ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-২৯

আঙুলের ছাপ আল্লাহ তায়ালার অসীম কুদরতের সাক্ষী

মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী
 | প্রকাশিত : ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ২০:২৩

প্রিয় পাঠক,

পবিত্র মাহে রমজান বিদায়ের পথে। শাওয়ালের চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আজ অথবা কাল রমজানের বিশেষ ইবাদত তারাবিহ শেষ হবে। যদিও তারাবিহতে পবিত্র খতমে কোরআন শেষ হয়ে গেছে আগেই। আমরা জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল ঢাকা টাইমস এর আয়োজনে কোরআনুল কারীমের ধারাবাহিক তাফসিরের ত্রিশ পারা সর্ম্পূণ করব ইনশাআল্লাহ। আজ আমরা ২৯তম পারা থেকে পেশ করছি।

আগের পর্ব: যে কারণে রাসূল সা. কয়েকজন স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার মনস্থির করেছিলেন

সূরা মুলক

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৩০। রুকু সংখ্যা: ২

এ সূরার ফজিলতের ব্যাপারে কয়েকটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে, যার মধ্যে একটি হাদিস আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর সূত্রে ইবনে মাজাহ, নাসায়ি, আবু দাউদ, তিরমিজিতে বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোরআনে ত্রিশটি আয়াত রয়েছে, যা তার পাঠকের জন্য সুপারিশ করবে। এই কারণে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে।

একে منجيةمانعة বলা হয়। অর্থাৎ কবরের আজাব থেকে রক্ষাকারী। এ কারণে অধিকাংশ মাশায়েখ ইশার নামাজের পর তা তেলাওয়াতের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।

সূরা মুলকে মৌলিকভাবে তিনটি বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে।

১. আসমান ও জমিনের প্রকৃত বাদশাহি একমাত্র আল্লাহর। তার হাতে জীবন ও মৃত্যু। ইজ্জত-সম্মান, লাঞ্ছনা-অপদস্থতা, দরিদ্রতা-ধনাঢ্যতা এবং দেওয়া ও না-দেওয়ার ব্যবস্থাপনা আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। তিনি সবকিছু জানেন। সবকিছুর খবর রাখেন। অণু-পরমাণু পর্যন্ত তার জ্ঞানের বাইরে নয়। জমিনে চলাচলের জন্য তিনি রাস্তা বানিয়েছেন। আকাশে উড়ন্ত পাখি তিনি থামিয়ে দেন। সবাইকে তিনিই রিজিক দেন। এ সূরার বিভিন্ন আয়াতে (১, ১৩, ১৪, ১৫, ১৯, ২১) এ বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়েছে।

২. রাব্বুল আলামিনের অস্তিত্ব, তার একত্বের ওপর তাকবিনি (সৃষ্টিরাজি এর মাধ্যমে) দলিল দেওয়া হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, ছাদস্বরূপ এই আকাশ এবং তাতে বিদ্যমান নক্ষত্রপুঞ্জ, বিছানো জমিন এবং তাতে প্রবহমান প্রস্রবণসমূহ এক প্রজ্ঞাবান, সর্বজ্ঞ সত্তার অস্তিত্বের সংবাদ দিচ্ছে। (৩-৫)

৩. মিথ্যাবাদীদের পরিণাম হবে জাহান্নাম, প্রচণ্ড ক্রোধে যা গর্জন করছে, যেন তা ফেটে পড়ছে। (৭-৮)

যখন তারা এই আজাবকে নিকটবর্তী দেখবে তখন তাদের চেহারা বিগড়ে যাবে। তাদেরকে বলা হবে এটাই সেটা, যা তোমরা তলব করতে। (২৭)

সূরা কলম

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৫২। রুকু সংখ্যা: ২

যেহেতু সূরার শুরুতে আল্লাহ তায়ালা কলমের শপথ করেছেন, তাই একে সূরা কলম বলা হয়। এই শপথের মাধ্যমে কলমের শ্রেষ্ঠত্ব এবং তার বড় নেয়ামত হওয়ার কথা বুঝে আসে। হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেছেন। তা সৃষ্টি করার পর তিনি বলেছেন, লিখো। সে তখন জিজ্ঞেস করেছে, কী লিখবো? তিনি বলেছেন তাকদির লিখো। অতঃপর কলম তখন থেকে নিয়ে কেয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে সব লিখে রেখেছে। এরপর আল্লাহ তায়ালা নুন তথা দোয়াত সৃষ্টি করেছেন।

এই কলমের মাধ্যমে আমাদের আকাবির-আসলাফের সকল ইলম আমাদের নিকট এসেছে। এর মাধ্যমে গোটা দুনিয়ায় বিভিন্ন তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে। কোরআন এমন এক অবস্থায় কলম ও কিতাবের গুরুত্ব বর্ণনা করেছে, যে পরিবেশে কলম ও কিতাবের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু যেহেতু কোরআন আল্লাহ তায়ালার সর্বশেষ আসমানি কিতাব, এ কিতাব অবতীর্ণকারী সত্তা জানেন যে, সামনে কলম, জ্ঞানবিজ্ঞান ও গবেষণার যুগ আসবে। এই কারণে তিনি মুসলমানদের কলমের গুরুত্বের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। লক্ষ করলে দেখা যাবে, বর্তমান কম্পিউটার, ইন্টারনেট প্রভৃতি কলমেরই আধুনিক সংস্করণ।

সূরা কলমে মৌলিকভাবে তিনটি বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে।

১. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা এবং তার উন্নত চরিত্রের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। শপথ করে সর্বপ্রথম এটাই বলা হয়েছে, আপনার প্রতিপালকের অনুগ্রহে আপনি পাগল নন, যেমনটা আপনার বিরোধীরা বলে থাকে। আপনার জন্য রয়েছেঅশেষ প্রতিদান। আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী। (৩-৪) মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ি শরিফে এসেছে, হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চরিত্রের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি উত্তর দেন যে, তার চরিত্র হচ্ছে কোরআন। কোরআনে যেসব বিষয় রয়েছে সেগুলোই তার জীবনে বাস্তব হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। তার পবিত্র জীবন কোরআনুল কারিমের এক জীবন্ত তাফসির ছিল। আর এমনটা কেনই- বা হবে না, উন্নত চরিত্রের পূর্ণতা দানের জন্যই তো তাকে পাঠানো হয়েছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উন্নত চরিত্র বর্ণনা করার পাশাপাশি তার বিরোধিতাকারীদের চরিত্রের কলুষতা, নীচুতা এবং তাদের ভ্রষ্ট চিন্তাধারার কথা আলোচনা করা হয়েছে।

বলা হয়েছে, ‘যে অধিক শপথ করে, সে লাঞ্ছিত, আপনি তার আনুগত্য করবেন না। যে পশ্চাতে নিন্দা করে, একের কথা অপরের নিকট লাগিয়ে ফেরে, যে ভালো কাজে বাধা দেয়, সে সীমালঙ্ঘন করে। সে পাপিষ্ঠ। তার স্বভাব কঠোর। তদুপরি সে কুখ্যাত। এ কারণে যে, সে ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততির অধিকারী।’ (১০-১৪)

মুফাসসিরগণ বলেছেন, এই আয়াত কুরাইশ সরদার ওয়ালিদ বিন মুগিরার ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে।

২. এই সূরার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ‘আসহাবুল জান্নাহ’ বা বাগানবাসীদের ঘটনা। আরবদের মধ্যে ঘটনাটি প্রসিদ্ধ ছিল। এটি ইয়ামানের নিকটবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল। বাগানের মালিক এ বাগানে উৎপাদিত ফল- ফলাদি থেকে গরিবদের দান করত। কিন্তু তার মৃত্যুর পর যখন তার সন্তানরা বাগানের উত্তরাধিকারী হয় তখন তারা নিজেদের খরচ এবং অপারগতার বাহানা দেখিয়ে মিসকিনদের বঞ্চিত করার এবং সমস্ত উৎপাদিত ফসল নিজেদের ঘরে নিয়ে যাওয়ার ফন্দি আঁটে। আল্লাহ তায়ালা তখন বাগানটি ধ্বংস করে দেন। (১৭-৩৩)

এ ঘটনায় সেসব লোকের জন্য বড় শিক্ষা ও উপদেশ রয়েছে, যারা নিজেদের ধনসম্পদ ও ধনাঢ্যতা দ্বারা নিজেরাই উপকৃত হতে চায়। কৃপণতার কারণে তাদের সহ্য হয় না যে, তাদের ধনসম্পদ দ্বারা অন্যরা উপকৃত হবে। কাফেরদের শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে শুভ পরিণামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, সৎকর্মশীল ও অপরাধী, অনুগত ও অবাধ্য, বিরুদ্ধাচরণকারী ও নির্দেশ মান্যকারী কীভাবে এক সমান হতে পারে?

৩. সূরা কলমে তৃতীয় পর্যায়ে আখেরাতের বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘গোছা পর্যন্ত পা খোলার দিনের কথা স্মরণ করো, সেদিন তাদেরকে সিজদা করতে আহ্বান জানানো হবে, অতঃপর তারা সক্ষম হবে না।’ (৪২)

দুনিয়াতে তাদেরকে সিজদা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু তারা সিজদা করেনি। আর আখেরাতে তারা সিজদা করতে চাইবে; কিন্তু তাদের থেকে শক্তি ও ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়া হবে।

গোছা খোলার দ্বারা আলেমগণ কেয়ামতের ভয়ানক অবস্থার কথা উদ্দেশ্য নিয়েছেন। মূলত এটি মুতাশাবিহ পর্যায়ের বিষয়, যার প্রকৃত উদ্দেশ্য আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।

সর্বশেষে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুশরিকদের জুলুম- নির্যাতনের মুখে ধৈর্যধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সূরা হাক্কাহ

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৫২। রুকু সংখ্যা: ২

কেয়ামতের বিভিন্ন নামের মধ্যে একটি হচ্ছে ‘হাক্কাহ’। অর্থ, যা অবশ্যই সংঘটিত হবে। যেহেতু কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার প্রতিশ্রুতি এবং হুঁশিয়ারি সংঘটিত হবে এ কারণে একে ‘হাক্কাহ’ বলা হয়। এ সূরার মূল বিষয় রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের সত্যতা বর্ণনা করা। সূরার শুরুতে কেয়ামতের ভয়ঙ্কর অবস্থা এবং আদ ও সামুদ সম্প্রদায়ের পরিণামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। (১-১২)

এরপর এ সূরায় সেসব ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, যা কেয়ামতের পূর্বে সংঘটিত হবে। অর্থাৎ শিঙ্গায় ফুৎকার দেওয়া হবে। পৃথিবী ও পাহাড়-পর্বত খণ্ডবিখণ্ড হয়ে যাবে। আকাশ বিদীর্ণ হবে। ফেরেশতারা অবতীর্ণ হবে। (১৩-১৭)

যখন কেয়ামত সংঘটিত হবে তখন মানুষকে আল্লাহর সামনে উপস্থিত করা হবে। তাদের মধ্য থেকে যারা সৎকর্মশীল হবে, তাদের আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে। আনন্দের আতিশয্যে সে এ আমলনামা অন্যদের দেখাতে থাকবে। আর যারা গুনাহগার হবে, তাদের আমলনামা বাম হাতে দেওয়া হবে। তারা অনুশোচনার সঙ্গে বলবে, ‘যদি আমাকে আমার কিতাব না দেওয়া হতো! আমি যদি না জানতাম যে, আমার হিসাব কী! মৃত্যুতেই যদি আমার সবকিছু শেষ হয়ে যেত! হায়, আমার ধনসম্পদ, প্রভাব-প্রতিপত্তি আমার কোনো কাজে আসেনি!’ (১৮-২৯)

এরপর তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আল্লাহ তায়ালা এ দুর্ভাগাদের কিছু আলামত বর্ণনা করেছেন।

প্রথমত তারা আল্লাহর ওপর ঈমান আনে না, দ্বিতীয়ত তারা মিসকিনদের খাওয়ানোর প্রতি উৎসাহিত করে না। (২৩-৩৪)

নেককার ও বদকারদের পরিণাম উল্লেখ করার পর আল্লাহ তায়ালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও কোরআনের সত্যতার ব্যাপারে শপথ করে বলেছেন, ‘তোমরা যা দেখ, আমি তার শপথ করছি, এবং যা তোমরা দেখ না, তারও, নিশ্চয় এই কোরআন একজন সম্মানিত রাসূলের আনীত, এবং এটি কোনো কবির কালাম নয়; তোমরা কমই বিশ্বাস করো। এটা কোনো অতীন্দ্রিয়বাদীর কথা নয়; তোমরা কমই অনুধাবন করো। এটা বিশ্বপালনকর্তার কাছ থেকে অবতীর্ণ।’ (৩৮-৪৩)

সূরা মাআরিজ

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৪৪। রুকু সংখ্যা: ২

সূরার শুরুতে বলা হয়েছে, ‘মক্কার কাফেররা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার দাওয়াত নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। তারা বলে, যে আজাব আসার কথা, তা যেন অতি দ্রুত চলে আসে, যেন দুনিয়াতেই আমাদের থেকে প্রতিশোধ নিয়ে নেওয়া হয়।’ (১-৩)

এরপর এ সূরায় কেয়ামতের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে অপরাধীদের যে অবস্থা হবে তা বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘সেদিন আকাশ তেলের গাদের মতো হবে। পাহাড় হবে রঙ্গিন তুলার মতো। কোনো বন্ধু অন্য বন্ধুর, কোনো আত্মীয় অন্য আত্মীয়ের খবর নেবে না; বরং সবাই একে অপর থেকে জান বাঁচিয়ে পালাবে।’ (৮-১৪)

এই সূরায় মানুষের স্বভাব ও তবিয়ত সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা অত্যন্ত লোভী ও ভীরু। কোনো বিপদে আক্রান্ত হলে হা-হুতাশ শুরু করে দেয়। নেয়ামত অর্জিত হলে কৃপণতা করে। তবে যারা প্রকৃত নামাজি তারা এমন নয়। আল্লাহ তায়ালা নামাজিদের আটটি গুণ বর্ণনা করেছেন।

১. তারা নামাজের প্রতি যত্নবান।

২. যারা মানুষের নিকট চায় অথবা মুখ ফুটে চায় না, এমন সকলকেই তারা প্রদান করে। অর্থাৎ নামাজের মাধ্যমে তারা আল্লাহর হক আদায় করে আর জাকাতের মাধ্যমে বান্দার হক আদায় করে।

৩. তারা হিসাব-নিকাশ ও শেষদিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে। তাদের বিশ্বাসে কোনো ধরনের সন্দেহ নেই।

৪. ইবাদত করা সত্ত্বেও তারা আল্লাহ তায়ালার আজাবকে ভয় করে।

৫. তারা ব্যভিচার প্রভৃতি অশ্লীল কাজ থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে। নিজের হালাল স্ত্রী বা বাঁদি নিয়ে তুষ্ট থাকে। হারামের প্রতি দৃষ্টিপাত করে না।

৬. তারা আমানত রক্ষা করে। অঙ্গীকার করে তা কখনো ভঙ্গ করে না। কখনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না।

৭. তারা ন্যায়ানুগ সাক্ষ্যপ্রদান করে।

অষ্টম গুণ হচ্ছে তারা যথাসময়ে নামাজ আদায় করে। নামাজের আদব ও ওয়াজিবসমূহের প্রতি লক্ষ রাখে। (২২-৩৪)

যেসব লোকের মধ্যে এসব গুণ পাওয়া যায়, তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তারাই জান্নাতে সম্মানিত হবে। (৩৫)

সূরার শেষে আল্লাহ তায়ালা শপথ করেছেন যে, পুনরুত্থান সত্য। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়ে তাদের স্থলে অধিক ইবাদতকারী লোকদের সৃষ্টি করতে সক্ষম। (৪০-৪১)

প্রতিযুগেই আল্লাহ তায়ালার এ কুদরত প্রকাশ পেয়েছে। যখন কোনো সম্প্রদায় ধর্মের ব্যাপারে গাফলতি করেছে আল্লাহ তায়ালা তখন তাদের চেয়ে উত্তম এবং দীনের সহযোগিতাকারী লোক তৈরি করেছেন। আজও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বিভিন্ন সম্প্রদায়, দেশ এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষজন ইসলাম কবুল করছে। এই নওমুসলিমরা জন্মগত মুসলিমদের চেয়ে বহুগুণে উত্তম হয়ে থাকে। আমাদের প্রত্যেকের এ বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত। আমরা এই দীনের মুখাপেক্ষী, আল্লাহর দীন আমাদের মুখাপেক্ষী নয়।

সূরা নুহ

এটি মাক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ২৮। রুকু সংখ্যা: ২

এই সূরায় শুধু হযরত নুহ আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। তাকে শাইখুল আমবিয়াও বলা হয়। কেননা তার বয়স সকল নবীর চেয়ে দীর্ঘ ছিল। হযরত আদম আলাইহিস সালামের পর দুনিয়াবাসীর নিকট তিনি সর্বপ্রথম রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। আল্লাহ তায়ালার ইবাদত এবং তার আনুগত্যের দাওয়াত দিয়েছেন। দাওয়াতের ক্ষেত্রে তিনি প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছেন। রাতে দাওয়াত দিয়েছেন। দিনে দাওয়াত দিয়েছেন। প্রকাশ্যে-গোপনে সবভাবেই তিনি তাদেরকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু তিনি তাদেরকে যতই দাওয়াত দিতেন তারা ততই দূরে সরে যেত। (১-৬)

হজরত নুহ আলাইহিস সালাম তার সম্প্রদায়কে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনার জন্য বারবার বলতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘যদি তোমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং গুনাহ থেকে বিরত থাকো, তা হলে আল্লাহ তোমাদের ওপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি বাড়িয়ে দেবেন। তোমাদেরকে বাগবাগিচা দেওয়া হবে। তোমাদের জন্য অনেক নহর জারি করে দেওয়া হবে।’ এরপর তিনি তাদেরকে আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দেন যে, তিনি সাত আকাশ সৃষ্টি করেছেন। চন্দ্রকে আলো দানকারী বানিয়েছেন। সূর্যকে উজ্জ্বল বাতি বানিয়েছেন। কিন্তু তার এসব দাওয়াত কোনো ফায়দা বয়ে আনেনি। তারা তাদের মূর্তিপূজা থেকে বিরত থাকেনি। তিনি তখন আল্লাহর নিকট তাদের ধ্বংসের দোয়া করেন, যাতে তিনি বলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক, আপনি পৃথিবীতে একটা কাফেরকেও বাকি রাখবেন না।’ তার এ দোয়া কবুল করা হয়। প্লাবনের মাধ্যমে পাপাচারী কাফেরদের ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

সূরা জিন

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ২৮। রুকু সংখ্যা: ২

এ সূরায় জিনদের অবস্থাদি আলোচনা করা হয়েছে। জিনরা মানুষের মতোই বিভিন্ন বিধান পালনের জন্য নির্দেশপ্রাপ্ত। তাদের মধ্যে মুমিন-কাফের, সৎকর্মশীল ও অসৎকর্মশীল সবই আছে। এতে বলা হয়েছে, জিনদের একদল কোরআন শুনেছে এবং তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।

এটা সে সময়ের কথা, (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়াতপ্রাপ্তির পর) জিনরা যখন বিশ্বজগতের ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন পরিলক্ষ করে। এক সময় তারা আসমান পর্যন্ত যেতে পারত, কোনো বাধা দেওয়া হতো না। কিন্তু এখন আসমানে যাওয়ার চেষ্টা করলে উল্কাপিণ্ড দ্বারা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করা হয়।

জিনরা এ পরিবর্তনের কারণ জানার জন্য কৌতূহলী হয়ে ওঠে। এর রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য তাদের এক দল সারা পৃথিবী পরিভ্রমণে বের হয়। ঠিক এমন সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু সাহাবির সঙ্গে তায়েফের পথে উকাজ বাজারে যান। নাখলা নামক স্থানে তিনি ফজর নামাজ আদায় করলেন। তখন জিনদের সেই দলটি এ পথ দিয়ে যাচ্ছিল। যখন তারা কোরআন শুনতে পায় তখন তারা বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তনের রহস্য উদঘাটন করতে পারে। তাদের অন্তর বিগলিত হয়ে যায়। তারা কোরআনের সত্যতার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে দেয়। (১-২)

তারা কেবল নিজেরাই ঈমান আনেনি; বরং ফিরে গিয়ে নিজ সম্প্রদায়কেও ঈমানের দাওয়াত দিয়েছে। তাদের সামনে আল্লাহ তায়ালার কথা বর্ণনা করেছে। যারা আল্লাহর সন্তান আছে বলে বিশ্বাস করে তাদেরকে তারা বোকা আখ্যা দিয়েছে। তারা এ কথাও স্বীকার করেছে যে, আমরা সবাই একই আকিদা-বিশ্বাস লালন করি না। আমাদের কেউ মুমিন আবার কেউ কাফের। কেউ অনুগত, কেউ অবাধ্য। কেউ জান্নাতি, কেউ জাহান্নামি। (১৪-১৭)

জিনদের কথা আলোচনা করতে গিয়ে এ সূরায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনি আল্লাহ তায়ালার হুকুম মোতাবেক মানুষকে ঈমান ও তাওহিদের দাওয়াত দিয়েছেন। তিনি নিজের ব্যাপারে বলেছেন যে, ‘আমি শুধু আল্লাহ তায়ালাকে ডাকি। তার সাথে কাউকে শরিক করি না। ক্ষতি ও উপকার কোনোকিছুই আমার হাতে নেই। আমার কাজ হচ্ছে শুধু আল্লাহ তায়ালার পয়গাম তোমাদের নিকট পৌঁছে দেওয়া। আল্লাহ তায়ালা জানেন, আমি এ পয়গাম তার বান্দাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছি।’ (২০-৩২)

সূরা মুযযাম্মিল

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ২০। রুকু সংখ্যা: ২

এ সূরায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আল্লাহ-নিবিষ্টতা, তার ইবাদত, আনুগত্য, কিয়াম, তেলাওয়াত, জিহাদ, মুজাহাদা সবকিছু বর্ণিত হয়েছে। এমনকি এ সুরার নামই একথার ইঙ্গিত করে যে, এতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

মুযযাম্মিল অর্থ বস্ত্রাবৃত। (হেরা গুহায় সর্বপ্রথম ওহী ও নবুওয়াতপ্রাপ্তির পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এ গুরুদায়িত্ব বেশ ভারী মনে হল। তার কাছে শীত অনুভূত হচ্ছিল। তিনি হযরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে গিয়ে বললেন, ‘আমাকে চাদর জড়িয়ে দাও।’ এ পরিস্থিতিকে চিত্রায়ণ করার জন্য) আল্লাহ তায়ালা মহব্বত-ভালোবাসা ও প্রীতিমিশ্রিত শব্দে সম্বোধন করে বলেন, হে বস্ত্রাবৃত!! তিনি দিনের বেলা দাওয়াত দিতেন, রাতের বেলা দীর্ঘক্ষণ নামাজ পড়তেন। নামাজে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। কোনো কোনো সময় পুরো রাত দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তেন। ফলে তার পা ফুলে যেত। আল্লাহ তায়ালা নবীকে ইচ্ছাধিকার দেন। বলেন, ‘আপনি ইচ্ছা করলে অর্ধরাত নামাজ পড়তে পারেন বা অর্ধেকের চেয়ে কম বা কিছু বেশি।’ (১-৪)

রাতের কিয়াম (নফল নামাজ আদায়) রুহানি তরবিয়তের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে থাকে। এজন্য কিয়ামুল লাইলের হুকুম দেওয়ার পর বলা হয়েছে, ‘অচিরেই আমি আপনার উপর অত্যন্ত ভারী বিষয় অবতীর্ণ করব।’ (৫)

ভারী বিষয় দ্বারা কোরআনুল কারিম উদ্দেশ্য, যার এক বিশেষ গাম্ভীর্য ও মহত্ত্ব রয়েছে। যে-ব্যক্তির অন্তর প্রজ্ঞা ও হেদায়েতের নূরে আলোকিত সে-ই শুধু তা বহন করতে পারে। উল্লেখ্য, বাতেন তথা অন্তরজগত আলোকোজ্জ্বল হওয়ার ক্ষেত্রে কিয়ামুল লাইলের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সামনের আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মুশরিকদের জুলুম-নির্যাতনের ওপর ধৈর্যধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়। যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কষ্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে জবান ও হাত সবই চালাত। (৩-১০)

এরপর এ সূরায় মিথ্যাপ্রতিপন্নকারীদের ভীতিপ্রদর্শনের জন্য ফেরাউনের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা যাকে তার অবাধ্যতার কারণে মর্মন্তদ শাস্তি দিয়েছিলেন।

সূরার শেষে আল্লাহ তায়ালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুমিনদের ওপর সহজীকরণের ঘোষণা দেন। প্রথম সহজতা হচ্ছে অর্ধরাত বা রাতের এক-তৃতীয়াংশ কিংবা দুই-তৃতীয়াংশ নামাজ পড়া আবশ্যক নয়; বরং যতটুকু সহজ হয় ততটুকু সময় কিয়ামুল লাইল করলেই চলবে। দ্বিতীয় সহজতা হচ্ছে এখন মুমিনদের ওপর তাহাজ্জুদ পড়া ফরজ নয়; বরং মুস্তাহাব। (২০)

সূরা মুদ্দাসসির

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৫৬। রুকু সংখ্যা: ২

সূরার শুরুতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর প্রতি দাওয়াত দেওয়া, কাফেরদের ভীতিপ্রদর্শন এবং তাদের জুলুম-নির্যাতনের উপর ধৈর্যধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়। (১-৭)

এরপর অপরাধী ও বিরুদ্ধাচারণকারীদের মর্মন্তুদ দিনের আজাব সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। (১-৮)

পরের আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জঘন্য দুশমন- ওয়ালিদ বিন মুগিরার আলোচনা করা হয়েছে। সে কোরআন শুনত এবং জানত যে, এটি আল্লাহর কালাম। কিন্তু হঠকারিতাবশত তা অস্বীকার করত এবং নাউজুবিল্লাহ একে জাদু বলে আখ্যায়িত করত। (২৬-২৭)

এরপর সূরাটিতে জাহান্নাম এবং তার দারোগা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, কাফের ও পাপাচারীদের যার মুখোমুখি হতে হবে। এসব দারোগার মনে তাদের প্রতি কোনো নম্রতা থাকবে না। (২৭-৩১)

বিষয়টি জোরালো করার জন্য আল্লাহ তায়ালা চাঁদ, রাত ও সকালের শপথ করেছেন। জাহান্নাম এক বড় মুসিবত। (৩২-৩৭)

সূরাটি প্রত্যেকের দায়িত্ব ও জিম্মাদারির বিষয়টি স্পষ্ট করে যে, প্রত্যেককে তার আমলের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হবে এবং প্রত্যেকেই নিজ গুনাহের কারণে বন্দি হবে। তবে যাদের আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে, তারা বেঁচে যাবে। তারা কেয়ামতের দিন জাহান্নামিদের প্রশ্ন করবে, কোন জিনিস তোমাদেরকে দোজখে নিক্ষেপ করেছে? তারা এর উত্তরে চারটি বিষয়ের কথা বলবে।

১. আমরা নামাজি ছিলাম না।

২. আমরা মিসকিনদের খাবার খাওয়াতাম না।

৩. আমরা সমালোচকদের সাথে সমালোচনা করতাম। পথভ্রষ্টদের সাহায্য করতাম।

৪. আমরা কেয়ামত দিবসকে অস্বীকার করতাম। (৩৮-৪৮)

সূরার শেষে বলা হয়েছে, এই কোরআন এক নসিহত। যে চায় সে তা অর্জন করতে পারে। কিন্তু এজন্য আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা থাকাও আবশ্যক। (৫৪-৫৬)

সূরা কিয়ামাহ

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৪০। রুকু সংখ্যা: ২

নাম দ্বারাই বোঝা যায় যে, সূরার বিষয় হল পুনরুত্থান, যা ঈমানের এক গুরুত্বপূর্ণ রোকন। এ সূরায় কেয়ামতের বিপদ-মুসিবত এবং আজাবের কথা আলোচনা করা হয়েছে। মৃত্যুর সময় মানুষের যে অবস্থা হবে, তারও চিত্রায়ণ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা হাশর কায়েম হওয়ার ব্যাপারে ‘নফসে লাওয়ামা’ তথা ‘তিরস্কারকারী নফস’-এর (যে নফস মানুষকে গুনাহের কারণে নিন্দা করে থাকে, এবং ভালো কাজের উৎসাহ দিয়ে থাকে) শপথ করেছেন।

আখেরাতে তো প্রত্যেক ব্যক্তির নফস তাকে নিন্দা করবে। কিন্তু যাদের অন্তর জাগ্রত, তাদের নফস দুনিয়াতেই তাদেরকে নিন্দা জানাতে থাকে। একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে, এখানে আল্লাহ তায়ালা বিশেষভাবে এটা উল্লেখ করেছেন যে, মৃত্যুর পর আমি মানুষকে পুনরায় তার আগের অবয়বে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম; বরং এটা তো সামান্য ব্যাপার, প্রত্যেক মানুষের আঙুলের অগ্রভাগকেও আগে যেমন ছিল, ঠিক তেমনই সৃষ্টি করতে সক্ষম।

আঙুলের ছাপ আল্লাহ তায়ালার অসীম কুদরতের সাক্ষী

আঙুলের অগ্রভাগের কথা বলা হচ্ছে, কারণ তা আল্লাহ তায়ালার অসীম কুদরতের সাক্ষী। এই ছোট্ট এক জায়গায় যেসব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম রেখা ও দাগ রয়েছে, সেটিও প্রত্যেকেরটা ভিন্ন ভিন্ন। গোটা দুনিয়ার কোটি কোটি মানুষের আঙুলের অগ্রভাগ একজনেরটা অন্য কারও সাথে মিলে না। এজন্য সারা দুনিয়াতেই মানুষের পরিচয় সনাক্ত করার জন্য আঙুলের ছাপের ওপর নির্ভর করা হয়।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, দুনিয়াতে মানুষের আঙুলের অগ্রভাগ যে অবয়বে ছিল, আমি তা পুনরায় সে অবয়বে নিয়ে আসব। এ বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য আল্লাহ তায়ালা কথাটা এভাবে বলেননি যে, ‘আমি পুনরায় সৃষ্টি করব; বরং এভাবে বলেছেন যে, আমি তা পুনর্বিন্যস্ত করে একত্র করব।’ জানা নেই এভাবে বলাতে কত রহস্য নিহিত রয়েছে। কোরআনে এ ধরনের বহু রহস্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, যার প্রত্যেকটি বিষয়ই প্রমাণ করে যে, এই কোরআন উম্মি নবীর বানানো নয়; বরং তা রাব্বুল আলামিনের কালাম। কিন্তু বহু মানুষ এ বাস্তবতা স্বীকার করা সত্ত্বেও এর সত্যতার ওপর ঈমান আনে না।

এরপর এই সূরায় কেয়ামতের ভয়ংকর অবস্থা এবং আলামতের কথা আলোচনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘যখন চক্ষু ঝলসে যাবে, চাঁদ আলোহীন হয়ে যাবে, চাঁদ এবং সূর্যকে একত্র করা হবে, সেদিন মানুষ বলবে, আজ পলায়নের জায়গা কোথায় ‘ (১০)

সামনের আয়াতে বলা হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোরআন মুখস্থ করার প্রতি যত্নবান ছিলেন। জিবরাঈল তেলাওয়াত করার সময় তিনি এ বিষয়ে অত্যন্ত চেষ্টা করতেন, যেন তার থেকে কোনো অংশ ছুটে না যায়। এজন্য তিনি জিবরাঈল আলাইহিস সালামের অনুসরণে দ্রুত পড়ে মুখস্থ করার চেষ্টা করতেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আপনি নিজেকে কষ্টে ফেলবেন না। আমার ওয়াদা হচ্ছে কোরআনের কোনো অংশ বিনষ্ট হবে না। তাকে জমা করা, সংরক্ষণ করা, বাঁচিয়ে রাখা এবং ব্যাখ্যা করার আমি জিম্মাদার।’ (১৬-১৯)

এই সূরায় বলা হয়েছে, ‘আখেরাতে মানুষের দুটি দল হবে। একদিকে থাকবে সৌভাগ্যবানরা, অন্যদিকে থাকবে হতভাগারা। সৌভাগ্যবানদের চেহারা আলোকিত থাকবে। তারা আল্লাহ তায়ালার জিয়ারতের সৌভাগ্যলাভ করবে। হতভাগাদের চেহারা কালো হবে। তারা জানতে পারবে যে আজ আমাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (২০-২৫)

এ ছাড়াও এতে মৃত্যুর সময় মানুষের যে অবস্থা হয়, মানুষ যেসব কষ্টের সম্মুখীন হয়ে থাকে তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। (২৬-৩০)

সূরার শেষে বলা হয়েছে, মানুষকে আমি বেকার (অনর্থক) সৃষ্টি করিনি। এমনটা হতে পারে না যে, না তার হিসাব হবে, আর না কোনো ধরনের প্রতিদান বা শাস্তি দেওয়া হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সবশেষে হাশর ও পুনরুত্থানের এক চাক্ষুষ দলিল দেওয়া হয়েছে। তা হচ্ছে, যে মহান সত্তা মানুষকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন, তিনি তাকে পুনরায় সৃষ্টি করতে সক্ষম। আল্লাহ তায়ালার জন্য সূচনা ও পুনরায় সৃষ্টি করা দুটোই সমান। কিন্তু এখানে মানুষের ধারণা অনুযায়ী আলোচনা করা হয়েছে। কেননা মানুষের ধারণা এবং অভিজ্ঞতা হচ্ছে, পুনরায় সৃষ্টি করাটা নতুনভাবে শুরুর চেয়ে অনেক সহজ।

সূরা দাহার

এটি মাদানি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৩১। রুকু সংখ্যা: ২

সূরাটি মাদানি হওয়া সত্ত্বেও এর বিষয় মক্কি সূরার মতোই। সুরাটিতে জান্নাত ও জান্নাতের নেয়ামতরাজি, জাহান্নাম এবং তার আজাবের বিবরণ আলোচনা করা হয়েছে। সহিহ মুসলিমের এক হাদিস দ্বারা জানা যায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার দিন ফজর নামাজে এই সূরা তেলাওয়াত করতেন।

সূরার শুরুতে আল্লাহ তায়ালার অসীম কুদরতের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে; তিনি কীভাবে মানুষকে বিভিন্ন ধাপে সৃষ্টি করেছেন, তাকে শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি, জ্ঞান ও বুঝ দিয়েছেন, যেন সে তার উপর অর্পিত আনুগত্য ও ইবাদতের সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে পারে, সে যেন পৃথিবীকে এক আল্লাহর ইবাদতের জন্য আবাদ করতে পারে। তথাপি মানুষ দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেছে। কিছুলোক কৃতজ্ঞতা আদায় করেছে, আর কিছু লোক অকৃতজ্ঞ হয়ে গেছে। কাফেরদের জন্য আল্লাহ তায়ালা আখেরাতে শিকল, গলার বেড়ী এবং স্ফুলিঙ্গবিশিষ্ট আগুন প্রস্তুত রেখেছেন। আর শোকরগুজারদের জন্য তিনি কাফুর মিশ্রিত পানপাত্র প্রস্তুত রেখেছেন।

এখানে শোকরগুজারদের তিনটি নিদর্শন উল্লেখ করা হয়েছে।

১. তারা কোনো মানত করলে তা পূরণ করে।

২. তারা কেয়ামত দিবসকে ভয় করে।

৩. তারা শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এতিম, মিসকিন ও কয়েদিদের খাবার খাওয়ায়। তাদের নেক আমল ও সবরের ফল হিসেবে তাদেরকে জান্নাত দেওয়া হবে, যেখানে কোনো ধরনের গরম-ঠান্ডা, দুঃখ-কষ্ট থাকবে না। (১-১৩)

সূরার শেষে আল্লাহ তায়ালা এক মহান নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন, যার কোনো অনুরূপ বা দৃষ্টান্ত হতে পারে না। তিনি বলেছেন, ‘আমি আপনার প্রতি পর্যায়ক্রমে কোরআন নাজিল করেছি। অতএব আপনি আপনার পালনকর্তার আদেশের জন্য ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করুন এবং ওদের মধ্যকার কোনো পাপিষ্ঠ কাফেরের আনুগত্য করবেন না। আর সকাল-সন্ধ্যায় আপন পালনকর্তার নাম স্মরণ করুন। রাত্রির কিছু অংশে তার উদ্দেশে সিজদা করুন এবং রাত্রির দীর্ঘ সময় তার পবিত্রতা বর্ণনা করুন।’ (২৩-২৬)

এসব আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে দায়ীর জন্য জিকির, ইবাদত এবং ধৈর্য ধারণ করা আবশ্যক, যেন আল্লাহর দুশমনদের মোকাবেলায় তার আত্মিক শক্তি হাসিল হয়। বিশেষত রাতের নামাজ ঈমানি মজবুতি এবং রুহানি উৎকর্ষের অন্যতম মাধ্যম। এই সূরার শেষআয়াতে মুশরিকদের সতর্ক করে বলা হয়েছে, আমি ইচ্ছা করলে তাদেরকে ধ্বংস করে দিয়ে তাদের পরিবর্তে তাদের অনুরূপ লোক নিয়ে আসতে পারি।

সূরা মুরসালাত

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৫০। রুকু সংখ্যা: ২

সূরার শুরুতে পাঁচবার প্রবাহিত বায়ু ও ফেরেশতাদের শপথ করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের সঙ্গে যে বিষয়ের ওয়াদা করা হয়েছে, তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।’ অর্থাৎ কেয়ামত, হিসাব-নিকাশ, প্রতিদান ও শাস্তি। এতে কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। এরপর কেয়ামতের পূর্বে সংঘটিত বিভিন্ন নিদর্শনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ‘অর্থাৎ চাঁদ আলোকহীন হয়ে যাবে। আকাশ ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। পাহাড় টুকরো টুকরো হয়ে উড়তে থাকবে। রাসুলদের নির্দিষ্ট সময়ে একত্র করা হবে।’ (৮-১১)

কেয়ামত দিবসকে আল্লাহ তায়ালা يوم الفصل বলেছেন। কেননা এই দিন সৃষ্টিজীবের মধ্যে ইনসাফপূর্ণ ফয়সালা করা হবে। কেয়ামত দিবসকে يوم الفصل বলে উল্লেখ করার পর একে মিথ্যাপ্রতিপন্নকারীদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ويل يومئذ للمكذبين এ দিনকে মিথ্যাপ্রতিপন্নকারীদের ধ্বংস হোক। এই আয়াতটি এ সূরায় দশবার উল্লেখ হয়েছে। বারবার উল্লেখের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভীতিপ্রদর্শন করা।

এছাড়াও এ সূরায় পূর্ববর্তী অপরাধী-যাদেরকে আল্লাহ তায়ালা ধ্বংস করে দিয়েছেন, তাদের আলোচনা এসেছে। মানুষকে প্রশ্ন করা হয়েছে, আমি কি তোমাদেরকে নিকৃষ্ট পানি থেকে সৃষ্টি করিনি? এরপর বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে সুন্দর অবয়ববিশিষ্ট মানুষ বানাইনি? পুনরুত্থান সংক্রান্ত কিছু চাক্ষুষ দলিল উল্লেখ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে প্রমাণ করা হয়েছে, যে মহান সত্তা জমিনকে জীবিত ও মৃতদের ধারণকারী বানাতে পারেন, মিঠা পানির ঝরনা প্রবাহিত করতে পারেন তিনি দ্বিতীয়বারও মানুষকে জীবিত করতে পারেন।

সামনের আয়াতে মিথ্যাপ্রতিপন্নকারী ও মুত্তাকিদের ভিন্ন ভিন্ন পরিণামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মিথ্যাপ্রতিপন্নকারীদের উত্তপ্ত আগুনের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে আর মুত্তাকিদের শীতল ছায়া এবং প্রবহমান ঝরণার পাশে স্থান দেওয়া হবে। শেষ আয়াতে অপরাধীদের পুনরায় সতর্ক করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তোমরা পানাহার করে নাও। আনন্দ-ফুর্তি করে নাও। পরিশেষে তোমাদের জন্য ধ্বংস অপেক্ষা করছে।

চলবে ইনশাআল্লাহ....

(ঢাকাটাইমস/০৮এপ্রিল/এসআইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :