মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত রোগ পার্কিনসন্স, যেসব লক্ষণে সতর্ক হবেন

মানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে ততই বাড়তে থাকে স্মৃতিভ্রম, বাত, ডায়াবেটিস ইত্যাদিসহ স্নায়বিক রোগের ঝুঁকি। সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয় স্নায়বিক রোগে। স্নায়বিক রোগ, পার্কিনসন্সের মতো মস্তিষ্ক ক্ষয়জনিত রোগ বা বিভিন্ন ধরনের ডিমেনসিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। স্নায়বিক রোগেই এখন দেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে। মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত একটি রোগ যার নাম পার্কিনসন্স। অনেক সময় চলতে গেলেই এক ধরনের লোকের দেখা পাওয়া যায় যাদের হাত অনবরত কাঁপতে থাকে। এ ধরনের ব্যক্তিই পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত। এটি বেশ পুরাতন রোগ। ১৮১৭ সালে জেমস পার্কিনসন্স ছয় ব্যক্তির এ রোগ সম্বন্ধে বর্ণনা দেন। তার নামানুসারে এ রোগের নাম রাখা হয়েছে। পার্কিনসন্স রোগ মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত রোগ, যেখানে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু অংশের কার্যক্ষমতা কমে যায়। পার্কিনসন্স কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের রোগ। ফলে মস্তিষ্কের যে অংশ শরীরের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে, সে অংশ আক্রান্ত হয়ে থাকে।
ব্রিটেনের প্রতি ৫০০ জনে একজন এ রোগে আক্রান্ত হয়। আমাদের দেশে এমন কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। অনেকে মনে করেন এ রোগ ভালো হয় না বা এ রোগের চিকিৎসা নেই। তাই তারা নিয়তি বলে মেনে নিয়ে কষ্টকর জীবনযাপন করতে থাকেন। কিন্তু এটি পুরোপুরি সত্য নয়। এ রোগের চিকিৎসা আছে। এ রোগ ওষুধে পুরোপুরি নির্মূল করা যায় না সত্য, তবে ওষুধ সেবনের মাধ্যমে এ রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব।
মস্তিস্কে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থের ঘাটতির কারণে এই রোগ দেখা দেয়। ব্রেন এর মধ্যে ছোট একটা অংশ রয়েছে, যেটিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় 'সাবস্ট্যানশিয়া নাইগ্রা' বলা হয়। এই অংশের স্নায়ু কোষ বা নিউরোন শুকিয়ে যাওয়ার কারণে ডোপামিন নামক নিউরোট্রান্সমিটার (এক ধরণের রাসায়নিক পদার্থ) নষ্ট হয়ে যায় অথবা এর ঘাটতি দেখা দেয়। স্বাভাবিক অবস্থায় মস্তিস্কে ব্যাজাল গ্যাংলিয়া নামের একটি অংশ মানুষের চলাফেরা এবং গতির সমন্বয় করে থাকে, ডোপামিনের অভাবে সেই সমন্বয়ের প্রক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায়। তখন একজন মানুষ আক্রান্ত হয় পার্কিনসন্স রোগে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পার্কিনসন্স রোগের কোনো কারণ জানা যায়নি। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী রোগ যা ওষুধ এবং জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে পরিচালনা করা যেতে পারে। আপনার যদি পার্কিনসন্সের উপসর্গ থাকে বা আপনি এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হন এবং বিকল্প চিকিৎসার বিকল্প খুঁজছেন তাহলে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
গবেষকরা কয়েকটি জেনেটিক মিউটেশন চিহ্নিত করতে পেরেছেন, যা পারকিনসন্স রোগের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এ মিউটেশন খুবই কম দেখা যায়। যাদের পরিবারে পারকিনসন্স রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি, তাদের এ ধরনের মিউটেশনের সম্ভাবনা থাকে। কিছু বিষাক্ত রাসায়নিকযুক্ত পরিবেশে থাকলে তা পারকিনসন্স রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। যারা রাসায়নিক কারখানায় কাজ করেন অথবা দূষিত পরিবেশে থাকেন তাদের পারকিনসন্স হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
পার্কিনসন্স যে কারও হতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এই রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তরুণদের খুব কমই পার্কিনসন্স হয়। এ রোগ মূলত মধ্যবয়সে অথবা বার্ধক্যে হয়ে থাকে। পার্কিনসন্স রোগের ঝুঁকি বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে।
পার্কিনসন্স রোগের লক্ষণ শুরুর দিকে খুব একটা বোঝা যায় না। ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে শুরুর দিকে এক হাতে অনিয়ন্ত্রিত কাঁপুনি দেখা যায়। পরে হাঁটাচলা, কথা বলা, ঘুমানোর ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ে। পার্কিনসন্স রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তবে ওষুধের মাধ্যমে কিছু লক্ষণ উপশমিত হতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে মস্তিষ্কে আক্রান্ত অংশে সার্জারির মাধ্যমে সামান্য উন্নতি করা সম্ভব।
পার্কিনসন্সের লক্ষণ
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লক্ষণ দেহের একদিকে শুরু হয়। পরে শরীরের দুপাশ আক্রান্ত হতে পারে।
হাত বা হাতের আঙুল অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপা পার্কিনসন্সের লক্ষণ। হাতের বৃদ্ধাঙুলির সঙ্গে তর্জনী ঘষলে এ ধরনের কাঁপুনি টের পাওয়া যায়।
সময়ের সঙ্গে পার্কিনসন্সের ফলে রোগীর নড়াচড়ার ক্ষমতা কমে যেতে পারে। ফলে অনেক সহজ কাজ করা কঠিন ও সময়সাপেক্ষ হয়ে পড়ে। যেমন- হাঁটার সময় রোগীর পদক্ষেপের দৈর্ঘ্য কমে যায়, চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে ইত্যদি।
শরীরের বিভিন্ন স্থানে মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায়। ফলে ব্যথা অনুভব হয় এবং হাঁটাচলায় সমস্যা দেখা দেয়।
পার্কিনসন্সে চলাফেরা ও বসার অঙ্গভঙ্গি পরিবর্তিত হয়। রোগী ভারসাম্যহীনতায় ভুগে থাকে।
পার্কিনসন্সের ফলে স্বাভাবিক কিছু গতিবিধি, যেমন- চোখের পাতা ফোলা, হাঁটার সময় দুহাত নাড়ানোর ক্ষমতা হ্রাস পায়।
কথা জড়িয়ে আসা, কথা বলার আগে দ্বিধায় ভোগা, কথা অনিয়ন্ত্রিতভাবে দ্রুত বলা এ রোগের লক্ষণ। এ ধরনের লক্ষণ দেখা গেলে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করুন। পার্কিনসন্সের লক্ষণ অনেক রোগের সঙ্গেই মিলে যেতে পারে। তাই ডাক্তার দেখানো দরকার। কারণ, পার্কিনসন্স রোগে মস্তিষ্কে কিছু নির্দিষ্ট স্নায়ুকোষ ক্রমে ভাঙতে থাকে অথবা মারা যায়। মস্তিষ্কের যে স্নায়ুগুলো ডোপামিন নামক তথ্যপরিবহনকারী রাসায়নিক তৈরি করে, সেগুলো নষ্ট হয়ে গেলে পার্কিনসন্সের লক্ষণগুলো দেখা দিতে শুরু করে। ডোপামিনের পরিমাণ কমে গেলে মস্তিষ্কে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়, যা পরবর্তীকালে পার্কিনসন্সে রূপ নেয়।
পার্কিনসন্সের ফলে বেশ কিছু অতিরিক্ত জটিলতা দেখা যায়। যেমন- চিন্তা করার শক্তি কমে যায়। এছাড়া কিছু আবেগের পরিবর্তন দেখা দিতে পারে। যেমন- ভয়, উদ্বিগ্নতা, কোনো কাজ করার প্রেরণা না পাওয়া ইত্যাদি। খাদ্য ভক্ষণেও সমস্যা দেখা দিয়ে থাকে। ঘুমানোর সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন- ঘুমের মধ্যে বারবার জেগে ওঠা, খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যাওয়া অথবা দিনের বেলা ঘুমিয়ে পড়া ইত্যাদি। মূত্রনিয়ন্ত্রণে সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, রক্তচাপ, ক্লান্তিভাব দেখা দিতে পারে।
পার্কিনসন্স রোগ নির্ণয়ে কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই। নিউরোলজিস্ট যিনি স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ, তিনি রোগীর পূর্ববর্তী রোগ ও চিকিৎসা, রোগীর লক্ষণ, নিউরোলজিক্যাল পরীক্ষা ও শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে এই রোগ নির্ণয় করে থাকেন। প্রয়োজন অনুসারে ডাক্তার ডোপামিন ট্রান্সপোর্টার টেস্ট করার জন্য বলতে পারেন। এছাড়া এমআরআই, সিটি স্ক্যানের পাশাপাশি রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। পার্কিনসন্স রোগ নির্ণয়ে সময় লাগতে পারে। তাই ডাক্তার নিয়মিত ফলোআপ করার জন্য বলতে পারেন।
পার্কিনসন্স রোগ সম্পূর্ণ ভালো হওয়া সম্ভব না হলেও নিউরোলজিস্ট, ফিজিওথেরাপি, স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা এবং পরিবারের সহায়তায় রোগীর জীবনে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব। তাই এসব বিষয়গুলোর ব্যাপারে প্রত্যেক মানুষকে সচেতন হতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীর নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে। তবেই রোগীর পক্ষে ভালো থাকা সম্ভব।
চিকিৎসকের মতে, পার্কিনসন্সের জটিলতাগুলো পূর্বাভাস এবং জীবনযাত্রার মানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা, উদাহরণস্বরূপ, বিপজ্জনক পতন অনুভব করতে পারে এবং তাদের পা এবং ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধতে পারে। এই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো মারাত্মক হতে পারে। একটি সঠিক চিকিৎসা পরিকল্পনা আয়ু বাড়ায় এবং পূর্বাভাস উন্নত করে।
পার্কিনসন্স রোগকে ধীর করা যায় না, তবে যতটা সম্ভব যতটা সম্ভব আরামদায়কভাবে বেঁচে থাকার জন্য আপনি চ্যালেঞ্জ এবং সমস্যাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চেষ্টা করতে পারেন।
(ঢাকাটাইমস/৯ জুলাই/আরজেড)

মন্তব্য করুন