ফেনীর স্কুল-কলেজে ১৫ বছর যেভাবে হরিলুট-অনিয়মের মচ্ছব চলে

ফেনী প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০:০৫
অ- অ+

ফেনীর সব কটি উপজেলায় আন্ডারগ্রাউন্ডে ওপেন সিন্ডিকেটে চলত নিয়োগ বাণিজ্য। পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, অফিস সহকারী, কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর, লাইব্রেরিয়ান, পিয়ন, আয়াসহ অন্যান্য পদে ঘুষ দিলেই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হতেন নির্ধারিত ব্যক্তি।

মাধ্যমিকে প্রধান শিক্ষক পদে ১০-১৫ লাখ, সহকারী প্রধান শিক্ষক -১০ লাখ, অফিস সহকারী তিন লাখ, পিয়ন পদে দেড় লাখ টাকার ঘুষ বাণিজ্যের প্রচার আছে প্রাথমিকে পিয়ন, কলেজ পর্যায়ে বিভিন্ন পদে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ চলেছে।

টাকা দিলে মাধ্যমিক স্কুলে নিয়োগ চূড়ান্ত করত সিন্ডিকেট দলের সদস্যরা। বিগত ১৫ বছরে দাগনভূঞার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ভোটবিহীন ফেনী স্টাইল পরিচালনা কমিটি নির্বাচনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছিল রমরমা নিয়োগ বাণিজ্য। জনশ্রুতি আছে নিয়োগের রিমোট কন্ট্রোল ছিল জেলার আলোচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর হাতে।

দাগনভূঞার লেনদেনের ক্যাশিয়ার ছিলেন উপজেলার আওয়ামী লীগ জনপ্রতিনিধিরা। যুবলীগ সভাপতি দিদারুল কবির রতনের হাত হয়ে চার স্তরের সিন্ডিকেট পরিচালনা হতো। উপজেলা মাধ্যমিক অফিস, উপজেলা শিক্ষক সমিতি, ডিজি প্রতিনিধি ফেনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুব্রত নাথ, পুস্তক ব্যবসায়ী বিমল পরিচালনা কমিটি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুণগত লেখাপড়ার চেয়ে দলীয় ঘরানার বিরতিহীন সিলেক্টেড পরিচালনা কমিটির সদস্যরাই ছিলেন সর্বেসর্বা। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হাই স্কুল মাদ্রাসার সভাপতি পদে বিগত ১৬ বছর বারবার থাকার রেকর্ড রচনা করেছেন।

জানা যায়, দাগনভূঞা উপজেলার আতাতুর্ক উচ্চ বিদ্যালয়ের বিদায়ী প্রধান শিক্ষক মোবারক হোসেন, রামনগর কেএমসি (.) উচ্চ বিদ্যালয় খিজির আহম্মদ পলাশ, সিন্দুরপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বেলায়েত হোসেন, করিম উল্যাহ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাছির উদ্দিন, দাগনভূঞা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সহকারী প্রধান শিক্ষক, জায়লস্কর উচ্চ বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক বেলাল মিয়াজী, ফাজিলের ঘাট উচ্চ বিদ্যালয়, শান্তিরহাট জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়, হাজী শফি উল্যাহ জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়, প্রতাপপুর উচ্চ বিদ্যালয়েরর সহকারী প্রধান শিক্ষক, বাঘডুবি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান গোপাল চন্দ্র সহ অসংখ্য পদে টাকার লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে।

দাগনভুঞা উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন ১টি পৌরসভায় ২৮টি মাধ্যমিক, ২৩টি মাদ্রাসা, ৩টি কলেজ, ২টি স্কুল এন্ড কলেজ ১৫৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতিসহ সব সদস্য আওয়ামী ঘরানার ছিল। প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ স্টিয়ারিং ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেধাহীন চাটুকার, আওয়ামী লীগ পদবিধারী সমর্থিত অধিকাংশ প্রধান শিক্ষকেরা। এমনকি জনবল কাঠামো ছাড়াও গেস্ট টিচার বা কর্মচারী নিয়োগেও দলীয়করণ অর্থ নেওয়া হয়েছে।

অনিয়মে ভরপুর এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কমিটির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও কোনো ফল মেলেনি। উপরন্তু অভিযোগকারীর ওপর অত্যাচার, নির্যাতন হেনস্তার খড়গ নেমে আসারও অভিযোগ রয়েছে।

মুষ্টিমেয় কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডামি অভিভাবক সদস্য নির্বাচন মঞ্চস্থ করেছে বছরের পর বছর। এমনও ঘটেছে শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে প্রতিবাদী শিক্ষকের মনোনয়নপত্র ছিঁড়ে ফেলে জমা দেননি প্রধান শিক্ষক। মনোনয়নপত্র জমাদানকারী শিক্ষক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তারই স্বাক্ষরে নিয়োগ পাওয়া সেই প্রধান শিক্ষক নিয়োগকারী শিক্ষকের শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের দাখিলকৃত মনোনয়নপত্র ছুড়ে ফেলেন।

প্রধান শিক্ষকের ছত্রছায়ায় স্বয়ং আওয়ামী লীগ নেতা চর দখলের মতো মার্কেট দখল করে নেয়ারও ঘটনা ঘটেছে। অনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করেছেন উপজেলার সুজাতপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। বিষয়ে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে একজন অভিভাবক অভিযোগ করেছিলেন। শিক্ষা বোর্ড তদন্ত করে প্রতিবেদন চেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রতিবেদন পাঠানোর চিঠি দেয়। কিন্তু ক্ষমতার দাপটের কাছে প্রতিবেদন শিক্ষকের অনুকলে দেওয়া হয়েছে।

উপজেলার মকবুল আহমদ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বিদ্যালয়ের বিভিন্ন খাতের অর্থ আত্মসাৎ, কট্টর আওয়ামী ঘরানার হওয়ায় তার অশিক্ষকসুলভ আচরণ ছিল প্রতিষ্ঠানের জন্য চাপিয়ে দেয়া অঘোষিত আইন। ফেনীর হাজারী রোডে তার পাঁচতলা বাড়ি স্কুলের টাকায় করা বলে অভিযোগ আছে। শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য, জেএসসি এসএসসি ফরম ফিলাপ তার বাসায় করে অর্থ হাতিয়ে নেয়া, শিক্ষক সমবায় সমিতির পদ ভাগিয়ে নেয়া, বিআরডিবির চেয়ারম্যান পদ নিয়ে মামলা মোকদ্দমায় সদা ব্যস্ত থাকতেন বলে এলাকায় তাকে নিয়ে বহুবার বিক্ষোভ হয়েছে। এখন তাকে আর দেখা যাচ্ছে না বিদ্যালয়ে।

উপজেলার জায়লস্কর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বেলাল হোসেন মিয়াজী আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীর নেতার নিয়োগের কারণে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছেন। এখন তিনি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে পড়ে বিদ্যালয় আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। তাতে প্রশাসনিক স্থবিরতা দেখা দিয়েছে বলে জানান একজন শিক্ষক।

উপজেলার সিন্দুরপুর ইউনিয়নের দরবেশের হাট ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ রাজাপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মমিনুল হক নির্যাতিত বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে পদত্যাগ করেন।

সদ্য বদলিকৃত দাগনভূঞা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আজিজুল হকের বিরুদ্ধে শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যে সম্পৃক্তার অভিযোগ রয়েছে। উপজেলার বাংলাদেশ অরফানস সেন্টার স্কুল এমপিওভুক্তিতে অশিক্ষকদের নিয়োগ দিয়েছেন অর্থের বিনিময়ে প্রভাবশালীদের তদবিরে। নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হওয়ায় প্রধান শিক্ষকসহ অবৈধ শিক্ষক নিয়োগ বাতিল করতে বাধ্য হন।

অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও অতীতের অপকর্মের কারণে বিদ্যমান উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে স্কুল মাদ্রাসার প্রধানেরা কেউ কেউ গা ঢাকা দিয়েছেন। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর অতীত অপকর্মের জবাবদিহির ভয়ে এখন কাজে আসতে ভয় পাচ্ছেন কেউ কেউ।

টানা ১৫ বছর মনোনীত পরিচালনা কমিটির নিয়ন্ত্রণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়ম, অর্থ আত্মসাৎ ক্ষমতার অপব্যবহারের তদন্ত চায় স্থানীয় অভিভাবক সুশীল সমাজ। পরিচালনা কমিটি বিলুপ্ত করে এডহক কমিটি গঠন করে শিক্ষার পরিবেশ পুনরুদ্ধারে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি সোচ্চার।

(ঢাকাটাইমস/১৫সেপ্টেম্বর/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
শেরাটন-এ সি ফুড ব্যুফেতে বিকাশ পেমেন্টে ‘বাই ওয়ান গেট টু’ অফার
জনতা ব্যাংকের ১৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত
এসডিজি ব্র্যান্ড চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড ২০২৫ পেলো ওয়ালটন
বগুড়ায় বাড়ির সামনে পড়ে ছিল যুবকের রক্তাক্ত লাশ  
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা