সড়ক নিরাপত্তায় সংস্কার কেন অপরিহার্য!

বাংলাদেশে মৃত্যু ও আহত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ রোডক্র্যাশ বা সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর ফলে দেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর একটি বিশাল বোঝা ও চাপ সৃষ্টি হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে প্রতি লাখে রোডক্র্যাশে মৃত্যু ছিল ১৫.৩ এবং ২০২১ সালে এই মৃত্যু হার বেড়ে হয় প্রতি লাখে ১৮.৬ জনের মতো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে নেপালের পর (২৫%) বাংলাদেশে রোডক্র্যাশের সংখ্যা বেড়েছে ২৩% যা এই অঞ্চলের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বিদ্যমান এ বাস্তবতায় অগামী ২২ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে আমরা জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছি।
সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ ও তার প্রেক্ষাপট
২০১৮ সালে ঢাকার শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ২ শিক্ষার্থী নিহত এবং ১২ জন গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনার প্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে Motor Vehicles Ordinance, 1983 রহিত করার মাধ্যমে ২০১৬ সালে সড়ক সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের মাধ্যমে প্রস্তুতকৃত ‘সড়ক পরিবহন ও সড়ক নিরাপত্তা আইন’ নামক খসড়া আইনটিকে ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসের ৮ তারিখে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ নামে প্রণয়ন করা হয়। তখন সড়ক নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট অংশসমূহ বাদ দিয়ে ২০১৮ সালে আইনটি প্রণয়ন করা হলেও বিধিমালা জারি না হওয়ায় দীর্ঘদিন আইনটির প্রয়োগ বন্ধ ছিল।
পরবর্তীতে ২০২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২’ জারি করা হয়। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ৩.৬ এবং জাতিসংঘের সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক গ্লোবাল প্ল্যানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য
প্রতিরোধযোগ্য রোডক্র্যাশে মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে বাংলাদেশকে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এর জন্য দরকার উপযুক্ত শক্তিশালী নীতি ও আইনি কাঠামো। বর্তমানে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ ও ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২’ বলবৎ থাকলেও সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার তেমন কোনো উন্নয়ন সাধিত হয়নি। তাই সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি পৃথক ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়নের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হলে মার্চ-২০২৪ মাসে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ কর্তৃক একটি ‘খসড়া আইন প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করা হয় ও কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়।
৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে পটপরিবর্তনের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুপস্থিতিতে সড়কের শৃঙ্খলা একেবারে ভেঙ্গে পড়ে। তখন সড়কে নিরাপত্তা ফেরাতে ছাত্র ও তরুণদের সড়ক নিরাপত্তায় প্রশংসনীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখা যায়, যদিও সড়কে শৃঙ্খলা এখনো পুরোপুরি ফিরে আসেনি। অপরদিকে সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নে গঠিত কমিটির কার্যক্রমও স্থবির হয়ে পড়ে। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত উক্ত কমিটিকে সক্রিয় করে দ্রুত ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়নে সচেষ্ট হওয়া।
‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ ও ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২’ এর সীমাবদ্ধতা
‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ এবং ‘সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২’ মূলত মোটরযান ও সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা সংক্রান্ত। এই আইন ও বিধিমালা সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে যথেষ্ট নয়। কারণ জাতিসংঘের সেকেন্ড ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেইফটি ২০২১-২০৩০-এ বর্ণিত ৫টি পিলার বা স্তম্ভগুলো (১. বহুমুখী যানবাহন ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা– Multimodal transport and land‐use planning ২. নিরাপদ যানবাহন– safe vehicle; ৩. নিরাপদ সড়ক অবকাঠামো– safe road infrastructure; ৪. নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী– safe road user; ও ৫. রোডক্র্যাশ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা– post crash response) অর্থাৎ সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য প্রয়োজনীয় ও সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো বর্তমান আইন এবং বিধিমালাতে অনুপস্থিত, যা সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অন্তরায়।
বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিদ্যমান আইনের সংস্কার বা পৃথক ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ কেন প্রয়োজন?
–‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ মূলত মোটরযান ও সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিধিবিধানের ওপর নিবদ্ধ। এতে বিশ্বব্যাপী প্রচলিত safe system approach -এর ওপর ভিত্তি করে সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
এছাড়া প্রধান প্রধান আচরণগত ঝুঁকি যেমন- অনিয়ন্ত্রিত গতিতে গাড়ি চালানো, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো, মানসম্মত হেলমেট পরিধান করা, সিটবেল্ট পরিধান করা এবং শিশুর উপযুক্ত সুরক্ষিত আসন ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে প্রয়োজনীয় অনুশাসন এতে সংক্ষিপ্তভাবে থাকলেও বিস্তারিতভাবে উল্লেখ নেই।
–দ্বিতীয়ত: সড়ক নিরাপত্তার জন্য জাতিসংঘের গ্লোবাল প্ল্যান ফর ডিকেড অব অ্যাকশন সুপারিশকৃত পাঁচটি পিলার (মাল্টি-মোডাল বা বহুমাত্রিক পরিবহন ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, নিরাপদ সড়ক অবকাঠামো, নিরাপদ মোটরযান, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী ও দুর্ঘটনা-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা) বাংলাদেশের কোনো আইনে অন্তর্ভুক্ত হয়নি বা স্থান পায়নি।
–তৃতীয়ত: জাতীয় নিরাপদ সড়ক কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা ২০২১-২৪ (National Road Safety Strategic Action Plan 2021-24) অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে রোডক্র্যাশে মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা অর্ধেক করার বিশ্ব প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকার অঙ্গীকারাবদ্ধ যদিও তা বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।
–চতুর্থত: ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ তে সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ যথাÑ পথচারী, সাইকেলচালক, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় বিধিবিধান অনুপস্থিত ।
–পঞ্চমত: দুর্ঘটনা-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা বা রোডক্র্যাশের পর হতাহতদের দ্রুত উদ্ধার ও চিকিৎসার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা বিদ্যমান সড়ক পরিবহন আইনে নেই। পাশাপাশি Good Samaritan Law বা দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে সড়কে জীবন বাঁচাতে সুরক্ষা সংক্রান্ত আইনি বিধানও বর্তমান আইনে অনুপস্থিত।
–ষষ্ঠত: বর্তমান আইনি কাঠামোতে দেশে রোডক্রাশে আহত ও মৃত্যুর সঠিক তথ্য সংরক্ষণ ও প্রদান সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় পদ্ধতি বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। তাই রোডক্র্যাশের কারণে মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা বা তথ্য সঠিকভাবে নির্ধারণ করার জন্য কেন্দ্রীয় পর্যায়ে একটি পদ্ধতি আইনে থাকা প্রয়োজন।
–এমতাবস্থায় সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য কার্যকর আইনি ব্যবস্থার প্রয়োজন যা শুধুমাত্র Globally practiced‐ ‘safe system approach’ বা ‘নিরাপদ পদ্ধতি অন্তর্ভুক্তি’র মাধ্যমে একটি Comprehensive Road Safety Law বা
সড়ক নিরাপত্তা আইন দ্বারাই বাস্তবায়ন সম্ভব, যেখানে থাকবে–
–মাল্টি-মোডাল বা বহুমাত্রিক পরিবহন ও ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা
–নিরাপদ সড়ক অবকাঠামো
–নিরাপদ মোটরযান
–নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী
–দুর্ঘটনা-পরবর্তী ব্যবস্থাপনা এবং
(সর্বোপরি আইনের যথাযথ প্রয়োগ)
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পট পরিবর্তনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সকল ক্ষেত্রে যেরূপ সংস্কারের উদ্যোগ
নিয়েছে সড়ক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও সেরূপ উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে একটি পৃথক ‘সড়ক নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করে দেশে সড়ক
নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধকরণে, দারিদ্র্য দূরীকরণে ও পরিবেশের উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা
রাখবে বলে আশা রাখি।
লেখক: প্রোগ্রাম ম্যানেজার, রোড সেফটি, ব্র্যাক

মন্তব্য করুন