ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-২৭

কোরআনের বিস্ময়কর প্রভাব ও নেয়ামতরাজির বর্ণনা

মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী
 | প্রকাশিত : ০৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৯:৩৬

প্রিয় পাঠক,

জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল ঢাকা টাইমসের আয়োজনে আজ আমরা পবিত্র কোরআনুল কারীমের ২৭ তম পারা থেকে তাফসির করছি।

ছাব্বিশতম পারার শেষে সেই ফেরেশতাদের আলোচনা করা হয়েছে, ইবরাহিম আলাইহিস সালাম যাদেরকে মানুষ মনে করেছিলেন। যখন তিনি বুঝতে পারলেন প্রকৃতপক্ষে তারা মানুষ নন; ফেরেশতা, তখন তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন— আপনারা কী উদ্দেশ্যে এসেছেন? তারা বলেন, লুত সম্প্রদায়ের ওপর পাথর নিক্ষেপ এবং তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য আমাদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

আগের পর্ব: ধারণা ও মন্দ উপাধিসহ যে ৬ দোষ সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করে

লুত সম্প্রদায় ছাড়াও সূরা জারিয়াতে ফেরাউন, আদ, সামুদ ও নুহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের পরিণতির কথা বলা হয়েছে। এরপর আসমান ও জমিনের সৃষ্টির প্রতি মানুষের মনোনিবেশ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে জানা যায়, আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক জিনিসকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। (৪৯)

সূরার শেষে জিন ও মানবজাতির সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালার পরিচিতি এবং তার ইবাদতের জন্য তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ সংবাদ দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালাই সকলের রিজিকের দায়িত্বশীল। এরপর কাফের-মুশরিকদের কেয়ামতের দিনের কঠিন শাস্তির হুঁশিয়ারি শোনানো হয়।

সূরা তুর

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৪৯। রুকু সংখ্যা: ২

সূরার শুরুতে পাঁচবার পাঁচটি জিনিসের শপথ করে বলা হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে আপনার প্রতিপালকের আজাব অবশ্যম্ভাবী। কেউ তা রোধ করতে পারবে না।’ (৮)

কোরআনের বিস্ময়কর প্রভাব বিস্তার

এই আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে কতক মুফাসসির অন্তরে কোরআনের যে প্রভাব পড়ে এ প্রসঙ্গে হযরত জুবাইর বিন মুতয়িম রাদিয়াল্লাহু আনহুর ঘটনা উল্লেখ করেছেন। তিনি যখন কাফের ছিলেন তখন বদরের বন্দিদের ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য মদিনায় আসেন। যখন মদিনায় উপস্থিত হন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন মাগরিবের নামাজে সূরা তুর তেলাওয়াত করছিলেন। যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই সূরার ৭ নম্বর আয়াত তেলাওয়াত করেন, যার অর্থ হচ্ছে— ‘নিঃসন্দেহে আপনার প্রতিপালকের আজাব অবশ্যম্ভাবী’ তখন হযরত জুবাইর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছিল, আমার অন্তর বিদীর্ণ হয়ে যাবে।’

এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৩৫ ও ৩৬ নম্বর আয়াত তেলাওয়াত করেন, যাতে আল্লাহ তায়ালা প্রশ্ন করেছেন, ‘তারা কি (কারো সৃষ্টি ছাড়া) আপনা- আপনিই সৃষ্টি হয়ে গেছে, না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? নাকি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল তারা সৃষ্টি করেছে? আসলে তারা বিশ্বাসই করে না।’

তিনি (জুবাইর রা.) বলেন, ‘এই আয়াত শুনে আমার মনে হচ্ছিল যে, আমার অন্তর্জগত উড়াল দিয়ে চলে যাবে।’

হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারে এসেছে, একবার তিনি মদিনার গলিপথে হাঁটছিলেন। এই অবস্থায় একটি ঘর থেকে সূরা তুরের প্রাথমিক আয়াতগুলো তেলাওয়াতের আওয়াজ শুনতে পেলেন। তেলাওয়াত করতে করতে যখন সে إِنَّ عَذَابَ رَبَّكَ لَوَاقِعٌ পর্যন্ত পৌঁছল তখন তিনি গাধার পিষ্ঠ থেকে নেমে পড়েন। দীর্ঘ সময় ধরে দেয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে থাকেন। এরপর এক মাস পর্যন্ত তিনি ঘরেই অবস্থান করেন। লোকজন তার সেবা-শুশ্রূষার জন্য আসত; কিন্তু তারা তার অসুস্থতার কারণ খুঁজে পেত না।

কোরআনের প্রভাব বিস্তারের অনেক ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু এখানে এ ধরনের ঘটনা একত্র করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য আমাদের অন্তর যাতে কোরআন দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, আমরা যেন এসব ঘটনা থেকে সবক গ্রহণ করি। গভীর চিন্তাভাবনার সঙ্গে কোরআন তেলাওয়াত করা অথবা তা শোনার প্রতিজ্ঞা করি।

এরপরে মুত্তাকিদের স্থায়ী ঠিকানা জান্নাতের আলোচনা করা হয়েছে। তাদের জন্য সেখানে হুর-গিলমান, সুস্বাদু ফল, গোশত, পেয়ালাভর্তি শরাব প্রভৃতি নেয়ামত থাকবে। এরপর তারা পরস্পর আলাপকালে বলবে, আমরা ইতিপূর্বে নিজেদের বাসগৃহে ভীত-কম্পিত ছিলাম। অতঃপর আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করেছেন। আমরা পূর্বেও আল্লাহকে ডাকতাম। তিনি অনুগ্রহশীল, পরম দয়ালু। (১৭-২৮)

সামনের আয়াতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাপারে মুশরিকদের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। তারা তার সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করত। তাকে জাদুকর ও পাগল বলে আখ্যায়িত করত। আল্লাহ তায়ালা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দেন আপনি দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যান। তারা আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

সূরার শেষে মুশরিকদের ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডন করা হয়েছে। উলুহিয়্যাত ও একত্ববাদের দলিল প্রদান করা হয়েছে। সেসব বোকা ও আহাম্মকের নিন্দা করা হয়েছে, যারা ফেরেশতাদের আল্লাহর কন্যা আখ্যায়িত করত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাবলিগ ও দাওয়াতের কাজে ধৈর্যধারণের এবং আল্লাহর তাসবিহ ও প্রশংসা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ সংবাদও প্রদান করা হয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালা আপনাকে রক্ষা করবেন। আর জালেমদের দুটি শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। একটি পার্থিব আজাব অপরটি আখেরাতের। (৪৭)

সূরা নাজম

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৬২। রুকু সংখ্যা: ৩

এ সূরার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

১. সূরার শুরুতে নক্ষত্রের পতনের ব্যাপারে শপথ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার মিরাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে তিনি আল্লাহ তায়ালার অসীম কুদরত এবং তার রাজত্বের আশ্চর্য আশ্চর্য জিনিস প্রত্যক্ষ করেছেন। জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে তার আসল আকৃতিতে দেখেছেন। জান্নাত, জাহান্নাম, বাইতুল মামুর, সিদরাতুল মুনতাহা প্রভৃতি নিদর্শন প্রত্যক্ষ করেছেন। (১-১৮)

২. সূরা নাজমে মুশরিকদের নিন্দা করা হয়েছে, যারা লাত, উজ্জা, মানাত প্রভৃতি মূর্তির উপাসনা করত, ফেরেশতাদেরকে আল্লাহর মেয়ে আখ্যা দিতো। (১৯-২০)

৩. সূরায় কেয়ামতের আলোচনা করা হয়েছে। সেদিন ভালোমন্দ সকল কাজের পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে। মুত্তাকিদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তারা সব ধরনের গুনাহ ও লজ্জাজনক কাজ থেকে বিরত থাকে। কাফেরদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, তারা ইসলাম থেকে বিমুখ হয়ে থাকে। (৩২-৩৫)

৪. এই সূরা আমাদের জানাচ্ছে যে, প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ আমলের জিম্মাদার। কারো গুনাহের বোঝা অন্য কেউ বহন করবে না। মানুষ নিজের যে প্রশংসা করে থাকে, তা গ্রহণযোগ্য হবে না। (৩৮)

৫. এ সূরায় আল্লাহ তায়ালার অসীম ক্ষমতা এবং তার কিছু দলিল উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন; আল্লাহ তায়ালা মানুষকে হাসান, কাঁদান। তিনি মৃত্যু দেন। জীবিত করেন। নর-মাদী তিনিই সৃষ্টি করেন। পুনরায় জীবিত করা তারই কাজ। তিনি মানুষকে ধনী বানান। তাকে সম্পদ দেন। তিনি অবাধ্য জাতিকে ধ্বংস করেন। (৪৩-৫৫)

সূরার শেষে কোরআনের ব্যাপারে মুশরিকরা যে কর্মপন্থা গ্রহণ করেছিল, তা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, তোমরা কি এ বিষয়ে আশ্চর্যবোধ করছ? হাসছ? কাঁদছ না? বরং তোমরা কৌতুক করছ? তোমরা আল্লাহর সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়ো। তারই ইবাদত করো। (৫৯-৬২)

সূরা কামার

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৫৫। রুকু সংখ্যা: ৩

জাহান্নামের ব্যাপারে ভীতিপ্রদর্শন

এ সূরায় যেমন বিভিন্ন জিনিসের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তেমনই জাহান্নামের ব্যাপারে ভীতিপ্রদর্শন করা হয়েছে। মুমিনদের জন্য সুসংবাদ রয়েছে আর কাফেরদের জন্য দুঃসংবাদ। বিভিন্ন নসিহত ও শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। নবুওয়াত, রিসালাত, পুনরুত্থান, তাকদির প্রভৃতি মৌলিক আকিদা আলোচিত হয়েছে।

এ সূরার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে সংক্ষেপে তুলে ধরা হল:

১. সূরার প্রথম আয়াতে কেয়ামত নিকটবর্তী হওয়া এবং চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়ার কথা উল্লেখ হয়েছে। কেয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার অর্থ হচ্ছে বিগত নবীদের তুলনায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জমানা কেয়ামতের অধিক নিকটবর্তী। বুখারি ও মুসলিম শরিফে এসেছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল উঁচু করে বলেছেন, আমাকে এবং কেয়ামতকে এভাবে পাঠানো হয়েছে।

চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক প্রসিদ্ধ মুজিজা। মক্কাবাসীরা তার নিকট মুজিজা দেখতে চাইলে তিনি চাঁদের দিকে ইঙ্গিত করেন। চাঁদ তখন দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। কিন্তু যাদের ভাগ্যে হেদায়েত লেখা ছিল না, তারা এটা দেখা সত্ত্বেও ঈমান আনেনি। এজন্য বলা হয়েছে, তারা কোনো নিদর্শন দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে, এটা তো চিরাচরিত জাদু। (২)

আল্লাহ তায়ালা নবীকে হুকুম প্রদান করেন, আপনি তাদের থেকে বিমুখ হয়ে যান। সেই দিনের অপেক্ষা করুন, যে দিন তারা কবর থেকে বের হবে আর তাদের চোখগুলো থাকবে অবনমিত। লজ্জায় তাদের চেহারা কালো হয়ে যাবে। তারা আহ্বানকারীর দিকে দৌড়ে যাবে। নিজেরাই বলবে যে, এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন এক দিন। (৬-৮)

২. এরপর এ সূরায় মক্কার কাফেরদের ভীতিপ্রদর্শন করে বলা হয়েছে, তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যে আজাব নেমে এসেছিল, তোমাদের উপর যেন তেমন আজাব নেমে না আসে। কেননা তোমরাও তাদের মতো অপরাধ করেছ। ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিসমূহের আলোচনা করার পর আল্লাহ তায়ালা বারবার জিজ্ঞেস করেছেন যে, বল, আমার আজাব ও সতর্কবাণী কত কঠোর ছিল? জিজ্ঞাসার পর বলা হয়েছে, নিঃসন্দেহে আমি কোরআনকে বোঝার জন্য সহজ করে দিয়েছি। আছে কি কোনো উপদেশ গ্রহণকারী?

কোরআন সহজ হওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা তেলাওয়াত করা, মুখস্থ করা, এর থেকে উপদেশ গ্রহণ করা এবং তার উপর আমল করা সহজ। কোরআন সহজ হওয়ার কারণে গ্রাম্য লোকজনও সহজে কোরআন তেলাওয়াত করতে পারে। অথচ তারা মাতৃভাষাতে পত্রিকাও পড়তে পারে না। ছোট্ট মাসুম বাচ্চারা নিজেদের সিনায় কোরআনের সকল কায়দাকানুন মুখস্থ রাখতে পারে। নিষ্কলুষ হৃদয়ের অধিকারী মানুষ যখন এ কোরআন তেলাওয়াত করে বা তা শোনে তখন তাদের চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। অন্তরে আমলের আগ্রহ তৈরি হয়। কোরআন সহজ হওয়ার অর্থ কখনোই এটা নয় যে, জ্ঞানী-মূর্খ নির্বিশেষ যেকেউ অধ্যয়ন করলেই তার আয়াত থেকে মাসআলা-মাসায়েল উদঘাটন করতে পারবে!

৩. সূরার শেষে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমি প্রত্যেক জিনিসকে এক নির্দিষ্ট পরিমাপে সৃষ্টি করেছি। (৪৯)

বিশ্বজগতে ভালো মন্দ যা কিছু আছে, তার সবই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি। ধারাবাহিকতা ও হেকমতের তাকাজা অনুযায়ী যা হওয়ার, সব লাওহে মাহফুজে লিখিত আছে। সংঘটিত হওয়ার পূর্ব থেকে ই তা আল্লাহ তায়ালার জ্ঞানে রয়েছে।

আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাত এ আয়াত দ্বারা তাকদিরের উপর দলিল দিয়ে থাকেন। এ আয়াতে এটা স্পষ্টকরে দেওয়া হয়েছে যে মানুষের ছোট-বড় সব বিষয় লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ রয়েছে। আবার কিরামান কাতিবিন (সম্মানিত ফেরেশতাদ্বয়)-ও তা লিখছেন। তাই ছোট ভেবে কোনো গুনাহ করা ঠিক হবে না। তেমনিভাবে তুচ্ছ মনেকরে কোনো ভালো কাজছেড়ে দেওয়া যাবে না।

শেষে মুত্তাকিদের শুভ পরিণাম, তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি এবং সম্মানজনক বাসস্থান থাকার সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। (৫২-৫৩)

সূরা রহমান

এটি মাদানি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৭৮। রুকু সংখ্যা: ৩

একে عروس القرآن কোরআনের সৌন্দর্য, দুলহানও বলা হয়। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক বিষয়ের আরুস থাকে। কোরআনের আরুস হচ্ছে সূরা রহমান।

এ সূরায় আল্লাহ তায়ালা তার নেয়ামতসমূহের কথা উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে কোরআন অবতীর্ণ হওয়া এবং বান্দাদেরকে এই কোরআন শিক্ষা দেওয়ার নেয়ামত প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি অনেক বড় নেয়ামত। কোনো পার্থিব নেয়ামতই তার সমকক্ষ হতে পারে না। প্রত্যেক নেয়ামতের কোনো-না-কোনো বদল রয়েছে; কিন্তু কোরআনের কোনো বদল হতে পারে না। কোরআনের এক একটি আয়াত এবং এক একটি হরফ দুনিয়া এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু থেকে মূল্যবান। কোরআন সমস্ত আসমানি কিতাবের বিষয় সংরক্ষণকারী এবং তার হিতকারী।

এ সূরাটি আল্লাহ তায়ালা তার গুণবাচক নাম ‘রহমান’ দ্বারা শুরু করেছেন। এর দ্বারা যেন ইঙ্গিত করা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালার সকল নেয়ামত বিশেষত কোরআনের এই নেয়ামত তিনি রহমান ও দয়াময় হওয়ার এক নিদর্শন। তিনি রহমান হওয়ায় বান্দাদের উপর অনুগ্রহ করে থাকেন। তাদেরকে সব ধরনের নেয়ামত দিয়ে থাকেন। তাদের শিক্ষা ও হেদায়েতের জন্য তিনি কোরআন নাজিল করেছেন।

কোরআনের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝানোর জন্য বান্দাদের কোরআন শিক্ষা দেওয়ার বিষয়টিকে তিনি মানুষ সৃষ্টির আলোচনার পূর্বে উল্লেখ করেছেন। এরপর এ সূরায় বিশ্বজগতে ছড়ানো-ছিটানো আল্লাহ তায়ালার বিভিন্ন নেয়ামতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চন্দ্র-সূর্য আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত হিসাব অনুযায়ী নিজ নিজ কক্ষপথে চলছে। নক্ষত্র ও গাছগাছালি আল্লাহর দরবারে সিজদায় পড়ে আছে। জমিনকে মানুষের জন্য বিছানার মতো বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ফল-ফলাদি মানুষের উপকারে আসছে। মিঠা ও লোনা পানি আপন আপন স্থানে চলছে। কখনো তার মধ্যে মিশ্রণ ঘটে না। সমুদ্র থেকে মণি-মুক্তা আহরিত হয়। পাহাড়সদৃশ বড় বড় জাহাজ সমুদ্রে চলাচল করে। তা ভারী ভারী বোঝা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যায়। এটা যেমন অতীতে বোঝা বহনের উত্তম মাধ্যম ছিল, বর্তমানেও তা বোঝা বহনের মাধ্যম হয়ে আছে। (৫-২৪)

এসব পার্থিব নেয়ামত ছাড়াও সূরা রহমানে পরকালীন নেয়ামত ও আজাবের কথা উল্লেখ হয়েছে। আগুনের সামান্য শিখায় শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে। জাহান্নামের এক সামান্য স্ফুলিঙ্গ তাদের জ্বালিয়ে দেবে। জাহান্নামিরা বাধ্য হয়ে ফুটন্ত পানি পান করবে, যা তাদের নাড়িভুঁড়ি ছিড়ে ফেলবে।

পক্ষান্তরে মুত্তাকিদের জন্য থাকবে ঘন আঙুর বাগান। সবুজ-শ্যামল বাগিচা। তাতে প্রবাহিত হবে ঝরনাধারা। প্রত্যেক ফল দুই-দুই প্রকারের থাকবে। গালিচা বিছানো থাকবে। জান্নাতিরা পুরো রেশমের আসনে হেলান দিয়ে বসে থাকবে। উল্লিখিত দুটি বাগান ছাড়া আরও দুটি বাগান হবে। তাতে উদ্বেল (প্রবাহিত) দুটি ঝরনা থাকবে। বিভিন্ন ধরনের ফলমূল থাকবে। থাকবে লজ্জাবতী সুন্দরী রমণীগণও। দুনিয়া ও আখেরাতের এ সমস্ত নেয়ামতের কথা উল্লেখ করার পর আল্লাহ তায়ালা এ সুরায় একত্রিশবার প্রশ্ন করেছেন فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّين তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নেয়ামত মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে?)'

দুই, চার, দশ, বিশটি নেয়ামত হলে তা করা যেত। কিন্তু অসংখ্য নেয়ামত কীভাবে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা যাবে!?

সূরাটিকে ভাগ করা হলে দেখা যাবে, আল্লাহ তায়ালা শুরুতে সৃষ্টির আশ্চর্য বিষয়াদি উল্লেখ করে সেখানে আটবার বলেছেন, فبأي آلاء زتكما تكذين — তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নেয়ামত মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে? এরপর জাহান্নাম এবং তার আজাবের কথা আলোচনা করে সাতবার তিনি এ আয়াতটি উল্লেখ করেছেন। কোরআনের পাঠকগণ জানেন যে, জাহান্নামের দরজাও সাতটি। এরপর জান্নাতের বাগবাগিচা এবং তার অধিবাসীদের আলোচনা করতে গিয়ে এ আয়াতটি আটবার উল্লেখ করা হয়েছে। আর জান্নাতের দরজাও আটটি। এরপর কিছু বাগানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা পূর্বের বাগবাগিচার চেয়ে কিছুটা নিম্নমানের। এ বাগবাগিচার আলোচনা করতে গিয়ে এ আয়াতটি আটবার উল্লেখ করা হয়েছে।

এই ধারাক্রম ও বণ্টন থেকে কোনো কোনো মুফাসসির বলে থাকেন যে, যে- ব্যক্তি প্রথম আটটি বিষয়ের উপর আকিদা রাখবে এবং সে অনুযায়ী আমল করবে আল্লাহ তায়ালা তাকে জাহান্নামের সকল দরজা থেকে মুক্ত করবেন এবং তাকে উভয় প্রকার জান্নাতের হকদার বানাবেন।

অবুঝ আপত্তি ও তার খণ্ডন

কিছু নির্বোধ লোক আপত্তি উত্থাপন করে যে, আজাবের আলোচনার পর আল্লাহ তায়ালা কীভাবে বললেন فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبْنِ — তোমরা তোমাদের রবের কোন কোন নেয়ামত মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে?

দুইভাবে তাদের আপত্তির উত্তর দেওয়া হয়।

প্রথমত, জালেম, অবাধ্য ও গুনাহগারদের শাস্তি দেওয়া আল্লাহ তায়ালার ইনসাফের তাকাজা এবং এটা মজলুমের দৃষ্টিতে রহমত ও নেয়ামত।

দ্বিতীয় উত্তর দেওয়া হয় যে, কুফর, শিরক ও পাপাচারের পরিণাম বলে দেওয়াটা দয়াময় আল্লাহর অনেক বড় অনুগ্রহ। এটি কি আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, দুনিয়াতে যদি কোনো ব্যক্তি আমাদেরকে আসন্ন কোনো বিপদের ব্যাপারে আগাম সংবাদ দিয়ে দেয় তা হলে আমরা তাকে অনুগ্রহশীল মনে করি; কিন্তু সে মহান মালিককে আমরা অনুগ্রহকারী মনে করি না, যিনি আমাদেরকে আখেরাতের মহাবিপদের ব্যাপারে দুনিয়াতেই সতর্ক করে দিচ্ছেন! অথচ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন অতি তুচ্ছ। আখেরাতের বিপদের তুলনায় দুনিয়ার বিপদ কিছুই নয়!

সূরার শেষে বলা হয়েছে, আপনার প্রতিপালকের নাম বরকতময়, যিনি মহানুভব ও মহিমময়। আলেমগণ বলেছেন, সূরার শেষে বরকতময় বলে যে নামের কথা বলা হয়েছে, তার দ্বারা সূরার শুরুতে উল্লিখিত (রহমান) নামটি উদ্দেশ্য, যেন সূরার শেষে পুনরায় ইঙ্গিত করা হল যে পৃথিবী ও আকাশের সৃষ্টি কিংবা জান্নাত-জাহান্নামের অস্তিত্ব, যা কিছুই উল্লেখ করা হয়েছে, তার সবই সেই রহমানের রহমত।

সূরা ওয়াকিয়া

এটি মক্কি সূরা। আয়াত সংখ্যা: ৯৬। রুকু সংখ্যা: ৩

ফজিলত

হযরত আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, যে-ব্যক্তি প্রতি রাতে সূরা ওয়াকিয়া তেলাওয়াত করবে সে কখনো দরিদ্রতার মুখোমুখি হবে না। এজন্য এই সূরাকে সুরা গানি (ধনাঢ্যতা লাভের সুরা)-ও বলা হয়।

কেয়ামত

এই সূরার মাধ্যমে জানা যায়, যখন কেয়ামত সংঘটিত হবে তখন পৃথিবীতে ভূমিকম্প তৈরি হবে। পাহাড় তুলা হয়ে উড়ে যাবে। মানুষের তিনটি দল হবে।

১. আসহাবুল ইয়ামিন (তারা জান্নাতি)।

২. আসহাবুস শিমাল (তারা জাহান্নামি)।

৩. সাবিকুন (সৎকর্মশীল মুমিনগণ, কল্যাণময় কাজের ক্ষেত্রে যারা অন্যদের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন)।

মানুষকে এই তিন দলে বিভক্ত করার পর প্রত্যেক দলের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। তাদের পরিণামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। (১-৫৬)

আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব ও অসীম কুদরতের দলিল

এরপর এ সূরায় আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব, তার একত্ব ও অসীম কুদরতের দলিল উল্লেখ করা হয়েছে। পুনরুত্থান ও হিসাব-নিকাশের বিষয়টি সাব্যস্ত করা হয়েছে। যে সত্তা পানির ফোঁটা থেকে মানুষ তৈরি করতে পারেন, মাটির বীজ থেকে গাছ সৃষ্টি করতে পারেন, মেঘমালা থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করতে পারেন, গাছ থেকে আগুন তৈরি করতে পারেন তিনি অবশ্যই মৃত মানুষকে জীবিত করতে সক্ষম।

নিজ কুদরতের কথা আলোচনার পর আল্লাহ তায়ালা কোরআনুল কারিমের মহত্ত্বের কথা আলোচনা করেছেন। কোরআনের মহত্ত্ব বর্ণনা করার জন্য আল্লাহ তায়ালা নক্ষত্র পতনের স্থলসমূহের শপথ করেছেন। এ শপথের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা নিজেই বলেন, ‘এটি অনেক বড় শপথ, যদি তোমরা জানতে।’ (৭৬)

এ শপথের পর আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিঃসন্দেহে কোরআন অতি সম্মানিত কিতাব, যা লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত রয়েছে। যারা পবিত্র, তারাই কেবল এ কোরআন স্পর্শ করে, যা রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে।’ (৭৭-৮০)

আল্লাহ তায়ালা নক্ষত্রের শপথকে বড় বলে উল্লেখ করেছেন। আজকের জ্যোতির্বিজ্ঞান লক্ষ-কোটি নক্ষত্রের ব্যাপারে যেসব আশ্চর্য তথ্য দিচ্ছে এর মাধ্যমে বোঝা যায়, আসলেই এটি অনেক বড় শপথ।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলেন, বিশ্বজগতে পাঁচশ মিলিয়ন ছায়াপথ রয়েছে। প্রতি ছায়াপথে এক লক্ষ মিলিয়ন বা তার চেয়ে কম বা বেশি নক্ষত্র রয়েছে। প্রতিটি ছায়াপথ আপন কক্ষপথে ঘুরছে। চাঁদ প্রতিনিয়ত নিজ কক্ষপথ প্রদক্ষিণ করছে। পৃথিবী প্রতি ঘণ্টায় নিজ অক্ষে এক হাজার মাইল গতিবেগে চলছে। সূর্য প্রতি ঘণ্টায় ছয় লক্ষ মাইল পথ অতিক্রম করছে। নক্ষত্রের মধ্যে কোনোটি সেকেন্ডে আট মাইল, কোনোটি তেত্রিশ মাইল, কোনোটি ৮৪ মাইল গতিবেগে প্রদক্ষিণ করছে।

এগুলোর পরস্পরে সংঘর্ষ হলে গোটা বিশ্বজগৎ তছনছ হয়ে যাবে। যদি এসব গ্রহ-নক্ষত্রের গতিপথে কোনো পরিবর্তন চলে আসে বা বেশকম ঘটে তা হলে আমাদের দিনরাত এবং মৌসুম পর্যন্ত বদলে যাবে। এ বিস্তারিত বিবরণকে সামনে রাখলে বোঝা যায়, আসলেই আল্লাহ তায়ালা কত বড় শপথ করেছেন!

(কোরআনের পর নক্ষত্রের শপথ করার মাধ্যমে) নক্ষত্র ও কোরআনের মাঝে মিল হচ্ছে যেমনভাবে নক্ষত্রের মাধ্যমে মানুষ জল-স্থলের অন্ধকারে পথ খুঁজে পেয়ে থাকে, তেমনিভাবে কোরআনের আয়াতের মাধ্যমে মূর্খতা ও অজ্ঞতার অন্ধকারে হেদায়েতের উপকরণ লাভ হয়। যেমনভাবে নক্ষত্রপুঞ্জের সকল তথ্য ও রহস্য আজও পর্যন্ত মানুষের নিকট আবিষ্কৃত হয়নি তেমনিভাবে কোরআনুল কারিমের আয়াত ও সূরায় নিহিত সকল জ্ঞান ও রহস্য সম্পর্কে মানুষ আজও অবগত হতে পারেনি। সূরার শেষে আল্লাহ তায়ালা বলেন, মানুষের তিন দলের জন্য যে প্রতিদান ও পরিণামের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, নিশ্চয় তা ধ্রুব সত্য। অতএব আপনি আপনার পালনকর্তার নামে তাসবিহ পাঠ করুন। (৯৫-৯৬)

সূরা হাদিদ

এটি মাদানি সূরা। আয়াতসংখ্যা: ২৯। রুকু সংখ্যা: ৪

নামকরণ

লোহাকে আরবি ভাষায় হাদিদ বলা হয়। এ সূরায় যেহেতু আল্লাহ তায়ালার লোহা সৃষ্টি করার বিষয়টি উল্লেখ হয়েছে; তাই এ সূরাকে সুরা হাদিদ বলা হয়।

প্রথম বিষয়: তিনি কিছুর স্রষ্টা ও মালিক

এ সূরায় মৌলিকভাবে তিনটি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

প্রথমত বিশ্বজগতে যা কিছু রয়েছে, তার সবই আল্লাহ তায়ালার। তিনি সব জিনিসের স্রষ্টা ও মালিক। বিশ্বজগতের সবকিছু তার প্রশংসা ও তাসবিহ পাঠ করে। মানুষ, প্রাণী, গাছ-পালা, পাথর, জিন, ফেরেশতা, জড়পদার্থ, উদ্ভিদ সবকিছু জবান ও অবস্থার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার রহমতের কথার স্বীকৃতি দিয়ে যাচ্ছে।

যখন কিছুই ছিল না তখন তিনি ছিলেন। আর যখন কিছু থাকবে না তখনও তিনি থাকবেন। তিনি সব জিনিসের উপর কর্তৃত্ববান। তার উপর কেউ কর্তৃত্ব খাটাতে পারে না। তিনি এতটাই জাহের (প্রকাশ্যমান) যে, জগতের প্রত্যেক জিনিসেই তার কুদরতি শান ও হেকমতের নিদর্শন সুস্পষ্ট। আর তিনি এতটাই বাতেন (গোপন) যে, তিনি অস্তিত্বের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কোনো আকল- বুদ্ধির মাধ্যমে তার প্রকৃতি সম্পর্কে জানা যায় না। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে তা অনুভব করা যায় না। (১-৬)

দ্বিতীয় বিষয়: জান-মাল কোরবান করার নির্দেশ

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে এ সূরায় আল্লাহ তায়ালা এবং তার রাসূলের ওপর ঈমান আনা এবং দীনকে উচ্চকিত করার লক্ষ্যে জান-মাল কোরবান করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার ব্যাপারে উৎসাহ দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের কী হল যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করছ না? প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালা আসমান এবং জমিনের উত্তরাধিকারী’। (১০)

তোমাদের মৃত্যুর পর তোমাদের সমুদয় সম্পদের তিনি একাই ওয়ারিশ হবেন।। এরপর বলা হয়েছে, ‘কে সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহকে উত্তম ধার দেবে, এরপর তিনি তার জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন? তার জন্য রয়েছে সম্মানিত পুরস্কার।’ (১১)

আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়ের ব্যাপারে উৎসাহিত করার পাশাপাশি মুখলিস, মুমিন ও মুনাফিকদের যে অবস্থা হবে, তা বর্ণনা করা হয়েছে। (১২-১৫)

এরপর মুমিনদের বলা হয়েছে, এইসব মুনাফিক ও ইহুদি-নাসারার মতো দুনিয়ার জীবন এবং তার চাকচিক্যে তোমরা ধোঁকা খেয়ো না। বলা হচ্ছে, ‘যারা ঈমান এনেছে, তাদের কি এখনও সময় হয়নি যে, আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে, এর জন্য তাদের হৃদয় বিগলিত হবে? তারা তাদের মতো যেন না হয়, যাদেরকে পূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল। তাদের উপর সুদীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হয়েছে, অতঃপর তাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই পাপাচারী।’ (১৬)

তৃতীয় বিষয়: দুনিয়ার জীবনের বাস্তবতা

সূরায় আলোচিত তৃতীয় বিষয় হচ্ছে, আল্লাহ তায়ালা মানুষের সামনে দুনিয়ার জীবনের বাস্তবতা তুলে ধরেছেন। যেন তারা বাহ্যিক চাকচিক্য দেখে ধোঁকা না খায়। তাদের বোঝানো হয় যে, দেখো, এ দুনিয়া এক মরীচিকা। তা ধোঁকা ও তামাশার ঘর। বিবেক-বুদ্ধিহীন মানুষ সম্পদ ও সন্তানের আধিক্যের কারণে গর্ব করে থাকে। বংশ-প্রতিপত্তি নিয়ে অহংকার করে থাকে। দুনিয়ার উপায়-উপকরণ জমা করতেই তারা গোটা জীবন এবং তার যোগ্যতা-গুণ ব্যয় করে দেয়।

দুনিয়ার দৃষ্টান্ত হচ্ছে সেই শস্যখেতের মতো, যার শ্যামলতা ও সজীবতা দেখে কৃষক আনন্দিত হয়ে যায়। মানুষ অভিভূত হয়ে পড়ে। এরপর এমন এক সময় আসে যখন সব খড়-কুটা হয়ে উড়ে যায়। এটাই দুনিয়ার জীবনের অবস্থা। দুনিয়া ধ্বংসশীল। প্রত্যেক জিনিসের ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু পরকালের জীবন চিরস্থায়ী। তার নেয়ামতসমূহ চিরকাল থাকবে। (২০)

এই কারণে মুসলমানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ‘তারা যেন আল্লাহর মাগফিরাত ও জান্নাত অর্জনের জন্য প্রতিযোগিতা করে, দৌড়ে আসে।’ (২১)

সূরার শেষে আল্লাহ তায়ালাকে যারা ভয় করে এবং রাসুলের ওপর যারা ঈমান আনে, তাদের জন্য দ্বিগুণ সাওয়াব এবং তাদেরকে নূর প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যে নূরের আলোতে তারা চলতে পারবে। (২৮)

আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে সেই নুর দান করুন।

চলবে ইনশাআল্লাহ...

লেখক: আলেম ও ওয়ায়েজ; খতিব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।

(ঢাকাটাইমস/০৬এপ্রিল/এসআইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :