যেকোনো সময় শিবলী রুবাইয়াতের পদত্যাগ, বসছেন কে?

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর প্রশাসন ও বিভিন্ন দপ্তর-প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিদের পদত্যাগের হিড়িক পড়েছে। কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ বা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীন চাপের মুখে পদ ছাড়ছেন। গত বৃহস্পতিবার নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে তার কাজ শুরু করেছে। নিজেদের কাজের স্বাচ্ছন্দের জন্য তারা শিগগিরই আগের সরকারের প্রশাসন রদবদল করে ঢেলে সাজাবেন বলে জানা যাচ্ছে।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে পুজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দিকেও সবার নজর। গত এপ্রিলে দ্বিতীয়বারের মতো চার বছরের জন্য নিয়োগ পাওয়া চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম কখন পদত্যাগ করছেন? নাকি তাকে সরকার সরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন তিনি?
২০২০ সাল থেকে বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। তার প্রথম মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে গত ১৭ মে থেকে পরবর্তী চার বছরের জন্য আরও এক মেয়াদে তাকে বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। পুঁজিবাজার উন্নয়নে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নিয়োগ শেখ হাসিনা সরকারের পছন্দ ছিল বলে তখন প্রচার ছিল।
বিএসইসির বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ করে জানা গেছে, শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম এখনই পদত্যাগের কথা ভাবছেন না। তিনি স্বাভাবিক দাপ্তরিক কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বৃহস্পতিবারও পুঁজিবাজারের সার্কিট ব্রেকার ও ফ্লোর প্রাইস সংক্রান্ত দুটি আদেশে সই করেন তিনি।
তাকে সরিয়ে দিতে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দপ্তরের অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন তৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু কোথা থেকে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ হবে, এ নিয়ে মতভেদ আছে অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাধারণ সদস্যদের মধ্যে।
কমিটির সদস্যরা চাইছেন বর্তমান কমিশনের কোনো সদস্যকে চেয়ারম্যান করা হোক। আর অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সদস্যরা চান কমিশনের বাইরে থেকে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ পাক। তাদের মতে, বর্তমান কমিশনের চার সদস্যের তিনজনই আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ বলে চিহ্নিত। তারা হলেন শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ, ড. রুমানা ইসলাম ও ড. মো. মহসীন।
অন্যজন চৌধুরী এ টি এম তরিকুজ্জামানের চাকরিজীবন শুরু এই বিএসইসিতেই। ৩০ বছরের চাকরিজীবনে সহকারী পরিচালক থেকে ধাপে ধাপে কমিশনের সদস্য হয়েছেন তিনি। তার বিষয়ে কমিশনে ও পুঁজিবাজারে সুনাম আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের অনুসারী না হওয়াটা তার কমিশনের চেয়ারম্যান হওয়ার পথে বাধা ছিল বলে জানা গেছে। এখন আর সেই বাধা নেই।
চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াতের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কমিশনার এ টি এম তারিকুজ্জামান সংবাদমাধ্যমকে জানান, দাপ্তরিক সফর শেষে গত রোববার কানাডা থেকে দেশে ফেরেন চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত ও কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন। পরের দুই দিন অফিসে আসেননি তিনি।
অফিস না করলেও গত মঙ্গলবার হোয়াটসঅ্যাপে শিবলী রুবাইয়াত তার আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের নানা নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। গত বুধবার নির্বাহী পরিচালক সাইফুর রহমানকে ফোন করে জানতে চান, তিনি অফিসে আসবেন কি না বা আসা উচিত হবে কি না। পরিস্থিতি বিবেচনায় অফিসে না আসতে অনুরোধ করেন সাইফুর রহমান- এমনটাই জানা গেছে।
সম্প্রতি নিয়োগ পাওয়া কমিশনার মহসিন চৌধুরীও অফিসে আসেননি। অন্য কমিশনার রুমানা ইসলাম মঙ্গলবার অফিস না করলেও বুধবার অফিস করেন।
একটি সূত্রে জানা গেছে, শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম চান আর না চান, তাকে বিএসইসি ছাড়তে হবে। নিজে থেকে পদত্যাগ না করলেও সরতে হবে তাকে। সে ক্ষেত্রে কে হচ্ছেন পরবর্তী চেয়ারম্যান?
পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, যোগ্যতা ও দক্ষতার বিচারে কমিশনার এ টি এম তারিকুজ্জামানের চেয়ারম্যান হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কমিশনের অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনও তাকে চায়।
চেয়ারম্যান হওয়ার তালিকায় আসছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্সের শিক্ষক সালাউদ্দিন আহমেদ খানের নাম। একসময় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান নির্বাহী (সিও) ছিলেন তিনি। পরে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরত পাঠানো হয়। বৈরী সরকারের টানাহেঁচড়ায় বিরক্ত হয়ে কানাডা পাড়ি জমান বিএনপি ঘরানার এই শিক্ষক।
পুঁজিবাজারে সংশ্লিষ্ট আরও একজন চেয়ারম্যান হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন বলে জানা যাচ্ছে। আইডিএলসির সাবেক চেয়ারম্যান আরিফ খান। তিনি বিএসইসির বর্তমান কমিশনের সদস্য ছিলেন। কিন্তু শিবলী রুবাইয়াতের সঙ্গে পেরে না উঠে কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। বর্তমানে তিনি শান্তা ক্যাপিটাল পরিচালনায় রয়েছেন।
আগে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন কেউ আসতে পারেন এই পদে- এমনও শোনা যাচ্ছে । তা না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষকদের মধ্য থেকে কেউ নিয়োগ পেতে পারেন।
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের আগে বিএসইসির চেয়ারম্যান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর শিক্ষক খায়রুল হক। তিনি টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে ছিলেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তার আগে আইসিবির এমডি জিয়াউল হক বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন।
তাদের মধ্য থেকেও কেউ একজন চেয়ারম্যান হিসেবে ফিরে আসতে পারেন। এ ক্ষেত্রে জিয়াউল হকের নাম শোনা যাচ্ছে বেশি।
নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত এবং বাজার কারসাজি চক্রের সঙ্গে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের জড়িত থাকার নানা অভিযোগ বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে এসেছে। এ নিয়ে তার পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ করেছেন সাধারণ বিনিয়োগকারী।
২০২০ সালে তার নিয়োগের পর বাজার হু হু করে বাড়তে থাকে। চার হাজারের ঘর থেকে সূচক কয়েক মাসের মধ্যে সাত হাজার ছাড়িয়ে যায়। কোনো কোনো শেয়ারের মূল্য ১০ গুণ-২০ গুণ বাড়ার ঘটনাও ঘটে অনেক। সেই বাজারে পরবর্তী সময়ে ধস নামতে নামতে সূচক নেমে আসে পাঁচ হাজারে।
এদিকে বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াতের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কয়েক লাখ ডলার জমা হওয়ার এক খবর প্রকাশিত হয়েছিল একটি পত্রিকায়। গত বছরের ২৩ জুলাই প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, মিলিয়ন ডলার জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত একটি ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ পেয়েছেন তিনি।
সংবাদে বলা হয়, …মোনার্ক হোল্ডিংস আইএনসি নামের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি কোম্পানির দুটি ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ৮ লাখ ডলার শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে এবং আরেকটি অংশ একটি বাংলাদেশি কোম্পানির ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হয়, যে কোম্পানির পেছনেও তিনিই আছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ২০২০ সালের জুন-জুলাইয়ের মধ্যে ওই কোম্পানির ব্যাংক হিসাব থেকে ২ লাখ ৭৮ হাজার ডলার শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের ব্যক্তিগত হিসাবে স্থানান্তর করা হয়।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক শিবলী ওই পত্রিকাকে বলেন, তিনি একটি বৈধ ইজারা চুক্তির অধীনে অগ্রিম ভাড়া, নিরাপত্তা জামানত এবং অগ্রিম নির্মাণ ব্যয় বাবদ তার ব্যাংক হিসাবে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৯২৪ ডলার নিয়েছেন। তার ভাষ্য, ‘আমি বৈধ চ্যানেলে এই অর্থ পেয়েছি। আমার খারাপ উদ্দেশ্য থাকলে আমি কেন এই অর্থ দেশে আনতাম এবং সেটাও বৈধ চ্যানেলে?... জটিলতা আছে জেনে আমি আদালতে টাকা জমা দিয়েছি। আদালতই সিদ্ধান্ত নেবে এই অর্থ কার কাছে যাবে।'
(ঢাকাটাইমস/১০আগস্ট/মোআ)

মন্তব্য করুন