নারায়ণগঞ্জে ওসমান অনুসারীদের আধিপত্যে ধস, নিয়ন্ত্রণে বিএনপি নেতারা

মো. আকাশ, সিদ্ধিরগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ)
| আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৮:৩৬ | প্রকাশিত : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৮:১৫

আওয়ামী লীগ শূন্য নারায়ণগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জে শামীম ওসমান অনুসারীদের একক আধিপত্য এখন আর নেই। নেতৃত্বের আসনে এখন বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা। ব্যবসা বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণে এখন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা। প্রভাব খাটিয়ে অনেক কারখানার ব্যবসা দখল করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে ১৭ বছর ক্ষমতার বাহিরে থাকা বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের এসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে।

গত আগস্ট ছাত্র-জনতার তোপের মুখে পড়ে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করার পর ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে তারা জোর খাটাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়ার পর আত্মগোপনে চলে গেছেন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। পালিয়েছে তার অনুসারীরাও। তবে ফিরে এসেছে জামায়াত-বিএনপির ছোট, বড় মাঝারি সারির স্থানীয় নেতারা। যারা হাসিনার শাসনামলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী পুলিশের করা মামলার কারণে এলাকাছাড়া ছিলেন।

খোঁজে নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে স্থানীয় বিএনপি জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা সিদ্ধিরগঞ্জে বসবাস করতে পারলেও ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারেনি নির্বিঘ্নে। তখন আদমজী ইপিজেডে একক আধিপত্য ছিল নারায়ণগঞ্জ- আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান অনুসারীদের। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর পাল্টে যায় সেই পরিস্থিতি। ইপিজেড এলাকার জুট ব্যবসাসহ বিভিন্ন ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় বিএনপি সহযোগী সংগঠনের নেতারা। আর ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে শিল্প নগরীতে বিএনপি সহযোগী সংগঠনের লোকজনকে বিভিন্ন সময় মহড়া দিতেও দেখা গেছে।

স্থানীয়দের মতে, আদমজী ইপিজেড দেশের অর্থনীতিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিয়ম অনুযায়ী লাইসেন্স থাকলে যেকোনো ব্যক্তি এখানে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পারবেন। কিন্তু শামীম ওসমান অনুসারীরাদের কারণে বঞ্চিত ছিলেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। ওই সময় সিদ্ধিরগঞ্জের আওয়ামী লীগ যুবলীগসহ সকল সহযোগী সংগঠনের কয়েকজন নেতার নিয়ন্ত্রণে ছিল ইপিজেড এলাকা।

তবে সরকার পতনের পর বিএনপির নেতাকর্মীরা শিল্পখাতের এই স্থানটি দখলে নিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের মতে, লাউ আর কদু একই কথা।

এদিকে ইপিজেড এলাকাসহ পুরো সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিতে বিবাদে জড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে বিএনপি সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের। ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে কখনো কখনো সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ছেন তারা। আওয়ামী লীগের লোকজন না থাকায় নিজ দলীয়দের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিচ্ছেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আদমজী ইপিজেডের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, সরকার পতনের পর বেশিরভাগ ফ্যাক্টরির জুটসহ অন্যান্য মালামাল বের করা যাচ্ছিল না। প্রথমদিকে দুই তিনটি ফ্যাক্টরির সাবেক ব্যবসায়ীরা মালামাল বের করার চেষ্টা করলে কাস্টমস আর বেপজার অফিসের গেট পার হতেই সেই মালামাল আটকে দেন বিএনপি পরিচয়ধারী লোকজন। তাই আতঙ্কে রয়েছে পূর্বের ব্যবসায়ীরা।

ভোগান্তিতে পড়েছেন কোম্পানিগুলোও। মালামাল না নেওয়ায় বেকায়দায় রয়েছেন তারা।

আদমজী ইপিজেডের কয়েকটি কারখানার কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করার পর নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা কথা বলেছেন ঢাকা টাইমসের সঙ্গে। বলেন, প্রতিদিন বিভিন্ন লোকজন আসে। তারা বিএনপির জেলা-মহানগর এবং থানা পর্যায়ের সিনিয়র নেতাদের পরিচয় দিয়ে ব্যবসা চান। ইতোমধ্যে ১০-১২টি ফ্যাক্টরিতে নতুন করে চুক্তিনামা করেছেন বিএনপির নেতারা।

সূত্রমতে, এদের অনেকের নিজের নামে কোনো লাইসেন্স নেই। তারা তারা আওয়ামী লীগ সমর্থিত কিছুসংখ্যক ব্যক্তির লাইসেন্সের মাধ্যমে গোপনে ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন।

আধিপত্য বিস্তারে বিএনপির প্রতিপক্ষ বিএনপি:

স্থানীয় আধিপত্য বিস্তারে বিএনপির প্রতিপক্ষ এখন বিএনপি। এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে সংঘর্ষ, হামলা ভাংচুরে লিপ্ত হচ্ছেন তারা।

গত শুক্রবার ( সেপ্টেম্বর) সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদকের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ তুলে মানববন্ধন করার সময় ফের হামলা চালানো হয়। এতে অন্তত জন আহত হয়েছিল। এরপর গেলো সোমবার ( সেপ্টেম্বর) নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নং ওয়ার্ড এলাকায় বিএনপি এবং ছাত্রদল নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে উভয় পক্ষের অন্তত জন আহত হন।

আদমজী ইপিজেড এর অনন্ত এফারেন্স গার্মেন্টসের এক কর্মকর্তা জানান, ‘আমাদের ফ্যাক্টরির জুট বহুদিন যাবত দ্বিতীয় পক্ষে নিচ্ছিলেন না। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলতেন বিএনপির লোকজন মাল আটকে নিয়ে যাবে এমন ভয়ে মাল নিতে ইচ্ছুক না তারা। কিন্তু সেপ্টেম্বর ছাত্রদলের এক নেতার লোকজন কোম্পানির সঙ্গে কথাবার্তা বলে জুট বের করেছেন।

মারোশিয়া নামক ফ্যাক্টরির এক সিকিউরিটি অফিসার বলেছেন, ‘আমাদের ফ্যাক্টরিতে অন্তত ১০-১২টি গ্রুপ এসেছে। সবাই নিজেদের বিএনপির নেতাকর্মী পরিচয় দিচ্ছিল। একপর্যায়ে আমাদের অফিসের স্যারদের সঙ্গে একটি গ্রুপের ডিড হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইপিজেড এলাকার আরও একটি কারখানার সিকিউরিটি ইনচার্জ বলেছেন, প্রতিদিন অন্তত -৭টি গ্রুপ তাদের ওইখানে যান। সবাই নিজেদের বিএনপি দলীয় নেতাকর্মী পরিচয় দেন। অনেকে আবার বিপরীত গ্রুপকে দেখে নেওয়ার হুমকিও দিয়ে থাকেন। এই কর্মকর্তার ভাষ্য, আগের থেকে এখন বেশি বিশৃঙ্খলার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

সাধারণ মানুষের মতে, শুধু দল পরিবর্তন হয়েছে, জুলুম বন্ধ হয়নি। থেকে মুক্তির জন্য অন্তবর্তীকালীন সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।

ব্যবসায় জবরদখল করা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুর রহমান সাগর জানান, ইপিজেড অঞ্চলে ব্যবসায় জবরদখলের সুযোগ নেই। সেখানে নিয়ম অনুযায়ী ব্যবসা করা লাগে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী কিছুসংখ্যক ব্যক্তিরা এইসব রিউমার ছড়িয়ে থাকেন। মানুষ আমার নামেও বহু রিউমার ছড়াতে শুনেছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে ইপিজেডে জবরদখলের কোনো সুযোগই নেই। সেখানে ব্যবসা করার জন্যে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে ব্যবসা নেওয়া লাগে। আমরাও সেভাবে চেষ্টা করি।

আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগসাজশে ব্যবসা করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদায়ী সরকারের লোকজনের সঙ্গে ব্যবসা করার প্রশ্নই উঠে না। আর আমি যেমনটা জানি আওয়ামী লীগ দলীয় কোনো লাইসেন্সে সেখানে ব্যবসা হয় না। সেক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে কারা ব্যবসা করবে। এটাও আমার জানামতে মিথ্যা। ছাত্রদলের সঙ্গে নং ওয়ার্ডে মারামারি ঘটনার বিষয়ে বলে, সেখানে ওই এলাকার লোকজন ঝামেলা করছিল সেখানে ছাত্রদলের কিছু লোকজন থাকায় পরে আমি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। সেখানে পৌঁছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করি।

বিষয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমাদের থানা বিএনপির কোনো লোকজন জবরদখল কিংবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেনি। আমরা দেশে শান্তি এবং শৃঙ্খলা ফিরে আনার লক্ষ্যে দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে জেল জুলুম উপেক্ষা করে আন্দোলন করে সফলতা পেয়েছি। ইপিজেড কেন্দ্রিক কোনো অভিযোগ থানা বিএনপির বিরুদ্ধে নেই।

বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগর যুবদলের সদস্য সচিব শাহেদ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের যুবদলের কোনো নেতাকর্মী বিশৃঙ্খলা কিংবা জোরপূর্বক ইপিজেডে ব্যবসা দখলের চেষ্টা করেনি। এটা আমি নিশ্চিত করে বলছি। ব্যবসা হয় ডিডের মাধ্যমে, আমরা সেভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইপিজেডে মূলত বিশৃঙ্খলা করছে সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকারই কিছু সুবিধাবাদী লোকজন। তারা দলের বদনামে নেমেছে। আমার ব্যবসাকেও ছাড় দেয়নি তারা। আমি নিজে একটি ফ্যাক্টরিতে গিয়ে ডিড করে আসছি। সেই ফ্যাক্টরির ভেতর গিয়ে দখলদাররা থ্রেড করে আসছে যে আমার মাল তারা আটকে দিবে।

বিএনপির নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগ দলীয় লোকজনের সঙ্গে মিলেমিশে ব্যবসা পরিচালনা করছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলে, ‘স্বৈরাচার দলের লোকজনের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীরা ব্যবসা করার প্রশ্নই আসে না। এমন কোনো কথা আমি শুনি নাই।

ইপিজেডের ভেতরে বিশৃঙ্খলা আর জোরপূর্বক ব্যবসা দখলের অভিযোগের সত্যতা জানতে চাইলে আদমজী ইপিজেড (বেপজার) জিএম মাহবুবআহমেদ সিদ্দিক ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমরা এখনো কোনো বিশৃঙ্খলা দেখতে পাইনি। এখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিজিবি এবং র‍্যাব উপস্থিত থাকে। কাউকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দেখা যায়নি। আর ব্যবসা দেওয়ার বিষয়টা ইনভেস্টররা বুঝে, তারা কাকে দিবে সেটা আসলে তাদের বিষয়। কোনো কোম্পানি এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে অভিযোগ দেননি জোরপূর্বক ব্যবসা নেওয়ার।

(ঢাকাটাইমস/১৯সেপ্টেম্বর/পিএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

সারাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :