ঢাকা টাইমস ঈদসংখ্যার কবিতা

সুভদ্রার বৃত্তপুষ্পস্তন
নির্মলেন্দু গুণ
একদা আমার পৃথিবীকে
প্রদক্ষিণ করতো চাঁদ।
মানুষ যাকে পূর্ণচন্দ্র বলে।
এখন পূর্ণচন্দ্রের বদলে
পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে
তোমার বৃত্তপুষ্পস্তন।
তোমার স্তনের কেন্দ্রস্থিত
বোঁটাটিকে ‘আমি’ ভেবে
আমি কী যে আনন্দ পাই,
সে আমার ঈশ্বর জানেন।
সুভদ্রা, তোমার স্তনের চেয়ে
মনুষ্যকল্পিত স্বর্গ কি সুন্দর?
আমার তা বিশ্বাসই হয় না।
অবশ্য সন্দেহ থাকা ভালো।
এরই নাম নাকি শিল্প।
হা ঈশ্বর, মূর্খরা যে কী বলে!
---------------------------------
কাছে-দূরে
মহাদেব সাহা
তুমি কাছে এলে মনে হয় দূরত্বই ভালো ছিল
সারাক্ষণ জুড়ে ছিলে তুমি, কাছে এলে তুমি নেই
তোমাকে পাই না আর, যেন তুমি থেকেও থাকো না
কাছে এলে শুরু হয় প্রকৃতই তোমার বিরহ;
তাই তো দূরত্ব ভালো সারাক্ষণ দেখাশোনা হয়
কাছে এলে আর তো হয় না দেখা, এই মেতে থাকা
যতক্ষণ দূরে থাকো ডুবে থাকি তোমার ভেতরে
একেবারে তুমিময় হয়ে যায় আমার হৃদয়।
দূরেই তো ভালোবাসা, কাছে দুঃখ, কাছেই বিরহ
আমি তাই প্রেমকে বিরহ বলি, বিরহকে প্রেম
দূরে থেকে যতখানি দেখা যায় ভালোবাসা যায়
কাছে থেকে কিছুই যায় না, কেমন বিরহে থাকি;
তুমি কাছে এলে মনে হয় দূরত্বই বুঝি ভালো
দূরে গেলে মনে হয় কখন তোমাকে কাছে পাই।
---------------------------------
ফিলিস্তিন
টোকন ঠাকুর
ফিলিস্তিনি মায়েদের কবর তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে
ফিলিস্তিনি ভাইয়েদের কবর তাক করা আছে আকাশের দিকে
ফিলিস্তিনি শিশুদের কবর দেখতে পাচ্ছি আয়নায় তাকিয়ে
আমারই চোখের মধ্যে।
দুনিয়ার মানচিত্র থেকে ফিলিস্তিন-গাজা প্রায় মুছে দেওয়া হচ্ছে
কিন্তু ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের চেয়েও দ্বিগুণ ফিলিস্তিন জেগে উঠছে
আমারই বুকের মধ্যে।
যদিও আমেরিকা বলতেই থাকবে-
‘ইসরায়েলিদের আত্মরক্ষার অধিকার আছে’
যদিও বাংলাদেশ থেকে মানুষ আমেরিকায়ই যেতে চাইবে-
যারা আমারই মতোন, একদা ফিলিস্তিনকে ভালোবেসে কবিতা লিখেছে।
---------------------------------
পবিত্র বোকামিগুলো
সরকার আমিন
বললে, কী পারো? বললাম, মরতে। প্রেমের জন্য মারা যেতে।
তুমি অবিশ্বাসের মতো করে হাসলে
বললাম, পারি। কী? তোমার চোখ জিজ্ঞাসাকাতর।
বললাম, পারি- বাঁচতে, প্রেমের জন্য
উড়ে যেতে পারি, শালিক পাখির মতো
সাঁতার কাটতে পারি, অচীন কোনো মাছের মতো
যুদ্ধ করতে পারি কোনো বীর মুক্তিযোদ্ধার মতো
মারতে পারি, মরতে পারি
প্রেমের জন্য করতে পারি পবিত্র বোকামি
কারণ প্রেমের জন্যই বেঁচে থাকি আমি!
---------------------------------
আদর্শলিপি
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
অঙ্গ-প্রতঙ্গের মতো প্রতিটি বর্ণ
মালার মতো সুন্দর, অদৃশ্য প্রেসে কাঠখোদাই শরীর।
অক্ষর আর অঙ্গ মূলত মুদ্রার দুই পিঠ
অনেকটা একই সুরসূত্রে যমজ!
আমার দেহজুড়ে স্বরব্যঞ্জনে ছড়ানো-জড়ানো
‘অ’ থেকে ‘হ’।
আমি খুবই ক্ষুদ্র একটি আদর্শলিপি বই।
---------------------------------
সাধ
নাজমীন মর্তুজা
সাধ হয় ...
যাবতীয় বিমুগ্ধতা উচ্চারণ কষ্ট আবেগ
মিলে-মিশে বই হয়ে উঠি,
তোমার মুঠোয়।
ভয় নেই ...
অনৈক্য অহমিকার বিক্ষিপ্ত উপাখ্যানের
কোনো জীবন লিখে যাবো না,
কিংবা মরণ ললাটে
নির্বাণসংগীতের কোনো স্তোত্রগান।
স্বপ্ন দেখি...
তাবৎ শোকগাথার মুকুট জড়িয়ে
রক্ত নদী বেয়ে বেয়ে
ঘুমিয়ে পড়বো সাদা পায়রার পাশে।
স্মৃতিময় ....
সেই পাওয়ার সুখটুকু ফ্রেমে বন্দি
শৃঙ্গের স্পর্শটুকু, পয়োধরের কম্পন
পদ্মপাতার কোলে বীর্যস্খলন,
যেন লেবার রুমের জন্মমুহূর্তে
বিষণ্ন প্রহর গুনে গুনে
বাসর ঘরে পড়ে-থাকা হাজার বেলী
পেন্ডুরার বাক্সে রঙিন পাথর।
দেখতে চাই ...
সমস্ত বিষণ্নতা পেরিয়ে
নক্ষত্রনীলে তোমার মুখে
নিজের মুখ।
---------------------------------
দ্বৈরথ
বুলবুল খান মাহবুব
ক্রমাগত মুখোমুখি যুগের দ্বৈরথী
পরস্পরকে চ্যালেঞ্জ করছে যেন কুমারের দক্ষ হাতে গড়া দশভূজা
অসুর নিধনে মত্ত আর সেই ক্ষমতালিপ্স বিশালদেহী দানব
মৃত্যু অনিবার্য জেনেও ভ্রষ্ট ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে চায়।
নিভে যাওয়া নক্ষত্রের আলো নেই
উষ্ণতা নেই মৃত মানুষের চুম্বনে
অথচ প্রতিদিন পরম পুরুষের স্বপ্নকে হত্যা করে
সবাই হাত বাড়িয়ে আছে ঈশ্বরের করুণা ছোঁবে বলে।
দ্বৈরথ সমরে আজ পিছুহটে কূজ অসুর
রণাঙ্গনে নীল রক্ত, শারদীয় সুনীল আকাশে
প্রতিবিম্ব দেখে কাঁপে অতীত বৈভব।
---------------------------------
কবির চোখে জল
মোসলিমা খাতুন
নিদ্রাহীন রাত
একটি দীর্ঘ কবিতার মতো
দীর্ঘ আলাপন দীর্ঘ বিশ্লেষণ
দীর্ঘ নিষ্পেষণ দীর্ঘশ্বাস অমৃত মন্থন
দিন-রাত্রির সন্ধিক্ষণ কবির মন
স্বপ্নমগ্ন হলুদ পাতার মতো
অন্যরকম নিজস্ব অন্তঃপুরে
কবিরা চিরকাল দরিদ্র এবং একা
অধিকারবঞ্চিত নির্যাতিত
নিষ্পেষিত কালান্তক দুঃসময়
অনাদর কবিকে ঘিরে থাকে সর্বদা,
নিরণ্ন মানুষের ক্ষুধার মতো
কবিকে কারো কাছে হাত পাততে নেই
হৃদয়ের অন্তর্লীনে না পাওয়াগুলো
দুঃখরাতের মতো পুষে রাখতে হয়,
কবির কোনো নিকানো উঠোন নেই
মুক্ত জানালা নেই, কড়িকাঠ নেই
কান্নার জন্য নিভৃত কোনো ঘর নেই
বিতাড়িত উদ্বাস্তু, কোনো ইচ্ছাপূরণ নেই
সীমানায় বিক্ষুব্ধ প্রাচীর
ঝরেপড়া ফুলের জীবন
কবি পাখি হতে চায়
নদীর জল স্বচ্ছ নেই
আপন গতিতে বয়ে যায়- স্বাধীনতা নেই
বৈরী বাতাসে অস্থির মেঘ আকাশ বিষণ্ন
কবির চোখ সর্বদা সজল
অসুস্থ সে গভীরতর অসুখ তার।
---------------------------------
নৈবেদ্যের সাতরঙা দীপান্বিতা
আনিসুর রহমান খান
পৃথিবীর সমস্ত ধুলো এসে ঢেকে দেবে আমার দুচোখ
আমি থাকবো রঙের ওপারে নিঃশব্দে বিলীন
তাবৎ অন্ধকার শুষে নেবে ঠিকরেপড়া আলো
আমি অন্ধকার হাতড়ে-হাতড়ে শুনতে পাবো
নিখোঁজ হয়ে গেছি দীপান্বিতার থেকে
কাঙালীয় ঝুলি হাতে পথে-পথে এঁকে যাব দীপান্বিতার মারবেল চোখ
যে চোখ আমায় স্বপ্নের সবটুকু দিয়ে রেখেছে সতর্ক।
বিশ্বাসের নৈবেদ্য সাতরঙা আঁচলে দিয়েছে নিবিড় ভবিষ্যৎ
পথের সমস্ত বিভ্রম ভেঙে আমাকেই ভেবেছে একমাত্র সত্য
তার আর কিছু চাইবার, আর কিছু হারাবার নেই
এই উদ্ভ্রান্ত সময়ে দীপান্বিতা ছাড়া আমার আর কেউ নেই।
---------------------------------
ক্যাটবেরি ভিখারি
কামরুল কমল
রাস্তার ভিখারি জানে না
আমিও ভিখারি এক চকচকে ক্যাটবেরি
যার নেই কোনো সংবেদ
আহত করে না কিছু
খিদে পেলে খেতে চাই তারই মতো করে
হাত পেতে তাকিয়ে থাকি
মনে মনে ছবি আঁকি, করি পরিমাপ
দেবে কি দেবে না ঝাঁপ।
তার মতো সংগ্রামে আমিও
জোটাতে আহার
ক্ষুধা কেন ফিরে আসে পুনরায়
রাস্তার ভিখারি সহসা ধরা পড়ে আয়নায়।
---------------------------------
শান্তিনিকেতনে একদিন
অর্ক অপু
দুইটি পাখি,
একজন আরেকজনকে গালি দিচ্ছে।
আমরা তাকে কলকাকলী ভেবে মুগ্ধ হচ্ছি।
‘মুগ্ধতা বাঁচে নির্জ্ঞানে’- এমন বয়ানে
কত কত বেলা হলো বনশ্রীবালা
গোপন রেখেছে দেহ-মধ্যে ফুটে থাকা শিল্পকলা।
পাই তার গন্ধ সকাল-সন্ধ্যা-
কখনো-বা হাত দেই, ধরি
নোনতা লাগে স্বাদ, যেন সমুদ্র... ঢেউ
আমি তার গভীরতা ধরতে না পারি।
---------------------------------
সৌন্দর্যের নন্দন-ভাবনা
ইমরুল কায়েস
সুন্দরতা, আমিও চাই
গোলাপের ব্যভিচারী ব্যবচ্ছেদ নয়।
যদি সবগুলো পাপড়ি ছিঁড়ে ফেলো
তবু কি পরিস্ফুট হবে সৌন্দর্য।
সময়ের ভগ্ন মানচিত্রে অবচেতন ইতিহাস,
অপ্সরীর মাদকতায় নগ্নপুঁজির আকাক্সক্ষা,
পৃথিবীর ইন্দ্রসভায় বীভৎস উল্লাস।
তবু সুবেদী রমণী
বারে বারে দেখে যায় স্নানাগারে
যুগল স্তনের নন্দনতত্ত্ব।
---------------------------------
বয়ান
আযাদ কামাল
ভাষা-সংস্কৃতির শাশ্বত মুক্তিই
আমাদের প্রাণের স্বাধীনতা...
বর্ণ-অক্ষরের একান্ত সহযোগে
শব্দের অপরিহার্য প্রয়োগ-
বিন্যাসে- মহতের সুরবন্দনায়
রচিত হয় সভ্যতারই ইতিহাস...
যখনই আঁধার নেমেছে কখনও
এই বাংলায়- তাবৎ দুনিয়ায়
জেগেছে লেখকসত্তার সাহসী
বাণী- আলোর মশাল হাতে...
যুগে-যুগে কালে-কালে সেতো
প্রিয় মুখ- সোনাঝরা রোদ্দুরে
রাজনীতি, সংস্কৃতি হোক তবে
আমাদের চেতনার শুদ্ধ বয়ান।
---------------------------------
মা
সাইমুম সোহরাব
মা চোখে ভালো দেখেন না।
নাতি, নাতনি ছেলেপুলের হৈ-হল্লার সংসারে মা-ই শুধু কম দেখেন!
কখনও কলপাড়ে, বাঁশের মাঁচায়, বকুল তলায়,
বাবার কবরের পাশে টিট্টি পক্ষীর মতো, একা বসে থাকেন।
কার জন্য? সে কে?
কিচ্ছু চান না কারও কাছে, কোনো আবদার আহ্লাদ নেই।
আমরা তারা খসে গেলে টেরপাই, বাজখাই ডাকে
আকাশ ভেঙে পড়লে তোমাকেই ডাকি,
দূর আকাশের ভুবনচিলের ছোঁ মারবার কৌশলও চোখ এড়ায় না।
শুধু তোমাকেই চোখে পড়ে না মা।
---------------------------------
ভালোবাসা ও বৃষ্টি
আইভি রহমান
বৃষ্টি কি শুধু আকাশের বুক থেকে ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়লেই হয়!
মনে হয় কথাটা পুরোপুরি ঠিক নয়-
বৃষ্টি হতে পারে উত্তাল কথামালার স্রোতের সাথে..
হাত রেখে মুগ্ধতার হাতে
বৃষ্টি নেমে আসতে পারে তুমুল বন্যায়..
কারো চেহারার স্নিগ্ধ প্রসন্নতায়...
এমনকি, বৃষ্টি চোখের নোনাপানি হয়েও বয়ে যেতে পারে..
অদ্ভুত কোনো ভালোবাসার কারাগারে।
আসলে ভালোবাসার আরেক নামই বুঝি বৃষ্টি!
---------------------------------
একদিন এক মুহূর্তের ভাঙন নয়
ফরিদ হাসান
দ্বার খুলি ভোর আসে নতুন কোনো যুদ্ধের আভাস নিয়ে।
ঘরে-বাহিরে দৈন্য, হাহাকার, ভগ্নহৃদয় আর অনিশ্চিত
জয়-পরাজয়ের তৃণাচ্ছাদিত ময়দানে বড়ো সংকোচ নিয়েই বেঁচে আছি,
অসিদ্ধ পথিক আমি তাই তো মুখ থুবড়ে পড়ি।
আমি আমার আর্তনাদ রেখে পালাতে পারি না,
গা ভাসিয়ে কিংবা বৃদ্ধাঙুল দেখাতে জানি না,
আমি কি ভীরু? নাকি আমি যুদ্ধ পছন্দ করি না!
তোমরা আমাকে স্বার্থপর বলতে পারো,
আবার করুণাও দেখাতে পারো শুনাতে পারো সমাধানের নয়-ছয়,
তাতে কতটুকুই আর দৌড়াবো, কতটুকুই-বা গুছাবো,
এতো একদিন এক মুহূর্তের ভাঙন নয়।
নেমে গেছি, খানিকটা থেমেও গেছি, পাল দিয়েছি ছেড়ে,
যাঁর হাতের কলমে লেখা আমার নিয়তির গতি,
তৈরি করুক যোদ্ধা আমায়, নাবিক আমায়,
পুড়াইয়া যত পবিত্র অনলরীতি।
---------------------------------
সুখ-দুঃখের জীবন
রহমান শিবলু
নদী গভীর, সাগর গভীর- গভীর আরো মন
সেই গভীরে ডুইবা মরি আমি সারাক্ষণ।
নদী এসে সাগরে মিশে দূর মোহনায়
চলো দু'জন তেমনি হারাই দূর অজানায়।
গভীর থেকে গভীরতায় হারায় দুটি মন
পায় না কোনো কূল-কিনারা খুঁজে সারাজীবন।
তবুও আমাদের পথচলা সুখ-দুঃখের জীবন
সারাজীবন পাশে থাকবো এই মোদের পণ।
---------------------------------
অভিমান
বৈকুম মনজু
তোমার কাছে থাক আমার ব্যক্তিগত আলাপ
আমার কাছে থাক তোমার ব্যক্তিগত চিবুক
কৃত্রিম বনিবনায় এই তো সম্বল
যত্ন করে রেখে যাও তোমার দৈনন্দিন তিরস্কার
অবেলায় ওগুলোই ডাকবে কাছে!
মানুষ থাকে অনেক তবুও কষ্ট দেয় একজনই
অনেক মানুষের কাছে যাই তবু
একজনই দূরে থেকে কাঁদে অভিমানে
অভিমান কমাতে পারে চমৎকার বোঝাপড়া
আমি বোঝাপড়া নিয়ে এগিয়ে গেলেও
তুমি ফেল করেছো অভিমান কমাতে!
---------------------------------
চেয়ারখানা
ওয়াহিদ মুরাদ
চেয়ারখানা বড়ো মজবুত, বড়ো শক্ত
চেয়ারখানা যিনি বা যাঁরা বানিয়েছেন
তাঁরা বড়োই দীনহীন কুলজন
চেয়ারখানায় যাঁরা রং লাগিয়েছেন
গদি সেটে দিয়েছেন
কাঠ-পাট যা যা দরকার
যে যা দেওয়ার দিয়েছেন
সুন্দর সংযোজন ঘটিয়েছেন শতভাগ
সুন্দর একটা দিন পাঁজি পুঁথি ঘেটে
বের করে চেয়ারে বসানো হলো তাঁকে
হৈচৈ রৈ রৈ পড়ে গেলো সারা পাড়ায়
সে বসেছে চেয়ারে, আমাদের লোক
দিন যায় মাস যায়
দীর্ঘ কয়েকটি বছর এমনই কেটে যায়
একদিন মিস্ত্রি, রং দেওয়ার মানুষ, গদি লাগানো শ্রমিক
তাদের কিছু দাবি দাওয়া জানালো
চেয়ারে বসা মানুষটির কাছে
তখনই বাঁধলো সমস্যা
চেয়ারে বসার পূর্বে
যেসব ওয়াদা দিয়েছিলেন
তার কোনোকিছুই মনে নেই তাঁর
সবাই বলেছিল
এমনই হবে একদিন
আসলে চেয়ারে যে বসে
সে-ই তো ভুলে যায় সব
যেমন ভুলে গেছেন
আজকে চেয়ারে বসা যিনি...
যাকে আমরা আমাদের লোক ভেবেছিলাম
---------------------------------
সুদিনের ডাক
আবেদীন জনী
আমাদের স্বপ্ন আঁকার প্রিয় ক্যানভাসে
কারা যেন টেনে দিতে চায় কালো কালো দাগ
আমাদের শ্যামল সবুজ জুড়ে কার যেন উদ্ভট পায়ের ছাপ
হে বাংলাদেশ,
তোমাকে দাঁড়াতে হবে শিঁরদাড়া সোজা করে, দাঁড়াতেই হবে
একাত্তরে যে রকম রুখে দিয়েছিলে মাংসাশী হায়েনার দল
সেভাবেই শক্ত হাতে রুখতে হবে হিংস্র সময়
সবুজ ছায়ার নিচে ফিরিয়ে আনতে হবে ভয়হীন সুন্দর দিন
যেন নিশ্চিন্তে পাপড়ি ছড়াতে পারে
আমাদের সব ঘাসফুল এবং গোলাপ।
---------------------------------
তোমার আলো মোর অন্তরে
জয়নুল আবেদীন
নদীর মাঝি যদি করলে অন্তরে,
তবে কেন নৌকার মায়া ভিতরে?
ক্লান্ত দুপুরে তোমার আলোর সন্ধানে,
নৌকার মাঝি আমি ভাসি অন্তরে।
ক্লান্ত এই দুপুরে তুমি ছাড়া,
কে আছে আমার এই সংসারে?
জীবনের যে গল্প তুমি,
দিয়েছ মোর অন্তরে,
সে যে আর হয় না শেষ।
সীমানার ওপারে যে আলো
তুমি রেখেছ জ্বেলে,
সে যে আমায় হরণ করে।
কী করে আমি রাখি ধরে,
তোমায় মোর অন্তরে?
ক্লান্ত দুপুরে তোমার নদীর মাঝি,
কেন করলে আমার অন্তরে?
নৌকার মাঝি সে যে আমি,
সে কি তোমার নয় কেহ !
---------------------------------
তোমাকে ভেবে-ভেবে কিছুই লিখিনি আমি
চৌধুরী ফেরদৌস
তোমাকে ভেবে-ভেবে কিছুই লিখিনি আমি-
লিখেছি তো শুধু তা-ই,
পৃথিবীর সব অরণ্যের সুন্দরের গভীর ভেতরে
চিতা আর হায়েনারা যে-প্রকারে
মায়াবী হরিণটিকে নির্দয়-নির্মমভাবে শিকার করে:
পৃথিবীর সব ডায়ানা
প্রতিটি প্রেমিকের সাথে
সেরকমই করে-
আলো নয়, আশা নয়,
প্রেম-ভালোবাসা নয়,
তোমার মুখের পরে-
ভ্রু, ঠোঁট, চোখ আর চোখের পলকে
পৃথিবীর হায়েনারা,
যত বাঘ, চিতাবাঘ খ্যালা করে-
প্রেম নয়, প্রেম নয়,
প্রেমের আড়ালে বাঘ
অতি-সন্তর্পণে তার লেজ নাড়ে-
তোমাকে নিয়ে লিখব কী-করে?
যত ল্যাখ, যত আঁকো
সব ডায়ানা, সব বাঘ, সব হায়েনা
রূপ, রস, অর্থ, গন্ধ শুকিয়ে-ফুরিয়ে গ্যালে
ঝরে পড়ে-
---------------------------------
ভালোলাগা ভালোবাসার গান
মাহমুদ নজির
এ বিষয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই
যা বলার অনেক আগেই বলে দিয়েছি।
অনেক আগেই জানিয়েছি মূল বক্তব্য,
সহজ ভাষায় পুঙ্খানুপুঙ্খ।
বিবিধ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনায়
থাকে না কোনো গূঢ় তাৎপর্য,
মহৎ কোনো উদ্দেশ্য, সংবেদ।
কথা বাড়ালেই ক্যাচাল, অভিমান আর
অপ্রাসঙ্গিক বিতর্কের বৈরী ঝড়!
আজকাল বোকার হদ্দ নয় কেউ।
সকলেই নিজেকে ভাবে বেশ চালাক
সকলেই ধূর্ত পণ্ডিত, সম্মাননীয়
দুধেধোয়া, মহান নির্দোষ।
তাইতো কথা করেছি খাটো
ক্ষুদ্রকায়, সংক্ষেপ।
যাতে তোমার বোধগম্য হয়।
ফাল্গুনের এই ফুলফোটা দিনে
মন হোক ভালো, বিশুদ্ধ সুন্দর।
মুক্ত বাতাসে ভেসে কাব্যিক সুষমায়
উজ্জীবিত হোক ব্যাকুল হৃদয়।
গুঞ্জরিত হয়ে রিনিঝিনি ছড়িয়ে যাক
জীবন ও যৌবনের
ভালোলাগা, ভালোবাসার গান।
---------------------------------
মৌমাছির কথকতা
মাহবুব মোর্শেদ মানিক
খোপার মধ্যে মৌমাছিটার গুণ-গুণানি।
সমস্ত রাত ঝরনা যেমন শব্দকাটে,
পাহাড়ি খাদ সমস্ত রাত।
খোপায় কি না সন্দেহ হয়
চুলতো খোলা, হয়তো মাছি বুকের মধ্যে
কিন্তু ব্রাও তো ঢিলেঢালা।
হয়তো বুকের মৌমাছিটাই পাহাড়ে চড়তে
পিছলে গিয়ে অনেক নিচে, অনেক নিচে
পড়তে পড়তে পিছলে গিয়ে অনেক নিচে
পড়তে পড়তে ঊরুর খাদে আটকে ছিল।
তাই সারারাত গুণ-গুণানি মৌমাছি না জলপ্রপাত!
------------------
অপেক্ষা
রীতা শবনম লিপি
একটা গাছ একটা মানুষ আর একটা স্মৃতিসৌধ
পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠছে...
মানুষ পিঁপড়ের মতো সারিবদ্ধ অপেক্ষা করছে
আধুনিক কোনো প্রমিথিউসের জন্য।
সভ্যতা এক টুকরো কয়লা-কালো প্রাণহীন- তবে সম্ভবনাহীন নয়;
অমিত শক্তি নিয়ে বিরাজমান, মাঝে-মাঝে প্রশ্নবিদ্ধ।
প্রশ্নবিদ্ধ সময়ের অতলান্ত গভীর থেকে সূর্যের তেজস্বীয়তায়
একটা মুষ্টিবদ্ধ হাত প্রতিবাদের প্রতয়ে বারবার জেগে ওঠছে
দূষিত-কলুষিত বাতাসে কোনো এক নিরোর বাঁশি বেজে চলেছে।
কে গায় ঘুমপাড়ানিয়া গান! ঘুম আয় ঘুম আয় ঘুম আয়...
চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে;
হৃদয় ব্যবচ্ছেদ হয় ল্যাবরেটরিতে রক্তাক্ত লাল হৃদয়।
একজন বহুকালদর্শী গবেষক নিবিষ্ট মনে হৃদয়ের ভেতরের
প্রতিটি অণু-পরমাণু খুঁজে চলে কোথায় ভালোবাসা!
হায়, ভালোবাসাহীন পৃথিবী!
হে বহুকালদর্শী, অনেকদিন অনেক-অনেক রাত জেগে
যে কৃত্রিম ভালোবাসা সৃষ্টি করেছো তা এখন ইনকিউবেটরে ধুঁকছে
আমরা রোবট-হৃদয় মানুষÑ অপেক্ষায় আছি...
আমাদের হৃদয় ভালোবাসায় প্লাবিত হবে
পৃথিবীর কোথাও যুদ্ধ হবে না।
--------
জরিপ
জাহাঙ্গীর আলম জাহান
ইফতারে ক্যান লাগে বলো এত্ত খাবার
পণ্য কি তোর খরিদ করা শ্বশুর বাবার
বাদ দে খেজুর, লেবু, সালাদ, অন্যসব
লাগবে না আর ইফতারে এই পণ্য সব।
পানির সাথে চিবিয়ে মুড়ি কর ইফতার
আজকেই কর কে অসাধু-জরিপ তার
সেই জরিপে যে ব্যবসায়ীই দায়ী হোক
বুঝতে হবে তারা তো নয় ভালো লোক।
তুলতে হবে চামড়া পুরো চাবকে আজ
ভুলিয়ে দিতে হবে ঠিকই বাপকে আজ।
-----------------
ঈদ
বুলবুল আহমেদ
রমজানের শেষে উঠবে চাঁদ
আসবে খুশির ঈদ,
শিশু ছেলেমেয়েদের যেন
নাইরে কোনো নিদ।
চাঁদের খুশিতে বান লেগেছে
মুসলিম উম্মার ঘরে,
দুঃখের ভাগী ধনীরা যেন
হয় গরিবের তরে।
জাকাত, ফিতরা, ছদকার টাকা
করিও দু হাতে দান,
সম্পদ মোদের খাঁটি হবে
বাড়বে আত্মসম্মান।
ধনী-গরিবের ভেদাভেদ ভুলে
নামাজ পড়বো মোরা,
নামাজ শেষে করবে মোলাকাত
মুমিন-মুসলিম তোরা।
দুঃস্থ, এতিম, দুঃখির তরে
খাবার দিও ভাই,
আল্লাহ তোমার সহায় হবে
এর তুলনা নাই।
ঈদের খুশি বিরাজ করুক
সর্বজনের মাঝে,
ত্যাগের শিক্ষা দেয় যেন
ওগো সকাল-বিকাল-সাঝে।
-----------------
ডাকবাক্স
মৃত্তিকা মুক্তা
মন খারাপের গল্পলেখা চিরকুট উড়ে যায় বাতাসে,
গন্তব্যহীন ঠিকানাবিহীন কান্নার জল ভাসে
কষ্টের গন্ধভরা নিঃসীম আকাশে,
তুমি তো ছোঁওনি ভেজা চোখ, ধরণি শিথিল হাত, শুননি হৃদপৃষ্ঠে বজ্রপাত,
আমি নিমজ্জমান মৃত্তিকা গহব্বরে অন্তহীন শূন্যতায়,
তুমি তো ছোঁওনি শূন্যতা; জ্বালনি নিয়নের আলো
দেখনি দন্ত-কামড়ে ভালোবাসার রক্তপাত,
কতশত চিরকুট ডাকহরকরার জালে বন্দিত্ব নিয়েছে মেনে
এখন তারা লুটোপুটি খায় অনন্তকালের গন্ধম গ্রাণে ভরা ভালোবাসার ডাকবাক্সে।

মন্তব্য করুন