ইসলামই এতিম, মিসকিন ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে

আমরা যখন আমাদের দেশের রাজধানী শহর ঢাকার গণপরিবহণে যখন উঠি, তখন বসার আসনগুলোতে শুরুর দিকে বিশেষ একটা নির্দেশনার দিকে প্রায়ই নজর যায়। প্রত্যেকটি গণপরিবহণে নির্দেশনাটি লেখা থাকে। সেখানে লেখা রয়েছে- ‘নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের’ জন্য বরাদ্দকৃত আসন। এই নির্দেশনা পড়ে মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে। একজন প্রাপ্ত বয়স্কা নারীর কি শিশুর সমান মর্যাদা? সে কি করুণা বা স্নেহের পাত্র?। পৃথিবীর আর কোনো দেশে এমন নির্দেশনা আছে কি না জানা নেই। কিন্তু আমাদের দেশে এই ধরনের নির্দেশনা থাকার পরেও গণপরিবহণে নানা অপ্রীতিকর ঘটনার কথা আমরা প্রায়ই শুনি। ইসলাম নারীকে দিয়েছে উচ্চতর সম্মান। পুরুষের তুলনায় নারীকে ইসলামের নবী ভাগাভাগির চেয়ে সম্মানের অধিকার বেশি দিয়েছেন। ভাগাভাগির অধিকারেও নারীর তুলনায় পুরুষরাই পিছিয়ে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, তথাকথিত নারীবাদী আন্দোলন কর্মীরা ইসলামে নারী অধিকারের অন্তরায় বলার চেষ্টা করে বারংবার। কিন্তু বাস্তবে ইসলামে নারীর যেসব অধিকার এবং সম্মান দেওয়া হয়েছে সেসব নারীবাদ আন্দোলনের তীর্থভূমি মার্কিন মুলুক কিংবা ইউরোপে আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকা সূত্রমতে, ‘নারীবাদ হচ্ছে এমন এক মতবাদ যা লিঙ্গ নির্বিশেষে নারী-পুরুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সমতার কথা বলে’।
পশ্চিমা দেশে এই মতবাদের শুরু হলেও বর্তমানে গোটা বিশ্বে এই ধারণা ছড়িয়ে পড়েছে। মূলত উনিশ শতকের শুরুর দিকে নারীবাদ আন্দোলনের উৎপত্তি হয় পশ্চিমা দেশগুলোর তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে। সেসময় নারীর জন্য গৃহ নির্মাণসহ এবং গৃহস্থালি অনেক বিষয় আইনদ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। সম্পত্তিতে নারীর অধিকার ছিল না এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ ছিল না। এমনকি নিজের সন্তান প্রতিপালনেও নারীর অধিকার সীমাবদ্ধ ছিল। ১৬৬৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড রাজ্যে নারী অধিকার সংক্রান্ত এক আইনে ঘোষণা করা হয়, যে নারী কোনো ক্রীতদাসকে বিয়ে করবে সে তার স্বামীর প্রভুর দাস বিবেচিত হবে। ১৯ শতকের আগে মার্কিন নারীরা সম্পত্তির মালিকানা লাভের অধিকার পায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্তির এক বছর পর ১৮২১ সালে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ‘মেইন’ রাজ্য সর্বপ্রথম স্বামীর অক্ষমতার শর্তে নারীদের সম্পত্তির মালিকানা গ্রহণ এবং পরিচালনার অনুমতি দেয়। এমনকি নিজের নামে মালিকানা লাভের অনুমতি পেতে অপেক্ষা করতে হয় আরো ১৯ বছর। যুক্তরাষ্ট্রের সবথেকে পরিচিত রাজ্য নিউইয়র্কে বিবাহিত নারী সম্পত্তি আইন পাস হয় ১৮৬০ সালে। এমনকি গোটা আমেরিকায় কর্মক্ষেত্রসহ নানা ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ অধিকার বৈষম্য নিরসনে কেন্দ্রীয় আইন গৃহীত হয় বিশশতকের সত্তরের দশকে এসে। অর্থাৎ নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী দেশ মার্কিন মুলুকেও এখনো পর্যন্ত নারীর এমন অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি যা ইসলাম তথা মানবতার নবী মুহাম্মদ সা. দিয়েছেন প্রায় দেড় হাজার বছর আগেই। এই সামান্য আলোচনায় যদি আমরা দৃষ্টিপাত করি তাহলে আমরা এখানে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বই দেখতে পাই।
ইসলামই নারীর অধিকারের প্রথম রক্ষাকবচ। সম্মান, অধিকার, মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইসলাম কখনো নারী-পুরুষ, ধনী-গরীব, সাদা-কালো বর্ণবৈষম্য অনুমোদন করেনি। পৃথিবীতে দাস প্রথা বিলুপ্তির প্রথম ঘোষণা দিয়েছেন মুহাম্মদ সা.। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই প্রথম নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনিই প্রথম নারীকে সম্মানের আসন প্রদান করেন। এই নিবন্ধে আমরা আলোচিত এবং মৌলিক কিছু বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
নারীর বেঁচে থাকার অধিকার: নারীর বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন মুহাম্মদ সা.। প্রাক-ইসলামি যুগে কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তার বেঁচে থাকাটাই অনিশ্চিত ছিল। জন্মদাতা বাবা নিজে স্বীয় কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দিয়ে হত্যা করে ফেলত। এমন বর্বর, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন আরব সমাজে নারীর বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন মুহাম্মদ সা.। কন্যা সন্তানকে উত্তমভাবে লালন-পালনের বিনিময়ে মহাপুরস্কারের ঘোষণা করেছেন। কন্যা সন্তানের লালন- পালনকারীকে কেয়ামত পর্যন্ত আল্লাহর সাহায্যের সুসংবাদ দিয়েছেন এবং কেয়ামতে জান্নাতের ঘোষণা দিয়েছেন। (সহিহ বুখারী- হাদীস নং : ১২৪৮)
শিক্ষার অধিকার: নারী শিক্ষা নারীবাদ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবি। যা এখনো চলমান রয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। কিন্তু মহাম্মদ সা. নারী-পুরুষ সবার জন্য শিক্ষার সমান অধিকার এবং প্রয়োজনীয়তার স্বীকৃতি দিয়েছেন। (ইবনে মাযাহ, হাদীস নং- ২২৪)। বিভিন্নভাবে নারীদের জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁর যুগে বিভিন্ন বিষয়ে ওপর অনেক প্রাজ্ঞ নারী সাহাবী ছিলেন। নবীপত্নী আয়েশা রা.-এর জ্ঞানের কাছে তো অনেক অভিজ্ঞ সাহাবীও হার মেনেছেন। বিশ্ববিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজ-এর সাবেক রিসার্চ ফেলো ড. মুহাম্মদ আকরাম নদভি শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলিম নারীদের অসামান্য অবদান নিয়ে ৪৩ খণ্ডের বিশাল এক বিশ্বকোষ রচনা করেছেন। তাতে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি নারী হাদিস বিশারদ ও শিক্ষাবিদের কর্ম-অবদান তুলে ধরা হয়েছে। এসবই প্রমাণ করে নবী মুহাম্মদ সা. কতটা জোরালোভাবে নারীর শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন।
সামাজিক অধিকার: যে সমাজে নারীর বেঁচে থাকার অধিকার ছিল না সেখানে তার সামাজিক অধিকার থাকার তো কোনো সুযোগই ছিল না। মুহাম্মদ সা.-ই সর্বপ্রথম সামাজিকভাবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পারিবারিকভাবে স্ত্রীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। নারীকে কন্যা, স্ত্রী এবং মা হিসেবে নানা অধিকার ও মর্যাদার আসনে আসীন করে সামাজিকভাবে নারীর অধিকার বাস্তবায়ন করেন মুহাম্মদ সা.। শিক্ষা-দীক্ষা, চিকিৎসা, সাহিত্য, ইতিহাস; নানাখাতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে তিনি নারীর সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। অসংখ্য নারী সাহাবি ফিকহ, হাদিস, ইতিহাস, চিকিৎসা শাস্ত্র, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। এমনকি ইসলামে নারী সংক্রান্ত যত বিধিবিধান আছে তার অধিকাংশ মুহাম্মদ সা. থেকে নারীর মাধ্যমেই এসেছে।
রাজনৈতিক অধিকার: নবীজি সা. রাজনৈতিক পদক্ষেপে নারীর অংশগ্রহণ পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনায় নানা কাজে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন। এমনকি পুরুষ সাহাবিদের সাথে বীরত্বের সাথে যুদ্ধের ময়দানেও নারীর অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। স্বয়ং রাসুল সা. এর স্ত্রী আয়েশা বিনতে আবু বকর রা. উহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। (বুখারি, হাদিস: ২৮৮০)। সামরিক অভিযানেও নারী সাহাবিদের অংশগ্রহণ করার সুযোগ দিয়েছেন। উম্মে আতিয়া আনসারি রা. স্বয়ং মহানবী সা. এর সঙ্গে সাতটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এমনকি নারী সাহাবি আজরা বিনতে হারিস বিন কালদা রা. সেনাদলের নেতৃত্বও দিয়েছেন। এমনকি আলী রা.-এর সময়ে প্রকাশ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে রাজনৈতিক নেতৃত্বে আয়েশা রা.-এর অংশগ্রহণ দেখা যায়।
সম্পত্তির অধিকার: যে সম্পত্তির অধিকার আদায়ের জন্য গেল শতকেও আধুনিক বিশ্বে লড়াই করতে হয়েছে; মুহাম্মদ সা. নারীকে সে অধিকার দিয়েছেন বিনা আন্দোলনে। উহুদ যুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী এক সাহাবির সম্পত্তিতে দুই নাবালক কন্যার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। যা তৎকালীন প্রচলিত সামাজিক রীতি ও প্রচলিত ধারণায় দুই কন্যার চাচা হস্তগত করেছিলেন। (সুনান আবূ দাউদ- হাদীস : ২৮৮৮, সুনান আত তিরমিযী- হাদিস: ২০৯২)।
মতপ্রদানের অধিকার: যেকোনো বিষয়ে নারীর মত প্রদানের অধিকার প্রতিষ্ঠাতেও রাসূল সা. এর নির্দেশনা ছিল। বিয়েতে নারীর মত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন মুহাম্মদ সা. (সহীহ বুখারি, হাদিস, ৫১৩৬)। মদিনা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর মানবতার নবী নারীর মত প্রকাশের অধিকারের আইনগত ভিত্তি প্রদান করেন।
সবথেকে বড়ো কথা হলো ইসলামের নবী, আমাদের প্রাণের স্পন্দন মুহাম্মদ সা. নারীর যে অধিকার দিয়েছে সেটা কেবল অধিকার হিসেবেই বিবেচনা করলে চলবে না। বরং কিছু বিষয় আছে অধিকারের চেয়ে সম্মানকে বড়ো করে দেখতে হয়। অন্যথা মানবিকতা থাকে না। সন্তানকে দুগ্ধ পান করার জন্য স্ত্রী তার স্বামীর থেকে পারিশ্রমিক দাবি করতে পারে। এই অধিকার স্ত্রীকে দিয়েছেন আল্লাহর রাসুল। এখন কোনো স্ত্রী যদি তার স্বামীকে বলে, ‘পারিশ্রমিক না দিলে আমি তোমার সন্তানকে দুগ্ধ পান করাতে পারবো না’ তাহলে নারী জীবনের সব থেকে মহৎ এবং গৌরবের অর্জন সম্ভব হবে?। কখনোই না। একজন নারী একজন মা। ‘মা’ হতে পারা একজন নারীর জীবনে সবচে বড়ো অর্জন। মায়ের মমতায় তৈরি হয় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বন্ধন। সুতরাং অধিকার, সম্মান এবং ভালোবাসা এগুলো নিয়ম মেনে চলে না। মানবিকতায় চলে। মানবিকতা না থাকলে কেবল অন্তঃসারশূন্য সম্পর্ক কোনোকালেই কল্যাণ বয়ে আনে না।
এতিম ও মিসকিনের অধিকার: তৎকালীন জাহিলি সমাজে নারীর মতোই এতিম ও মিসকিনরা ছিল অধিকার ও প্রাপ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত। তিনিই সমাজে এতিমের অধিকার এবং মিসকিনের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন। এতিম বলতে তাদেরকেই বুঝানো হয়- যে নাবালকের বাবা পৃথিবীতে নেই। মূলত কোনো নাবালকের বাবা মারা গেলে সে তার অধিকার রক্ষা করার মতো বৈধ, শক্তিশালী এবং আন্তরিকভাবে অভিভাকশূন্য হয়ে পড়ে। পিতৃহীন নাবালক, বাবার রেখে যাওয়া সম্পদের মালিকানা লাভ কিংবা পরিচালনা করতে পারে না। অনেক সময় তার অক্ষমতার কারণে সেই সম্পদ অন্য কেউ জোরপূর্বক কিংবা অপকৌশলে নিজের হস্তগত করে নেয়। জাহিলি যুগে প্রথাগতভাবে এতিমদের নিকটাত্মীয়রা স্বাভাবিকভাবেই সেটা গ্রহণ করতো। রাসুলে আরাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই প্রথা বিলুপ্ত করেন। সমাজে প্রচলিত স্বাভাবিক প্রথা বিলুপ্তির মাধ্যমে তিনিই প্রথম সামাজিকভাবে এতিমের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে দেখা যায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাতটি বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা প্রদান করেন। যেখানে তিনি, স্বয়ং রাব্বুল আলামিনের সঙ্গে শিরক থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা প্রদান করেছেন। অর্থাৎ রব্বে কাবার সাথে শিরক করার মতো মহা জুলুমের মতোই এতিমের সম্পদ আত্মসাত করাও মহাজুলুম। মজার ব্যাপার হলো, এখানে নারীর ওপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়াকেও উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ নারীকে হেনস্তা করাও মহা অন্যায় সাব্যস্ত করেছেন মানবতার নবী মুহাম্মদ সা.। হাদিসটি এরকম, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ পরিহার করো। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল; সেগুলো কী? রাসুল সা. বললেন, আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা, জাদু করা, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ গ্রাস করা, যুদ্ধের মাঠ থেকে পলায়ন করা এবং মুমিন পবিত্র নারীকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া। (বুখারী, হাদীস : ২৭৬৬)। এতিমের মর্যাদা বয়ান করে তিনি বলেন- ‘যে ব্যক্তি কোনো এতিমকে আপন মা-বাবার সঙ্গে নিজেদের (পারিবারিক) খাবারের আয়োজনে বসায় এবং (তাকে এই পরিমাণ আহার্য দান করে যে) সে পরিতৃপ্ত হয়ে আহার করে, তাহলে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৮২৫২)। এমনিক তিনি এতিমের লালন- পালনকারীকে জান্নাতে স্বয়ং তার পাশাপাশি অবস্থানের সুসংবাদ দিয়েছেন (বুখারী, হাদিস: ৫৩০৪)।
মিসকিন: যে ব্যক্তি কোনো কারণে ফকির বা ভিক্ষুকের থেকেও অসহায় অবস্থায় রয়েছে তাকে সাধারণত মিসকিন বলা হয়। অর্থাৎ উপার্জনে অক্ষম কিংবা সম্পদ আছে কিন্তু প্রচুর অভাবও আছে। যার কারণে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, লজ্জায় কারো কাছে হাতও পাততে পারছেন না। আবার নিজের অভাবও মেটাতে পারছেন না; এমন ব্যক্তিকে মিসকিন বলা হয়। মিসকিনদের মর্যাদা রক্ষায় রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। যে ব্যক্তি তার প্রয়োজন মোতাবেক সম্পদ পায় না, অথচ আত্মসম্মানের ভয়ে সে এমনভাবে চলে যে, তাকে অভাবী বলে বোঝাও যায় না, যাতে লোকেরা তাকে আর্থিক সাহায্য করতে পারে। আর সে সাহায্যের জন্য কারো কাছে হাতও পাতে না, কিছু চায়ও না’ (বুখারি ও মুসলিম)।
মিসকিনের অধিকার: এরকম অসহায় দুঃস্থ মানুষের পাশে থাকার ব্যাপারে রাসুল সা. যেমনিভাবে উৎসাহ দিয়েছেন, তেমনি পাশে না থাকার ভয়ংকর পরিণামের কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি নিজে যেন মিসকিনদের পাশে সব সময় থাকতে পারেন আল্লাহ তাআলার কাছে সেই প্রার্থনা করেছেন (মুয়াত্তা, হাদিস: ৪৯৪)। অন্যদের প্রতিবেশী মিসকিনদের প্রতি সদয় হওয়া ও তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কঠোর বার্তা দিয়ে রাসুল সা. বলেন- ‘আল্লাহর কসম- সেই ব্যক্তি ইমানদার নয়, যে তৃপ্তি সহকারে খায় অথচ তার প্রতিবেশী গরিব মিসকিন অভুক্ত অবস্থায় থাকে’ (মিশকাত)। অর্থাৎ বিপদের সময় সাহায্য পাওয়া মিসকিনের অধিকার। জেনে বুঝে মিসকিনের এ অধিকার ক্ষুণ্ন করলে ব্যক্তির জন্য জাহান্নামের কঠিন আজাবের হুশিয়ারি রয়েছে।
মিসকিনের মর্যাদা: অসহায় মিসকিনের অধিকার সচেতনতার পাশাপাশি তাদের মর্যাদার ব্যাপারেও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে বলে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন- অসহায়দের প্রতি দয়া করলে রাব্বুল আলামীন আমাদের প্রতি দয়া করবেন। ‘আর যদি আমরা অসহায়দের সাথে দয়ার সম্পর্ক না রাখি তাহলে আল্লাহ তাআলাও আমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন’ এমন হুঁশিয়ারিও তিনি দিয়েছেন (তিরমিজি: ১৯২৪)। অর্থাৎ অসহায় মিসকিনদের প্রতি দয়াশীল হলে আল্লাহ তাআলা আমাদের সাথে নিজের সম্পর্ক রক্ষার মর্যাদা দান করবেন। কেননা, অসহায় তো সেই ব্যক্তি যে, নিজের আত্মসম্মান, মর্যাদা হারানোর ভয়ে কারো কাছে হাত পাতে না। গোপনে সেই অসহায়ের মর্যাদা রক্ষা করলে আল্লাহ তাআলাও তার পুরস্কারস্বরূপ বান্দার সাথে দয়ার সম্পর্ক রক্ষা করে তার মর্যাদা বাড়িয়ে দিবেন।
সবমিলিয়ে আমরা ইতিহাস তালাশ করলে দেখতে পাই যে- বিশ্বমানবতার মুক্তির মহামানব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- নারী, এতিম ও মিসকিনদের এমন-এমন অধিকার ও মর্যাদা বিবৃত করে গেছেন যার জন্য বর্তমান আধুনিক বিশ্ব এখনো লড়াই করে চলছে। আজকের উন্নত ইউরোপ, আমেরিকাতেও যেসব অধিকার ও মর্যাদা অনুপস্থিত; প্রায় দেড় হাজার বছর আগের আরবে সেটা পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। সুতরাং মানবজাতির কাক্সিক্ষত মুক্তি ও শান্তি মহানবীর আদর্শের মধ্যেই খুঁজতে হবে, খুঁজে পাওয়া যাবে। নারী মুক্তিও তাঁর জীবনাদর্শেই।

মন্তব্য করুন