ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-২৮

যে কারণে রাসূল সা. কয়েকজন স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার মনস্থির করেছিলেন

মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী
 | প্রকাশিত : ০৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৮:৩৮

প্রিয় পাঠক,

জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল ঢাকা টাইমস এর আয়োজনে রমজানের বিশেষ প্রোগ্রাম ধারাবাহিক তাফসির আজ ২৮ তম পারা থেকে পেশ করছি। ২৮ তম পারা শুরু হয়েছে সূরা মুজাদালা দিয়ে।

এটি মাদানি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ২২। রুকূ সংখ্যা: ৩

আগের পর্ব: কোরআনের বিস্ময়কর প্রভাব ও নেয়ামতরাজির বর্ণনা

অন্যান্য মাদানি সূরার মতো এতেও শরিয়তের বিধান ও মুনাফিকদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সূরার শুরুতে হজরত খাওলা বিনতে সালাবা রাদিয়াল্লাহু আনহার ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, যিনি আপন স্বামী হযরত আওস বিন সামিত রাদিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারে অভিযোগ নিয়ে আসেন। তিনি তার সঙ্গে জিহার করেছিলেন। তার অভিযোগ দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি ঝগড়া করছেন। এ কারণে তাকে মুজাদিলা (ঝগড়াটে নারী) বলা হয়েছে। আর এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সূরার নাম দেওয়া হয়েছে মুজাদালা।

জাহেলিযুগে জিহারের মাধ্যমে স্ত্রী তালাকপ্রাপ্ত হয়ে যেত, এবং মনে করা হতো, এর ফলে স্ত্রী চিরকালের জন্য হারাম হয়ে যায়। কোরআন এ হারামের সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কোরআনের ভাষ্যমতে কাফফারা দেওয়ার পর স্ত্রী হালাল হয়ে যাবে। (১-৪)

সূরা মুজাদালার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিম্নে তুলে ধরা হল:

১. এ সূরায় চুপিসারে কথা বলার বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ যদি দুই বা ততধিক ব্যক্তি অন্যদের সামনে পরস্পর চুপিসারে কথা বলে তা হলে তার কী হুকুম? যদি কোনো মজলিসে তিন ব্যক্তি থাকে তা হলে দুজনের চুপিসারে কথা বলা মজলিসের আদব-পরিপন্থি। কেননা এমন করার কারণে তৃতীয় ব্যক্তির মনে সন্দেহ হতে পারে যে, সম্ভবত তারা আমার ব্যাপারে কোনো দুরভিসন্ধি আঁটছে।

তবে আয়াতে চুপিসারে কথা বলার ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা এসেছে, তা ইহুদিদের অভ্যাস ছিল। তারা শুধু শুধু মুসলমানদের পেরেশান করার জন্য পরস্পর কানাঘুষা করত। কোনো মুসলমানকে দেখলে পরস্পর কানাকানি করত ও ইশারা দিত। এতে মুসলমানরা তাদের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র হচ্ছে মনে করে কষ্ট পেত। কিছু মুনাফিকও এ শয়তানি কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল।

তেমনিভাবে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সালাম দিতে গিয়ে মুখ ভেংচিয়ে বলত السام عليكم يا أبا القاسم হে কাসেমের পিতা, আপনার ওপর বিপদ আপতিত হোক! এসব আয়াতে তাদের বিভিন্ন আচরণের নিন্দা করা হয়। তবে নেক ও তাকওয়া সম্বন্ধে চুপিসারে আলাপ-আলোচনার অনুমতি দেওয়া হয়।

২. সামাজিক শিষ্টাচারের মধ্যে মজলিসের আদব বর্ণনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘যখন তোমাদেরকে মজলিসে প্রশস্ততা তৈরির জন্য বলা হবে তখন তোমরা মজলিস প্রশস্ত করে দেবে। আর যদি তোমাদেরকে মজলিস থেকে উঠে যেতে বলা হয় তা হলে তোমরা উঠে যাবে।’ (১১)

এ বিধান শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মজলিসের সাথে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা প্রত্যেক গাম্ভীর্যপূর্ণ দীনি মজলিসের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে এটি কোনো ফরজ বা ওয়াজিব পর্যায়ের বিধান নয়; বরং এটি এক মুসতাহাব বিধান। যে ব্যক্তি মসজিদে বা মজলিসে প্রথমে বসবে সেই সেখানে বসার অধিক হকদার। তবে তার জন্য উচিত হচ্ছে, সম্ভব হলে পরে আসা মুসলিম ভাইয়ের জন্য জায়গা প্রশস্ত করে দেওয়া।

৩. এই সূরায় সেসব মুনাফিকের আলোচনা করা হয়েছে, যারা ইহুদিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখার পাশাপাশি নিজেদের মুমিন হওয়ার ব্যাপারে শপথ করত। তাদের বড় বড় দাবি সত্ত্বেও আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে ‘হিজবুশ শাইতান’ (শয়তানের দল) বলে উল্লেখ করেছেন।

যারা কখনো আল্লাহ এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুশমনদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখে না, যদিও তারা তাদের পিতা, সন্তান বা ভাইবোনই হোক না কেন, তাদের জন্য আল্লাহপাক চারটি নেয়ামতের ঘোষণা দিয়েছেন। প্রথমত আল্লাহ তায়ালা তাদের অন্তরে ঈমান মজবুত করে দেন। দ্বিতীয়ত তাদেরকে গায়েবিভাবে সাহায্য করা হবে।

তৃতীয়ত তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। চতুর্থত আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর নেয়ামত এবং তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে গেছে। (১৪-২২)

সূরা হাশর

এটি মাদানি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ২৪। রুকু সংখ্যা: ৩

এ সূরার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিম্নে উল্লেখ করা হল:

১. শুরুতে বলা হয়েছে, বিশ্বজগতের সবকিছু আল্লাহ তায়ালার তাসবিহ পাঠ করছে। তার পবিত্রতা ও হামদ-সানা বর্ণনা করছে। তার একত্ব ও অসীম কুদরতের সাক্ষ্য দিচ্ছে।

২. এরপর এ সূরায় আল্লাহ তায়ালার অসীম কুদরতের কিছু জীবন্ত দলিল উল্লেখ করা হয়েছে। যার মধ্যে ইহুদিদের বিষয়টিও এসেছে, যারা দীর্ঘকাল যাবৎ মদিনায় নিবাস গেড়ে ছিল। নিজেদের সুরক্ষার জন্য তারা বিরাট শক্তিশালী দুর্গ নির্মাণ করে রেখেছিল। জীবন-জীবিকার সকল উপকরণ তাদের আয়ত্তে ছিল। মদিনাবাসীদের তারা সুদি ঋণের শিকলে বন্দি করে রেখেছিল।

তাদের ধারণা ছিল, কেউ-ই আমাদেরকে এখান থেকে বের করতে পারবে না। কিন্তু তাদের কৃতকর্মের কারণে তাদের উপর আল্লাহ তায়ালার আজাব নেমে আসে। তাদেরকে মদিনা থেকে বিতাড়িত করা হয়। তাদের কেউ শামে, আর কেউ খাইবারে আশ্রয় নেয়। এরপর পুনরায় তাদেরকে হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু খাইবার থেকে শামে নির্বাসিত করতে বাধ্য হন।

ইহুদিদের মদিনা ও খাইবার থেকে বের হয়ে যাওয়া এমন এক ঘটনা ছিল, এটা ইহুদিরা তো বটেই; এমনকি মুসলমানরাও কল্পনা করেনি। তাদের উন্নত জীবনাচার, মজবুত প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা এবং ঐক্যবদ্ধতার কারণে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে, তাদেরকে এক সময় লাঞ্ছিত অপমানিত হয়ে মদিনা ও খাইবার থেকে বের হয়ে যেতে হবে।

কিন্তু আল্লাহ তায়ালা যখন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা, মিথ্যা প্রতিপন্ন করা, অস্বীকৃতি, অহংকার ও অবাধ্যতার কারণে তাদেরকে বের করার ফয়সালা করেছেন, তখন এসব বাহ্যিক উপায়-উপকরণ তাদের কোনো কাজেই আসেনি। আল্লাহ তায়ালার ফয়সালাই বাস্তবায়িত হয়েছে। (২-৫)

৩. ইহুদিগোষ্ঠী বনু নাজিরকে মদিনা থেকে বের করে দেওয়া হলে যুদ্ধ ছাড়াই তাদের সম্পদ মুসলমানদের হস্তগত হয়। যে সম্পদ যুদ্ধ ছাড়াই হস্তগত হয়, পরিভাষায় তাকে ‘মালে ফাই’ বলা হয়। এই মালের ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ‘এতে মুজাহিদদের কোনো অংশ থাকবে না; বরং তা বণ্টনের অধিকার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের। তিনি তা ফকির, মিসকিন, দুর্বল, প্রয়োজনগ্রস্ত ও নিকটাত্মীয়দের মাঝে বণ্টন করবেন।’ আয়াতে যদিও মালে ফাই বণ্টনের বিধান দেওয়া হয়েছে; কিন্তু এর মাধ্যমে ইসলামি অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ দর্শনও বলে দেওয়া হয়েছে। তা হচ্ছে ইসলাম চায় না, ধনসম্পদ কতিপয় ধনাঢ্য ব্যক্তির হাতে কুক্ষিগত হয়ে থাকুক; বরং ইসলাম চায়, ধনসম্পদ ছড়িয়ে পড়ুক, যাতে সমাজের কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তা থেকে বঞ্চিত না হয়। জাকাত, সদকা, মিরাস, গনিমতের এক-পঞ্চমাংশ প্রভৃতি বণ্টনের ক্ষেত্রে এই তত্ত্বটি কার্যকর রয়েছে। অর্থনীতির এই বড় দর্শন উল্লেখ করার পাশাপাশি এই আয়াতে আইনের উৎস সম্পর্কে বলা হয়েছে, নবী তোমাদের নিকট যা নিয়ে আসে এবং যা থেকে তোমাদের নিষেধ করে তোমরা তা থেকে বিরত থাক। (৭)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে যেসব বিধান ও আইনকানুন নিয়ে এসেছেন, তা অনুসরণ করা ওয়াজিব, তা কোরআনে উল্লেখ হোক বা হাদিসে। কোরআন ও হাদিস উপেক্ষা করে কোনো ধরনের আইনকানুন তৈরি করা জায়েজ নয়।

৪. সূরা হাশরে একদিকে যেমন আল্লাহর সন্তুষ্টিকে অন্যান্য জিনিসের ওপর প্রাধান্য দানকারী মুহাজির, আনসার এবং কেয়ামত পর্যন্ত তাদের অনুসরণকারী সকল মুমিনের প্রশংসা করা হয়েছে, তেমনিভাবে সেসব মুনাফিকের নিন্দা করা হয়েছে, যারা বিপদের সময়ে ইহুদিদের সাহায্যের ব্যাপারে আশ্বাস দিয়ে থাকে।

আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর উভয়ের পরিণতি হবে এই যে, তারা জাহান্নামে যাবে এবং চিরকাল সেখানে বসবাস করবে। এটাই জালেমদের শাস্তি।’ (৯-১৭)

সূরা হাশরের শেষরুকুতে মুমিনদেরকে আল্লাহ তায়ালার ভয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদেরকে বলা হয়েছে, তোমরা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের মতো হয়ে যেয়ো না, যারা আল্লাহর হকসমূহ ভুলে গিয়েছে। এর ফলে আল্লাহ তাদেরকে নিজেদের ভুলিয়ে দিয়েছেন।

আখেরাত ভুলে গিয়ে তারা জীবজন্তুর মতোই প্রবৃত্তির চাহিদা চরিতার্থ করতে ব্যস্ত। এ ছাড়াও মুমিনদের আল্লাহর কিতাবের মহত্ত্বের প্রতি মনোনিবেশ করার জন্য বলা হয়েছে, আল্লাহ যদি পাহাড়কে জ্ঞানবুদ্ধি দিতেন এরপর তার উপর কোরআন অবতীর্ণ করতেন তা হলে সে আল্লাহর ভয়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যেত। আফসোস হচ্ছে মানুষের ব্যাপারে, সে এই অতুলনীয় কালামের সম্মানের ব্যাপারে অজ্ঞ। সে তার হক আদায় করে না।

শেষে আসমাউল হুসনার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা বর্ণনা করা হয়েছে। যে শব্দের মাধ্যমে সূরাটি শুরু হয়েছিল, তার মাধ্যমেই এর সমাপ্তি ঘটেছে। তা হচ্ছে, আসমান ও জমিনে যা কিছু রয়েছে, তার সবকিছু আল্লাহ তায়ালার তাসবিহ পাঠ করে। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান। (১৮-২৪)

সূরা মুমতাহিনা

এটি মাদানি সূরা। আয়াতসংখ্যা: ১৩। রুকুসংখ্যা: ২

হযরত হাতিব বিন আবি বালতাআ রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনা: এ সূরার শুরু অংশ হযরত হাতিব বিন আবি বালতাআ রাদিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে। মক্কার মুশরিকদের উপর অনুগ্রহ জাহির করার জন্য তিনি গোপনে মক্কাবাসীর নিকট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অভিযানের সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বদরি সাহাবি ছিলেন। কিন্তু তার থেকে এমন এক কাজ প্রকাশ পায়, যা আল্লাহ এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অপছন্দ ছিল। এ কারণে তিনি অত্যন্ত লজ্জিত হন। খাঁটি মনে তাওবা করেন। তার এ তাওবা কবুল করা হয়েছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে এই আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়।

এতে আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের ব্যাপকভাবে নির্দেশ দেন যে, কাফেরদের যারা আমার ও তোমাদের দুশমন-বন্ধু বানাবে না। তারা এমন পাষাণ দিলের মানুষ, যারা মক্কার মুসলমানদের উপর কঠিন জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে। তাদেরকে সেখান থেকে হিজরত করতে বাধ্য করেছে। আজও তাদের মনে মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা- বিদ্বেষের আগুন জ্বলছে। মুসলমানদের কষ্ট দেওয়ার কোনো সুযোগ তারা হাতছাড়া করে না। হাত ও মুখ সবদিক দিয়ে তারা সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করে।

আত্মীয়তার বন্ধন-যাকে তোমরা অনেক বড় বিষয় মনে করছ, ঈমান আনা সত্ত্বেও তাদের উপকারের কথা ভাবছ, এগুলো কেয়ামতের দিন তোমাদের কোনো কাজে আসবে না। সেখানে পিতা ও সন্তান, ভাই ও ভাইয়ের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটানো হবে। আত্মীয়তার সম্পর্কের যখন এই অবস্থা তখন তাদের জন্য আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে খেয়ানত করা এবং মুসলিম জামাতের গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়া এটা কোন ধরনের জ্ঞানের পরিচায়ক!

এই বিষয়টি আরও জোরদার করার জন্য ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, যিনি আল্লাহর জন্য নিজের মুশরিক সম্প্রদায় থেকে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। তাই তার অনুসারীদের উপর আবশ্যক হচ্ছে তারা যদি কারো সাথে ভালোবাসা স্থাপন করে তা হলে তা হবে শুধু আল্লাহর জন্য। আর যদি তারা কারো সাথে শত্রুতা পোষণ করে তা হলে তাও হবে শুধু আল্লাহর জন্য। (১-৬)

আল্লাহ তায়ালা যখন মুসলমানকে কাফেরদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন তখন তারা তা বাস্তবায়ন করতে বিলম্ব করেনি। পিতা ছেলের থেকে, ভাই ভাইয়ের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলে। এর মাধ্যমে তাদের ঈমানি দাবির সত্যতা স্পষ্ট হয়ে সকলের সামনে চলে আসে। কিন্তু রক্ত ও ভূখণ্ডের সম্পর্ক এমন এক বিষয় যে, তার প্রতি ঝোঁক ও ভালোবাসা আল্লাহপ্রদত্ত, মানুষের স্বভাবগত বিষয়। এ কারণে কোরআন এ স্বভাবগত চাহিদার বিষয়টি লক্ষ রেখে মুসলমানদেরকে সুসংবাদ শুনিয়েছে। তাদের সাথে লেনদেনের অনুমতি দিয়েছে।

সুসংবাদ হচ্ছে, যারা তোমাদের শত্রু, আল্লাহ তাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সম্ভবত বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দেবেন। আল্লাহ সবই করতে পারেন এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল, করুণাময়। অর্থাৎ হতে পারে তোমাদের এসব আত্মীয়স্বজন ঈমান নিয়ে আসবে। গতকালের শত্রুরা বন্ধু বনে যাবে। আর এমনটাই হয়েছিল। মক্কা বিজয়ের সময় অসংখ্য মুশরিক ইসলামের সামনে মাথা নত করে দিয়েছিল। (৭)

এরপর আরও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যেসব মুশরিক ঈমান আনার কারণে তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেনি আর তোমাদেরকে তোমাদের ঘর থেকে বহিষ্কারও করেনি (অর্থাৎ তোমাদেরকে কোনোভাবে কষ্ট দেয়নি) সেসব মুশরিকের সাথে তোমরা উত্তম আচরণ করতে পারো। হ্যাঁ, যারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে তোমাদের বাড়িঘর থেকে বের করে দিয়েছে, অথবা এ কাজে সহযোগিতা করেছে, কেবল তাদের সাথে কোনো প্রকার বন্ধুত্ব করা নিষেধ। (৮-৯)

আসলে ইসলাম শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম। তা মানুষকে লাঞ্ছিত করতে কিংবা দীনে ইসলামের প্রচার ও বিজয় ইত্যাকার কোনো মহৎ উদ্দেশ্য ছাড়া নিছক ভূমি দখলের উদ্দেশ্যে যুদ্ধে জড়ানোর অনুমতি দেয় না। যেসব অমুসলিম মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ-বিগ্রহ না করা ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনোরূপ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত না হওয়ার শর্তে তাদের সাথে শান্তিচুক্তি করে নিরাপদে জীবনযাপন করতে চায় সেসব অমুসলিমের সাথে ইসলাম সদাচরণ করার নির্দেশ দেয়।

সূরা মুমতাহিনায় সেসব নারীর ব্যাপারে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, যারা ঈমান আনার পর হিযরত করে মদিনায় চলে এসেছিল। তাদের ব্যাপারে হুকুম দেওয়া হয়েছে, তাদের পরীক্ষা করো। তাদের ভালোভাবে যাচাই করে নাও যে, প্রকৃতপক্ষে কি তারা ঈমানের জন্যই হিজরত করেছে? যদি তাদের ঈমানের ব্যাপারে তোমরা নিশ্চিত হয়ে যাও তা হলে তাদেরকে কাফেরদের নিকট পাঠাবে না।

এ সূরায় যেহেতু পরীক্ষা করার আলোচনা এসেছে এজন্য এ সূরাকে মুমতাহিনা বলা হয়। মুফাসসিরগণ লিখেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কট্টর দুশমন উকবা ইবনে আবি মুয়াইতের মেয়ে উম্মে কুলসুম রাদিয়াল্লাহু আনহার হিজরত করে মদিনায় চলে আসার পর এই হুকুম অবতীর্ণ হয়েছে। তার পিতা হুদাইবিয়া চুক্তির ভিত্তিতে তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মদিনায় এলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে এই বলে খালিহাতে ফিরিয়ে দেন যে, আমাদের সন্ধিচুক্তি ঈমান আনয়নকারী পুরুষদের ব্যাপারে ছিল, নারীদের ব্যাপারে নয়।

এ সূরার শেষাংশে পুনরায় মুসলমানদের তাগিদ দেওয়া হয়, হে মুমিনগণ, আল্লাহ যে জাতির প্রতি রুষ্ট, তোমরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করো না। তারা পরকাল সম্পর্কে নিরাশ হয়ে গেছে, যেমন কবরস্থ কাফেররা নিরাশ হয়ে গেছে।

সূরা সফ

এটি মাদানি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ১৪। রুকু সংখ্যা: ২

এ সূরার বিষয় হচ্ছে জিহাদ ও কিতাল। আল্লাহ তায়ালার তাসবিহ ও পবিত্রতা বর্ণনা করার পর মুসলমানদের কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, তারা যেন অঙ্গীকার পূরণ করে। মুখে যা বলে কাজে যেন তা বাস্তবায়ন করে দেখায়। এরপর মুসলমানদের জিহাদের ব্যাপারে উৎসাহ দিয়ে মুসলিম উম্মাহর একতা ধরে রাখার এবং শত্রুর মোকাবেলায় সিসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় মজবুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। (১-৪)

এরপর বনি ইসরাইলের আলোচনা করা হয়েছে। মুসা আলাইহিস সালাম আমাকে আমালিকা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারা তা অমান্য করেছিল। ঈসা আলাইহিস সালাম তাদেরকে তার পরে একজন নবী আআর মুসংবাদ শুনিয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে সে নবীর অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বনি ইসরাইল এই নির্দেশও অমান্য করেছে। (৫-৬)

এ সূরায় এই সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে যে, ইসলামধর্ম অন্যান্য ধর্মের উপর বিজয়ী হবে। সত্যতার দলিল-প্রমাণের দিক থেকে তো প্রথম দিন থেকেই এ বিজয় অর্জিত হয়েছে। আর পার্থিব, রাষ্ট্রীয় ও বাহ্যিক দিক থেকে ইনশা আল্লাহ অচিরেই এ বিজয় অর্জিত হবে। (৯)

সূরা সফ-এর পরবর্তী আয়াতে মুসলমানদের এমন এক ব্যবসার প্রতি আহ্বান করা হয়েছে, যাতে কোনো লোকসান নেই। কেননা এ ব্যবসার অপর পক্ষ স্বয়ং আল্লাহ, যার সাথে ব্যবসা-করা-ব্যক্তি কখনো ক্ষতির সম্মুখীন হয় না। সে ব্যবসাটি হচ্ছে আল্লাহ এবং তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ঈমান আনা। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জানমাল দিয়ে জিহাদ করা। এর ফলে লাভ হিসেবে গুনাহ ক্ষমা, জান্নাতে প্রবেশ এবং আল্লাহর সাহায্যে কাফেরদের উপর বিজয় অর্জিত হবে।

হায়! যদি পার্থিব ব্যবসা-বাণিজ্য এবং দুনিয়াবি লাভ-লোকসানে ডুবে থাকা মুসলমান এই ব্যবসাটি করে দেখত তা হলে তাদের লাঞ্ছনা সম্মানে, পরাজয় বিজয়ে পরিবর্তিত হয়ে যেত। মুমিনদের বলা হয়েছে, তোমরা আল্লাহ তায়ালার দীনের দাওয়াত এবং তার সাহায্যের জন্য এমনভাবে দাঁড়িয়ে যাও, যেমনভাবে হাওয়ারিরা তাদের নবী ঈসা আলাইহিস সালামের সাহায্যে দাঁড়িয়েছিল।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, সূরার শুরুতে ফাঁকা বুলি আওড়াতে এবং কাজ ছাড়া শুধু স্লোগান দিতে নিষেধ করা হয়েছে। আর সূরার শেষে আল্লাহর দীনের সাহায্যের জন্য কোমর বেঁধে সাহায্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটা হচ্ছে সূরার শুরু এবং শেষের মধ্যে অপূর্ব মিল।

সূরা জুমআ

এটি মাদানি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ১১। রুকু সংখ্যা: ২

এ সূরার আলোচ্য বিষয় হচ্ছে বনি ইসরাইলের কাঁধে যে আমানত রাখা হয়েছিল তার বর্ণনা দেওয়া। তারা সে আমানতের হক আদায় করতে পারেনি। এই কারণে তাদেরকে সেই গাধার সাথে তুলনা করা হয়েছে, যার পিঠে বরকতময় ইলমি কিতাবের বোঝা রাখা হয়েছে। বোঝার ভারে তার কোমর নুয়ে আসছে। কিন্তু এই কিতাবসমূহে যে অমূল্য রত্নভাণ্ডার রয়েছে, এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন সে। এর দ্বারা সে কোনো উপকৃত হতে পারে না।

সূরা জুমআর সূচনা হয়েছে আল্লাহ তায়ালার তাসবিহ ও প্রশংসা উল্লেখের মাধ্যমে। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণাবলি এবং তাকে পাঠানোর উদ্দেশ্য বর্ণনা করা হয়েছে। তা হচ্ছে তেলাওয়াত, তাজকিয়া (পরিশুদ্ধি), কোরআন ও হেকমতের তালিম তথা শিক্ষাদান। (১-৩)

এরপর ইহুদিদের আলোচনা করা হয়েছে, যারা আসমানি ওহী তথা তাওরাতের বিধানের উপর আমল না করায় তাদেরকে এমন গাধার সাথে তুলনা করা হয়েছে, যে গাধার উপর পবিত্র ও মূল্যবান কিতাবের বোঝা চাপানো হয়েছে।

এরপর তাদেরকে মুবাহালার দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। যদি তারা প্রকৃতপক্ষে আউলিয়াউল্লাহ (আল্লাহর বন্ধু) হয়ে থাকে, তা হলে তারা যেন মৃত্যু কামনা করে। কেননা আল্লাহর বন্ধুদের জন্য পৃথিবী এক কয়েদ খানা। আখেরাতে তাদের জন্য স্বচ্ছন্দ জীবনযাপন এবং নেয়ামতের অফুরন্ত ভাণ্ডার রয়েছে। সাথে সাথে এই ভবিষ্যদ্বাণীও করা হয়েছে যে, তারা কখনো মৃত্যু কামনা করবে না। কোরআনের এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন হতে চলেছে। (৫-৭)

সূরার শেষে মুমিনদের উপর জুমআর নামাজ ফরজ হওয়ার বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। তাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আজান শোনা মাত্র সব ধরনের ব্যবসা- বাণিজ্য, ক্রয়-বিক্রয় ছেড়ে আল্লাহর জিকিরের দিকে দৌড়ে আসার জন্য। তবে নামাজ শেষ হলে পুনরায় তাদের আয়-উপার্জনের অনুমতি রয়েছে। (৮-৯)

সূরা মুনাফিকুন

এটি মাদানি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ১১। রুকু সংখ্যা: ২

মুনাফিকদের চরিত্র, তাদের মিথ্যাবাদিতা, গুপ্তচরবৃত্তি, মুসলমানদের ব্যাপারে বিদ্বেষ ছড়ানো এবং তাদের জাহের ও বাতেনের বৈপরীত্যের কথা আলোচনা করা হয়েছে। মুনাফিকদের নিকৃষ্ট চেহারা এবং তাদের ঘৃণ্য দোষত্রুটির কথা অন্যান্য সূরাতেও আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু এ সূরাটি বিশেষভাবে তাদের নিন্দা প্রকাশের জন্যই অবতীর্ণ হয়েছে। সূরাটি শুরু হয়েছে মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য উল্লেখের মাধ্যমে। তাদের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মিথ্যা, প্রতারণা, ধোঁকা, মুখের কথা ও অন্তরের মাঝে বৈপরীত্য। তাদের অন্তরে একটা থাকত আর মুখে তার ভিন্নটা প্রকাশ করত। (১-৩)

প্রিয় পাঠক, একটু থামুন। চোখ বন্ধ করুন। অন্তরের চোখ খুলুন। বর্তমান নেতা এবং গোটা জাতির কথা একটু চিন্তা করুন। এসব বৈশিষ্ট্য কি আমাদের মধ্যেও পাওয়া যায় না? চারদিকে কি মিথ্যা প্রতারণার সয়লাব দেখা যায় না? বর্তমানের সবচেয়ে বড় সমস্যা কি জাহের-বাতেন এবং কথা ও কাজের বৈপরীত্য নয়?

আলোচনা হয় অত্যন্ত সারগর্ভ, লেখা অত্যন্ত চমৎকার, কথাবার্তা গাম্ভীর্যপূর্ণ; কিন্তু আমলের বেলায় কিছুই নেই। যেন একটা খালি ঢোল, যা পেটানো হচ্ছে। তার আওয়াজ দূরদূরান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু যদি তা বিদীর্ণ করা হয় তা হলে ভেতরে কিছুই পাওয়া যাবে না। না ঈমান রয়েছে, না তাওয়াক্কুল, না মহব্বত, না মারেফত, না ইহসান, না ভয়-ভীতি। ঈমানের কোনো গুণই বিদ্যমান নেই। উলটো নর্দমার নাপাকির মতো নেফাকি উপচে পড়ছে।

সামনে বলা হয়েছে, মুনাফিকদের দেহ বড় অদ্ভুত। কথা ভারি মিষ্টি। চমৎকারভাবে তারা সাজিয়ে-গুছিয়ে কথা বলে। কিন্তু তাদের ভেতরটা পুরোই খালি। তারা এতটাই ভীতু যে, কোথাও থেকে কোনো উঁচু আওয়াজ এলেই তারা পেরেশান হয়ে পড়ে যে, মৃত্যু চলে এলো কিনা? (৪)

সামনে সামনে তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং মুসলমানদের প্রশংসা করতে পিছপা হতো না; কিন্তু পেছনে পেছনে তারা জঘন্য কথাবার্তা বলত। আল্লাহর পানাহ! (৭-৮)

সূরার শেষে মুসলমানদের বোঝানো হয়েছে, তারাও যেন মুনাফিকদের মতো ধনসম্পদ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে না পড়ে। আল্লাহ তায়ালার জিকির ও তার আনুগত্য থেকে গাফেল না হয়ে যায়। তাদেরকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে, মৃত্যু আসার পূর্বে তারা যেন ধনসম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে। অন্যথায় মৃত্যু চলে এলে আফসোস ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।

হায় আফসোস! মুসলমানরা এ মূল্যবান নসিহত পেছনে ফেলে দিয়েছে। তারা নিজেদের এই বলে সান্ত্বনা দিচ্ছে যে, এ সূরাতে আমাদের আলোচনা করা হয়নি। আমাদের নিন্দা করা হয়নি; বরং এতে চোদ্দশ বছর পূর্বের আবদুল্লাহ বিন উবাই এবং তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের আলোচনা করা হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন কোরআনের কিছু সূরা ও আয়াতের সম্পর্ক বর্তমান যুগের সাথে নেই!

সূরা তাগাবুন

এটি মাদানি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ১৮। রুকু সংখ্যা: ২

সূরাটি মাদানি হলেও এতে মক্কি সূরার বৈশিষ্ট্যই প্রাধান্য পেয়েছে। সূরার শুরুতে বলা হয়েছে, সব জিনিস আল্লাহ তায়ালার পবিত্রতা বর্ণনা করছে। এরপর মানুষকে দুই ভাগ করা হয়েছে। একশ্রেণি আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতের শোকরগুজার অপর শ্রেণি তার নেয়ামতের প্রতি অকৃতজ্ঞতা পোষণকারী। (১-২)

এরপর তাদের সামনে অতীতের জাতিসমূহের আলোচনা করা হয়েছে। যারা আল্লাহর রাসূলদের মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। পরিণামে তাদেরকে আল্লাহর আজাবের সম্মুখীন হতে হয়েছে। (৫-৬)

এ সূরায় সেসব মিথ্যাবাদীর আলোচনা করা হয়েছে, যারা কেয়ামতকে মিথ্যা মনে করে থাকে। তাদেরকে শপথ করে বলা হয়েছে, কেয়ামত অবশ্যই আসবে, কেউ স্বীকার করুক বা অস্বীকার করুক। মৃত্যু-পরবর্তী জীবন সত্য, সুনিশ্চিত। (৭)

এই সূরায় কেয়ামতের দিনকে يوم التغابن — তাগাবুন তথা ক্ষতি ও লোকসানের দিন বলা হয়েছে। কেয়ামতের দিন কাফেররা তো জান্নাতিদের দেখে, নিজেদের ক্ষতির উপলব্ধি করতে পেরে আক্ষেপ করবে, আর ইবাদতগুজার মুসলমানরা আফসোস করবে, হায় আমি যে পরিমাণ ইবাদত ও আনুগত্য করেছিলাম যদি তার চেয়েও বেশি ইবাদত করতাম! (৯)

স্ত্রী, সন্তান ও সম্পদের স্বরূপ

এই সূরায় প্রথমে মুমিনদের বলা হয়েছে, তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের মাঝে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু। অর্থাৎ তারা যদি আল্লাহর নাফরমানি করতে উৎসাহ দেয়, তা হলে তারা শত্রুর মতো। তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। মানুষ কখনো কখনো তাদের জন্যই নিজের আখেরাত বরবাদ করে দেয়। হালাল হারামের বাছ-বিচার করে না। দীনি হক ও দায়িত্ব পালনের প্রতি যত্নবান হয় না।

তাদের মহব্বত ভালোবাসার কারণে হিজরত ও জিহাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত বলা হয়েছে, তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি হল ফেতনা। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা বলেন, এদের ভালোবাসায় মগ্ন হয়ে আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হয়ে থাকে!

সূরার শেষে মুমিনদের আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করার, তার রাস্তায় খরচ করার এবং কূপ তা থেকে বেঁচে খাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (১৬-১৭)

সূরা তালাক

এটি মাদানি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ১২। রুকু সংখ্যা: ২

সূরাটিতে অন্যান্য মাদানি সূরার মতো বিভিন্ন শরয়ি বিধান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিশেষত এতে পারিবারিক ও সাংসারিক জীবনের বিধিবিধান উল্লেখ করা হয়েছে। তালাকের প্রকার এবং তালাক-পরবর্তী ইদ্দত, ভরণ-পোষণ, বাসস্থান প্রভৃতি বিধান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

সূরার শুরুতে তালাকের শরয়ি পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলমানদের হুকুম দেওয়া হয়েছে, যদি বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে যায়, তালাক ছাড়া কোনো রাস্তা না থাকে, তা হলে স্ত্রীকে এক তালাকে রাজয়ি দিয়ে তাকে ইদ্দত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত ছেড়ে দেওয়া। এই তালাক এমন পবিত্রতার মেয়াদে (হায়েজবিমুক্ত সময়) হওয়া উচিত, যাতে স্ত্রীর সাথে সহবাস হয়নি। এরপর ইদ্দত শেষ হওয়ার আগেই তালাক প্রত্যাহারের মাধ্যমে স্ত্রীকে পুনরায় ফিরিয়ে নেওয়া। একে তালাকে সুন্নি বলা হয়।

এসব বিধান ও শর্ত এ বিষয়ের ইঙ্গিত প্রদান করে যে, আল্লাহ তায়ালার নিকট তালাক অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ। যদি কিছু সমস্যা দেখা না দিত, তা হলে শরিয়তে কখনো তালাকের অনুমতি দেওয়া হতো না। কেননা তালাকের কারণে বংশের ভিত্তিমূলই ভেঙে পড়ে। অথচ ইসলাম পারিবারিক ব্যবস্থাকে মজবুত ও সুদৃঢ় করতে চায়।

বিভিন্ন ধরনের তালাকপ্রাপ্ত নারীর ইদ্দত

এরপর সূরা তালাকে স্পষ্ট ভাষায় বিভিন্ন ধরনের তালাকপ্রাপ্ত নারীর ইদ্দতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

ইয়ায়েসা: এমন বৃদ্ধ নারী, যার হায়েজ আসে না। তার ইদ্দত হল (তিন

হায়েজের পরিবর্তে) তিন মাস।

সগিরা: এমন মেয়ে, হায়েজের বয়সে উপনীত হওয়ার পূর্বেই যার বিয়ে হয়ে গেছে। (হায়েজ না হওয়ার কারণে) তার ইদ্দতও তিন মাস।

হামেলা: গর্ভবতী অবস্থায় যার তালাক হয়ে গেছে। তার ক্ষেত্রে ইদ্দতের হিসাব হবে সন্তান প্রসব হওয়া বা কোনো কারণে গর্ভপাত হওয়া পর্যন্ত।

ইদ্দত ছাড়াও খরচাদি ও বাসস্থানের আলোচনাও এখানে করা হয়েছে। (১-৭)

চারবার তাকওয়ার কথা

এই শরয়ি বিধান আলোচনার মাঝে চারবার তাকওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমবার ১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো, যিনি তোমাদের প্রতিপালক।’

দ্বিতীয়বার ২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যে-ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করবে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য বিপদ থেকে বের হওয়ার রাস্তা বের করে দেবেন।’

তৃতীয়বার ৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যে-ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করবে, আল্লাহ তায়ালা তার কাজ সহজ করে দেবেন।’

চতুর্থবার ৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যে-ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে পাপাচার থেকে দূরে রাখবেন। তাকে মহাপ্রতিদান দেবেন।’

এর মাধ্যমে বোঝা যায়, আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টিতে তাকওয়া কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ছাড়াও অন্যান্য কিতাবের পরিবর্তে কোরআনের আলোচনার ভঙ্গির পার্থক্যের বিষয়টিও বুঝে আসে যে, কোরআন রস-কষহীন নিছক কোনো বিধিবিধানের কিতাব নয়; বরং বিধানাবলির ওপর আমল করার জন্য এতে বিভিন্ন স্থানে বহুবার উৎসাহ ও ভীতিপ্রদর্শন করা হয়েছে।

সূরার শেষে আল্লাহ তায়ালার নাজিলকৃত বিধানের ওপর আমল করার এবং তার বিরোধিতা থেকে বিরত থাকার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার জন্য সেই জাতির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে, যারা অবাধ্যতার ফলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছে। (৮-১০) শেষআয়াতে আসমান-জমিন সৃষ্টির মধ্যে যে কুদরত রয়েছে, তার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। (১২)

সূরা তাহরিম

এটি মাদানি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ১২। রুকু সংখ্যা: ২

এ সূরার মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ‘বাইতুন নবুওয়াত’ তথা উম্মাহাতুল মুমিনিনের (নবীপত্নী) ঘর-সংসার ও দাম্পত্য জীবন।

এই সূরার শুরুতে যে ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তার সম্পর্কও স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে। যখন তিনি নিজ বাঁদি উম্মে ইবরাহিমকে (মারিয়া কিবতিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহা) নিজের জন্য হারাম করেছিলেন অথবা যখন তিনি স্ত্রী যাইনাব বিনতে জাহাশ রাদিয়াল্লাহু আনহার থেকে মধু খাওয়া নিয়ে নিজের ওপর মধু খাওয়া হারাম করে নিয়েছিলেন, তখন অত্যন্ত মহব্বত মিশ্রিত ভাষায় তাকে সতর্ক করে বলা হয়, ‘হে নবী, আল্লাহ তায়ালা যে জিনিস আপনার জন্য হালাল করেছেন, আপনি কেন তা নিজের জন্য হারাম করছেন? আপনি কি এর মাধ্যমে আপনার স্ত্রীদের সন্তুষ্ট করতে চান? আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’ (১)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মধু না খাওয়ার বিষয়ে তার কৃত শপথের বিষয়টি স্ত্রী হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে বলেন তখন তিনি এটা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার নিকট ফাঁস করে দেন। যার কারণে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত ব্যথিত হন। এমনকি তিনি কয়েকজন স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার ইচ্ছাও করেন, যদিও তা বাস্তবায়িত হয়নি। আল্লাহ তায়ালা এসব স্ত্রীকে সতর্ক করে বলেন, ‘যদি নবী তোমাদেরকে তালাক দিয়ে দেন তা হলে এটা আশ্চর্যের কিছু নয় যে, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের পরিবর্তে তাকে তোমাদের চেয়েও উত্তম স্ত্রী দান করবেন।’ (৫)

এরপর এ সূরায় মুমিনদের হুকুম দেওয়া হয়েছে, তোমরা নিজেদের এবং নিজেদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। এ ছাড়াও বলা হয়েছে যে, আল্লাহর নিকট খাঁটি দিলে তাওবা করো। (৮)

সূরার শেষে দুটি দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। প্রথম দৃষ্টান্ত এক কাফের স্ত্রীর, যার স্বামী ছিলেন হযরত নুহ আলাইহিস সালাম। আয়াতে সৎ মুমিন দ্বারা তাকে উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত এক মুমিন নারী, যার স্বামী ছিল ফেরাউন।

আয়াতে কাফের দ্বারা তাকে উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছে। এই দুটি দৃষ্টান্ত থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, ব্যক্তি নিজে যদি মুমিন এবং নেককার না হয়, তা হলে কোনো মুমিনের নিকটতম আত্মীয়তা, বংশ ও সৌন্দর্য কখনো কোনো উপকারে আসবে না। (১০-১১)

চলবে ইনশাআল্লাহ...

লেখক: আলেম ও ওয়ায়েজ; খতিব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।

(ঢাকাটাইমস/০৭এপ্রিল/এসআইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :