মাছে ভাতে বাঙালি: আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্য

রেজাউল মাসুদ
  প্রকাশিত : ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১৭
অ- অ+

আমি তখন লাবিবার বয়সী। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। পড়ন্ত বিকেলে কাটাখালি পুলের কাছে আসতেই মাক্কু মামা আমাকে ডাকলো। কাটাখালি পুল হলো আমাদের দুটো বিলের সংযোগস্থল যা আশপাশের কয়েকটা গ্রামের মাছ ধরার অন্যতম জায়গা। স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে মাক্কু মামাকে এখানে প্রায়ই মাছ ধরতে দেখতাম। "মামা একটু দাঁড়াও তোমাকে আজ কিছু মাছ দিব, তোমার মাকে বলো আজকে রাতেই যেন রান্না করে।"

মামাকে দেখলাম তৌরা জাল রেডি পজিশনে নিয়ে আস্তে আস্তে পা টিপে একটু পানির ভিতরে গেল এবং সেখানে আগে থেকেই চারা করা একটা জায়গায় সজোরে খেউ মারলো।

কালও তৌরা জালটি পানি থেকে যখন আস্তে আস্তে তুলতে ছিল দেখতে ছিলাম অসংখ্য সাদা পুটি মাছে মামা যেন জালটিকে পানি থেকে তুলতে পারছে না। আমাকে সব মাছ দিতে চাইল! আমি ছাতার মধ্যে সব মাছ নিয়ে নিলাম।

খুশিতে নাচতে নাচতে বাড়ি এসে আম্মার কাছে যখন মাছগুলো ঢাললাম, দুই তিন কেজি হবে আম্মা তা দেখে অবাক।একদম সোনালী কালার পুটি মাছ গুলো লাফাচ্ছিল তখন। রাতের রান্নায় মুলার ছেই আর সিম দিয়ে আম্মা ঝোল করল আর সাথে কিছু মাছ ভেজে দিল। আহ কি স্বাদ! যেন এখনো মুখে লেগে আছে!

মাছে ভাতে বাঙালি প্রবাদটি যখন বইয়ে পড়তাম, তখন এর তাৎপর্য অতশত বুঝতাম না। ভাবতাম, এটা আবার কেমন কথা। কিন্তু এখন বুঝি, মাছ আসলে আমাদের রক্ত-মাংসের সঙ্গে মিশে আছে। যেদিন ভাতের সঙ্গে মাছ থাকে না, সেদিন মনে হয় কী যেন নেই, যেন দামি কোনো জিনিস হারিয়ে ফেলেছি। ছোট থেকে বুড়ো, সবাই মাছের পাগল। এমন সুস্বাদু ও উপকারী খাবার আমরা অহরহ পাই বলেই হয়তো এখনো অনেকে এর গুরুত্ব বুঝে না। মাছ মহান আল্লাহতায়ালার এক অশেষ নিয়ামত

ভোজনে জৈবিক প্রয়োজন ছাড়াও যে একটা তৃপ্তি বা আনন্দের অনুভূতি আছে সেটা তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই। আমি ভোজনবিলাসী নই কিন্তু ভোজনরসিক, পরিমাণে খাই অল্প কিন্তু যেটুকু খাই সেটা হতে হয় সুস্বাদু ও পরিতৃপ্তিদায়ক। তাই সেকাল হোক কি একাল, সব যুগের খাবারেই মন ভরাতে কিন্তু ভাত-মাছে আপোষ চলে না। কতশত মাছের নাম আর স্বাদ যে লেগে আছে আমাদের মননে।

আমাদের জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে মাছ আর মাছ। জন্ম-বিবাহ-মৃত্যু সব প্রোগ্রামেই মাছের উপস্থিতি লক্ষণীয়। আমরা মাছ খাওয়ার উপযোগী করি সেঁকে, সামান্য পুড়িয়ে, ঝোল ঝালে, ভেজে, ভাপে সিদ্ধ করে, ভর্তা বানিয়ে, বড়া বানিয়ে কিংবা কোফতা করে। আবার বিভিন্ন মাছের সঙ্গে আলাদা সবজি দেওয়ার পদ্ধতিও আমাদের জানা আছে।

ছোট মাছের প্রতি আমার আগ্রহটা সেই ছোটবেলা থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয় ডাইনিং মেস পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলাম কয়েকবার। বন্ধুরা মজা করে বলতো এইবার টানা ছোট মাছ চলবে। পুলিশ একাডেমিতে সারদার ট্রেনিং এর সময় ছোট মাছের পছন্দের কথা বললে সিনিয়ররা এ নিয়ে হাসাহাসি করছিল বলছিল অফিসাররা ছোট মাছ খাবে! গ্রামের সাধারণ মানুষের আমিষের প্রধান উৎস কিন্তু ওই ছোট মাছই। মলা, ঢেলা, চেলা, টেংরা, পুঁটি, কাচকি মাছ! মাছের বাজারে গেলে আমার চোখ সবসময় এগুলোর দিকে যায়। লাবিবারা এখন এসব কম খেতে চায়, আমি বলি মা এসবে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক, আয়োডিন, মিনারেল, ফসফরাস ও ভিটামিন-এ থাকে। তোমার বাড়ন্ত শরীরে এসব অনেক বেশী প্রয়োজন।

দুই যুগ আগেও আমাদের নদী-নালা ও খাল-বিলগুলোতে দেশীয় মাছের প্রাচুর্য ছিল। প্রত্যেক পরিবারের পুকুরগুলো নানা প্রকার মাছে পরিপূর্ণ ছিল। বর্ষার আগমনে এসব মাছ মহোৎসবে নদী, নালা, খাল, বিল, পুকুর, ডোবায় মাছের ছলাৎ, ছলাৎ শব্দে মুখর হয়ে উঠত। হাওর-বিলে মাছের খেলায় আমরা দর্শক মাত্রই বিমোহিত হতাম। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়েছে।

মাছে ভাতে বাঙালি, আমিও তার বাইরে নই। আমি ভাগ্যবান আমি বাঙালি। আর আব্বা প্রচুর মাছ ধরতো। আমার ছোটভাই আব্বার স্বভাব পেয়েছে। গ্রামে তিনটা পুকুর এখনো সচল সজিব। আমি বাড়ী গেলে ছোটবেলার সবধরনের ছোটমাছ ডাইনিং টেবিলে থাকবেই! আম্মা বলে ওর জন্য দারকিনা রাখ! ছোট ভাই তার বউকে বলে গোতুম মাছ রান্না করছ? সত্যি ভাগ্যবান আমি, নাহলে কতশত পদের মাছের অতুলনীয় স্বাদ হয়তোবা এ জন্মে পাওয়া হয়তো না আমার।

শরীর সুস্থ হোক বা খারাপ হোক মাছ যেন আমার অমৃত। যদি বলেন কেনো এমন মাছ প্রীতি? তাহলে বলবো এটা আমার ব্যক্তিগত বা বংশগত হতে পারে। আমার দাদা বলতেন মাছ ছাড়া খাবার হয় নাকি। ঠিক তাই!! আমার রক্তে তারই সেই পরম্পরা বোধহয় আমি পেয়েছি।

খাবার হতে হবে নৈষধচরিতে ভাতের বর্ণনার মতো- ‘পরিবেশিত অন্ন হইতে ধুম উঠিতেছে, তাহার প্রতিটি কণা অভগ্ন, একটি হইতে আরেকটি বিচ্ছিন্ন, সে অন্ন সুসিদ্ধ, সুস্বাদু আর শুভ্রবর্ণ, সরু ও সৌরভময়।’ আজও খাবার পাত তেমনি হতে হবে, তবেই না রসনায় তৃপ্ত হবে মাছ-ভাতের বাঙালি।

লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
গুলশান থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হলো অভিনেতা সিদ্দিককে
রংপুরে রোহিঙ্গা নারীকে জন্মনিবন্ধন দেওয়ায় ইউপি চেয়ারম্যান বরখাস্ত
৬০ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানে আক্রমণ করতে পারে ভারত: আশঙ্কা পাক তথ্যমন্ত্রীর
কলকাতায় হোটেলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ১৪ জনের মরদেহ উদ্ধার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা