এমপি আনারের নগ্ন ছবি কি আ.লীগ নেতা মিন্টুর ফোনে ছিল? একারণেই গ্রেপ্তার?

ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যায় জড়িত সন্দেহে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র সাইদুল করিম মিন্টুকে আটক করা হয়েছে। এমপিকন্যার করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলা হবে।
গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, এমপি হত্যার আনার হত্যার মিশন বাস্তবায়নকারীরা তার মুখে চেতনানাশক স্প্রে করার পর তার পোশাক খুলে নগ্ন ছবি তোলা হয়েছিল। যা মিন্টুর মোবাইলে পাওয়া গেছে। এছাড়া ডিবির হাতে গ্রেপ্তার চারজনের মোবাইল ফরেনসিকের জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছিল। যার অনুমতিও পাওয়া গেছে।
সীমান্তে স্বর্ণ ও পণ্য চোলাচালান ছাড়াও স্থানীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারকে হত্যা করা হতে পারে বলে সন্দেহ গোয়েন্দাদের। এ কারণে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সরকারি দলের যারা আনারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন তাদের নজরে রাখা হচ্ছে। তালিকায় কয়েকজন নেতার নাম রয়েছে। এই হত্যার রহস্য উদঘাটনে আরও একাধিক নেতাকে আটক করা হতে পারে।
এরইমধ্যে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বর্তমানে বাবু সাত দিনের রিমান্ডে আছেন।
এদিকে আনার হত্যার ঘটনায় নেপালে গ্রেপ্তার সিয়াম হোসেনকে ভারতে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দেশটিতে যেতে পারেন ডিবির তদন্ত দল। ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের অনুমতি মিললেই তারা সেখানে যাবেন। তাছাড়া আনার হত্যার প্রধান মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনের ব্যবহৃত বিলাসবহুল দুটি গাড়ি জব্দ করেছে ডিবি। যার একটি সাদা রঙের প্রাডো মডেলের গাড়ি ও অন্যটি হাইব্রিড মাইক্রোবাস।
গ্রেপ্তার অভিযুক্তদের বরাতে ডিবির গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, আনারের মুখে চেতনানাশক স্প্রে করার পর তার পোশাক খুলে নগ্ন ছবি তোলা হয়েছিলো। এসব ছবি ছাড়াও মিশন বাস্তবায়ন করে তোলা ছবিও ঘাতক শিমুল ভূঁইয়া বাবুর মোবাইলে পাঠানো হয়। ছবিগুলো জেলা আওয়ামী লীগের নেতা সাইদুল কবির মিন্টুকে দেখানোর জন্য পাঠানো হয়েছিলো। এরপরই তাকে ধানমন্ডি থেকে তাকে আটক করা হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আনার হত্যাকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বাবু। হত্যার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সবকিছুতে তার সম্পৃক্ততা মিলেছে। আনার হত্যার পর মিশন বাস্তবায়নকারীদের দুই কোটি টাকা দেন তিনি।
অন্যদিকে তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের পর ডিবির হাতে গ্রেপ্তার চারজনের মোবাইল ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষা করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। তারা নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতার গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ ডিলিট করে দিয়েছেন কি-না সেটা জানতেই এই পরীক্ষা করা হবে। ওই চারজন হলেন- ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক বাবু, চরমপন্থি নেতা আমানুল্লা সাঈদ ওরফে শিমুল ভুঁইয়া, তার ভাতিজা তানভীর ভূঁইয়া ও সিলিস্তি রহমান।
পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ ডিবি বলছে, এমপি আনারকে হত্যার পর সেই ছবি দেখিয়ে আর্থিকভাবে কেউ লাভবান হয়েছেন কি-না তা নিয়েও তদন্ত চলছে। হত্যার পর আসামিরা কার কার কাছে ছবি শেয়ার করেছেন তা জানতে অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন-অর রশীদ বলেন, ‘কিলিং মিশনে যারা অংশ নিয়েছিল তাদের প্রায় সবাই শনাক্ত। বাংলাদেশে অপহরণ মামলা হয়েছে। অন্যদিকে ভারতে হত্যা মামলা হয়েছে। দু’দেশের উদ্দেশ্য অভিন্ন। কলকাতা থেকে এমপি আনারের ছবি হোয়াটসঅ্যাপে কার সঙ্গে শেয়ার করা হয়েছে এবং এতে কোনো আর্থিক সংশ্লিষ্টতা ছিল কি-না সবকিছু নিয়ে তদন্ত চলছে।’
এদিকে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহমেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন এজন্য তাকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে ডিবি পুলিশ। বর্তমানে ডিবি হেফাজতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এবং তার কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলছে বলে সূত্র জানিয়েছে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই সাইদুল করিম মিন্টুকে আটক করা হয়।
এছাড়া দেশে গ্রেপ্তার তিনজন আসামি ও ভারতে গ্রেপ্তার একজনের সঙ্গে ডিবির তদন্ত দল কথা বলেছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মূল ঘাতক আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়াসহ অন্যরাও আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
ভারতে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হলেও সব আসামি বাংলাদেশি। হত্যার পর প্রায় সব আসামি দেশে চলে আসে জানিয়ে হারুন বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের পর দুই কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে বলে আমরা শুনেছি; সবকিছু নিয়ে তদন্ত করছি। আনার হত্যার মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীন বাংলাদেশ থেকে দিল্লির পর কাঠমান্ডু, এরপর দুবাই থেকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেছেন। তাকে আমরা ধরতে না পারলেও মোটামুটি বাকি সব আসামিদের বিষয়ে জানতে পেরেছি। আসামিদের অনেককেই গ্রেপ্তার করেছি। ভারতে জিহাদ গ্রেপ্তার হয়েছে। এছাড়া কাঠমান্ডু থেকে গ্রেপ্তার সিয়ামকে ভারতে হস্তান্তর করা হয়েছে। প্রয়োজন মনে করলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সিয়ামকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে যাব।
গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে ভারতে যান এমপি আনার। ওঠেন পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার মণ্ডলপাড়া লেনে গোপাল বিশ্বাস নামে এক বন্ধুর বাড়িতে। পরদিন চিকিৎসক দেখানোর কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন তিনি। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পাঁচ দিন পর ১৮ মে বরাহনগর থানায় আনার নিখোঁজের বিষয়ে একটি জিডি করেন বন্ধু গোপাল বিশ্বাস। এরপরও খোঁজ মেলে না তিনবারের এই সংসদ সদস্যের। ২২ মে হঠাৎ খবর ছড়ায়, কলকাতার পাশ্ববর্তী নিউটাউন এলাকায় সঞ্জীবা গার্ডেন নামের একটি আবাসিক ভবনের বিইউ ৫৬ নম্বর রুমে আনার খুন হয়েছেন। ঘরের ভেতর পাওয়া যায় রক্তের ছাপ। পরে ওই ফ্ল্যাটের স্যুয়ারেজ লাইন থেকে প্রায় পাঁচ কেজির মতো মাংসখণ্ড পাওয়া যায়, যা ডিএনএ পরীক্ষায় মানুষের বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে সেটি কার তা জানার জন্য আনারের পরিবারের সদস্যদের পশ্চিমবঙ্গে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘সংসদ সদস্য আনার চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তা আমরা কখনোই বলিনি। আমরা সবসময় বলে আসছি, এমপির ওই এলাকা সন্ত্রাসপূর্ণ একটি এলাকা। ওখানে সত্যিকারে কী হয়েছে সেটা আমাদের জানতে হবে। আমরা তদন্ত করছি, তদন্তের পরে আপনাদের সব কিছু জানাব।’
সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের মেয়ে ডরিন সন্দেহভাজনদের নাম বলেছেন। কাদের নাম বলেছেন তিনি— এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘যখন তদন্ত চলে তখন আমাদের মন্ত্রী, আইজিপি কিংবা তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষ থেকে তদন্ত না করে কোনো কিছু বলা সম্ভব নয়। তদন্ত শেষ হলে এগুলো নিয়ে কথা বলব।’
এমপি আনারের দেহাংশের সন্ধানে নেপালে গ্রেপ্তার সিয়ামকে নিয়ে বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছেন কলকাতার গোয়েন্দারা। খালের অভিযানগুলোতে সহায়তা করছে দেশটির নৌ-বাহিনীর সদস্যরা। রবিবার সকালে তাকে নিয়ে কলকাতা পুলিশের কৃষ্ণমাটির বাগজোলা খালের অভিযানে উদ্ধার হয়েছে হাড়ের কয়েকটি টুকরো। এগুলো পাঠানো হয়েছে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য। সিয়ামের দাবি, হাড়গুলো মৃত আনারের।
(ঢাকাটাইমস/১১জুন/এসএস/ইএস)

মন্তব্য করুন