিদর্শনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল। এরপর যখন তারা আল্লাহর আজাব দেখতে পেয়েছে তখন তারা মূর্তিপূজা থেকে বিমুখ হয়ে একত্বের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এ ঘোষণা তাদের কোনো কাজে আসেনি। কেননা অবাধ্য সম্প্রদায়ের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার রীতি হচ্ছে আজাব চলে আসার পর তিনি ঈমান কবুল করেন না। (৭৭-৮৫)

সুরা হা-মীম সাজদা

এটি মক্কি সুরা। আয়াতসংখ্যা: ৫৪। রুকুসংখ্যা: ৬

এ সুরায় যেহেতু সিজদায়ে তেলাওয়াতের আয়াত রয়েছে, এজন্য একে 'হা-মীম সাজদা'ও বলা হয়।' হরফে মুকাত্তায়াত-হা-মীম দ্বারা সুরাটির সূচনা হয়েছে।

সাত হা-মীম

উল্লেখ্য, পূর্বের সুরা গাফিরসহ সুরা আহকাফ পর্যন্ত মোট সাতটি সুরা হা-মীম দ্বারা শুরু হয়েছে। এগুলোকে 'সাবআ হাওয়ামীম (সাত হা-মীম)' এবং 'আলে হা- মীম' বলা হয়। এ সুরাগুলো যে ক্রমধারায় কোরআন শরিফে রয়েছে সেই ক্রমধারাতেই তা অবতীর্ণ হয়েছে।

হজরত ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এ সুরাকে কোরআনের সৌন্দর্য বলে উল্লেখ করেছেন। হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর বক্তব্য হচ্ছে- প্রত্যেক জিনিসের মগজ থাকে আর কোরআনের মগজ হচ্ছে আলে হা-মীম। সাত সাত হা-মীম নিম্নে উল্লেখ করা হল:

সুরা মুমিন, সুরা হা-মীম-সাজদা, সুরা শুরা, সুরা যুখরুফ, সুরা দুখান, সুরা জাসিয়া ও সুরা আহকাফ।

কোরআনের আলোচনার মাধ্যমে সুরাটির সূচনা হয়েছে। বলা হয়েছে, এ কিতাব সেই মহান সত্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে, যিনি অত্যন্ত দয়ালু ও মেহেরবান। বস্তুত কোরআনের ঘটনাবলি ও উপদেশ, দৃষ্টান্ত ও প্রতিশ্রুতি সবকিছুই সুস্পষ্ট। এই কোরআন নিজস্ব বিধান ও অর্থ, স্বীয় উদ্দেশ্য ও বিষয়বস্তু সবদিক থেকেই দ্ব্যর্থহীন। কোনো অস্পষ্টতা নেই। কিন্তু এত স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও বহুলোক তা থেকে বিমুখ হয়ে রয়েছে। এই দুর্ভাগারা নিজেদেরকে অন্ধ ও বধিরের সাথে তুলনা করেছে। তারা নিজেরাই বলে, আমাদের অন্তরে পর্দা পড়ে গেছে। কানে ছিপি পড়েছে। হে নবী, আমাদের এবং আপনার মাঝখানে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তাই আমরা আপনার দাওয়াত বুঝি না, শুনিও না আর আপনাকে দেখতেও পাই না।

মুশরিকদের হঠকারিতার জবাবে আল্লাহ তায়ালা হুকুম দিয়েছেন, আপনি নিজের পরিচয় ও প্রেরিত হওয়ার উদ্দেশ্য তুলে ধরুন। আপনি বলে দিন, আমি ফেরেশতা বা অন্য কোনো সৃষ্টি নই। আমি তোমাদের মতোই সাধারণ মানুষ। তোমাদের যেমন মানবিক প্রয়োজন রয়েছে, আমারও রয়েছে। তবে আল্লাহ তায়ালা আমাকে ওহী ও রিসালাত প্রদান করেছেন। (২-৬)

আদ সামুদ সম্প্রদায়

এরপর এই সুবায় মুশরিকদের কুফর ও শিরকের ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করা হয়েছে, যারা আল্লাহ তায়ালার বড়ত্ব ও মহত্ত্বের নিদর্শন প্রত্যক্ষ করা সত্ত্বেও তা অস্বীকার করে থাকে। এসব নিদর্শনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার পাশাপাশি আদ ও সামুদ সম্প্রদায় কর্তৃক নবীদের মিথ্যা প্রতিপন্ন করা এবং তাদেরকে অস্বীকার করার পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

আদ সম্প্রদায়কে সীমাহীন শারীরিক শক্তি দেওয়া হয়েছিল। যার কথা ভাবলেও হয়রান হয়ে যেতে হয়। তাদের এতই শক্তি ছিল যে, তাদের এক- একজন ব্যক্তি পাহাড় থেকে পাথর কেটে পৃথক করে ফেলতে পারত। উচিত ছিল- এ শক্তি- সামর্থ্যের কারণে তারা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবে। কিন্তু শুকরিয়া আদায়ের পরিবর্তে তারা অহংকার প্রদর্শন করেছে। গর্ব ভরে চ্যালেঞ্জ করেছে যে, কে আছে আমাদের চেয়ে অধিক শক্তিশালী? (১৫)

তাদের এই বোকামি ও অজ্ঞতার ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করে উত্তর দেওয়া হয়েছে, তোমরা কি সেই মহান সত্তার শক্তি-সামর্থ্যের ব্যাপারে উদাসীন, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন? তোমরা কি সেই বাস্তবতার কথা ভুলে গেছো যে, তোমাদের শক্তি-সামর্থ্য মহান আল্লাহর মাহাত্ম্য ও অসীম ক্ষমতার সামনে কিছুই না? এরপর একসময় তাদের উপর প্রবল বেগে ঠান্ডা বাতাস পাঠানো হয়। লাগাতার সাতদিন এ বাতাস প্রবাহিত হয়। বাতাস তাদেরকে কীট-পতঙ্গ বা শুকনো ঘাস-পাতার মতো উড়িয়ে নিয়ে যায়। (১৬)

সামুদ সম্প্রদায়ও ঈমানের উপর কুফরকে, হেদায়েতের উপর গোমরাহিকে, দেখার পরিবর্তে অন্ধত্বকে প্রাধান্য দিয়েছিল। যখন তারা ভোগ-বিলাসে মত্ত ছিল তখন এক বিকট শব্দ হয়। এতে তাদের কানের পর্দা ফেটে যায়। এরপর ভূমিকম্প শুরু হয়। তাদের সবকিছু উলটে-পালটে ধ্বংস হয়ে যায়। (১৭-১৮)

আদ-সামুদের মতো অবাধ্য সম্প্রদায়ের উপর আসা দুনিয়াবি আজাবের আলোচনার পর আখেরাতের আলোচনা করা হয়েছে। যখন আল্লাহর শত্রুদের তার সামনে একত্র করা হবে তখন তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমনকি শরীরের চামড়া পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। (১৯-২২)

মুমিনের সবচেয়ে বড় গুণ ঈমানের উপর অটল থাকা

অহংকারী ও অস্বীকারকারীদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ সুরায় মুমিন- মুসলিমদেরও পরিচয় দেওয়া হয়েছে, যাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গুণ হচ্ছে ঈমানের উপর দৃঢ় ও অবিচল থাকা। যখন তারা একবার আল্লাহ তায়ালাকে নিজেদের রব বলে স্বীকার করেছে তখন তারা গোটা জীবন এ কথা ও স্বীকৃতির উপর আমল করে থাকে। এই স্থিরতাই হচ্ছে ইসতিকামাত (দীনের উপর দৃঢ় ও অবিচল থাকা)। ইসতিকামাতই বেলায়েত। বরং ইসতিকামাতকে আঁকড়ে ধরাই হলো শ্রেষ্ঠ কারামত।' যারা ইসতিকামাত অবলম্বন করবে তাদের ঠিকানা হবে জান্নাত। সেখানে তাদেরকে বাসস্থান দিয়ে বলা হবে, তোমরা এখানে যেভাবে খুশি জীবনযাপন করো। দুনিয়ায় তোমাদের আল্লাহ-খুশি জীবনযাপন করার এটা হচ্ছে প্রতিদান। (৩০-৩১)

যারা ইসতিকামাত অবলম্বন করে তাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হচ্ছে তারা, যারা ইখলাস ও হেকমতের সাথে আল্লাহর প্রতি আহ্বান করে। তার পথে আসা বিপদ-আপদ খুশিমনে সহ্য করে নেয়। (৩৩-৩৫)

আল্লাহ তায়ালার ইনসাফের আলোচনার মাধ্যমে এ পারার সমাপ্তি টানা হয়েছে। বলা হয়েছে, যারা সৎকাজ করে তারা নিজের কল্যাণেই তা করে থাকে। আর যারা মন্দ কাজ করে, তার মন্দ পরিণাম তাদের ভোগ করতে হবে। আপনার প্রতিপালক বান্দাদের উপর জুলুমকারী নন। (৪৬)

চলবে ইনশাআল্লাহ...

লেখক: আলেম ও ওয়ায়েজ; খতিব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :