বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও অপরাধপ্রবণতা: প্রতিরোধের পথ কোথায়?

মোমেনুর রহমান
  প্রকাশিত : ২৩ মার্চ ২০২৫, ০৮:২৫
অ- অ+

বর্তমান সমাজে ক্রমবর্ধমান অপরাধপ্রবণতা আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচারব্যবস্থা এবং সামাজিক কাঠামোর সামগ্রিক কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে ঘটে যাওয়া অপরাধ হোক কিংবা প্রকাশ্য রাস্তায় সংঘটিত সহিংসতাসর্বত্রই এক অদৃশ্য নিরাপত্তাহীনতা মানুষকে গ্রাস করছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছেআইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী আদৌ কতটুকু সামাজিক অপরাধ রোধে সক্ষম? আর যদি না পারে, তাহলে এর দায়ভার কে নেবে?

অপরাধের ধরন ও প্রতিরোধের সীমাবদ্ধতা

যেসব অপরাধ ব্যক্তি গোপনে, বিশেষত ঘরের অভ্যন্তরে সংঘটিত করে, তা প্রতিরোধ করা এককভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব। পারিবারিক সহিংসতা, শিশু নির্যাতন, মানসিক নিপীড়ন বা যৌন হয়রানির মতো অপরাধগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়। একইভাবে, আধিপত্য ও ক্ষমতা নিয়ে বিরোধ এবং সম্পত্তি নিয়ে সংঘর্ষও সমাজে মারাত্মক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। ভূমি দখল, জোরপূর্বক সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়া, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সাধারণ মানুষের অধিকার হরণএই সবই আজ এক নৈমিত্তিক চিত্র।

বর্তমানে সবচেয়ে বড় সামাজিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্ষমতা ও সম্পত্তি কেন্দ্রিক সহিংসতা। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রচ্ছায়ায় অসংখ্য মানুষ তাদের জমি, বসতভিটা, এমনকি জীবনের নিরাপত্তাও হারাচ্ছেন। এসব সহিংসতা শুধু ব্যক্তি বা পরিবারকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং গোটা সমাজে ভয় ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি করে। অনেকে আইনের আশ্রয় নিতে চাইলেও বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা, মামলা মোকদ্দমার খরচ ও হুমকি-ধামকির কারণে পিছিয়ে যান।

একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তি যেমন জীবন সহজ করেছে, তেমনি তৈরি করেছে নতুন ধরনের অপরাধসাইবার ক্রাইম। নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে অনলাইন হয়রানি, ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস, অর্থ জালিয়াতি, ফিশিং ও হ্যাকিং ইত্যাদি আজ উদ্বেগজনক মাত্রা পেয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, অধিকাংশ মানুষ এখনো এসব অপরাধের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পথ সম্পর্কে সচেতন নন। পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রযুক্তিগত দক্ষতাও এখনো অনেক সীমাবদ্ধ।

বিচার ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা

বিচার বিভাগের নাল হাইপোথেসিস—‘প্রত্যেক অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্দোষ, যতক্ষণ না তার অপরাধ প্রমাণিত হয়’—সর্বজনীন এক নীতি হলেও, আমাদের বাস্তবতায় এটি অনেক সময় বিচার বিলম্বের ও অপরাধীর দায়মুক্তির সুযোগ হয়ে দাঁড়ায়। মামলা নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রতা, দুর্বল তদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাব এবং প্রভাবশালী মহলের হস্তক্ষেপ বিচারব্যবস্থাকে প্রায় পঙ্গু করে ফেলেছে। ফলে অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় বিচারহীনতার এক দুর্বৃত্ত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।

দেশে আইন আছে, কিন্তু সেই আইন কার্যকর করার সদিচ্ছা ও দক্ষতা নেই বলেই ন্যায়বিচার অধরা। প্রশ্ন উঠেএই ব্যর্থতার দায় কাদের? আইন প্রণয়নকারী নাকি আইন প্রয়োগকারী? বাস্তবতা হলো, যুগ যুগ ধরে উভয়ের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও জবাবদিহিতার ঘাটতি সমগ্র ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলেছে।

সচেতনতা ও প্রতিরোধ: সমাজের সম্মিলিত দায়িত্ব

ব্যক্তি নিরাপত্তা শুধু রাষ্ট্রের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না। একজন ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি তার নিজের ওপর। এরপর আছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র। নিজেকেই চিন্তা করতে হবে কীভাবে পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপদে থাকা যায়। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্যে আলাদা আলাদা গাইডলাইন থাকা দরকার। সমস্ত সাবধানতা সত্ত্বেও বিপদ চলে আসতে পারে। সেক্ষেত্রে চুপকরে থাকা যাবে না, সোচ্চার হতে হবে ন্যায় বিচারের জন্যে।

প্রতিটি নাগরিকেরই উচিত নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যক্তিগত সাবধানতা অবলম্বন করা। পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী, বন্ধু, সহকর্মী, পরিচিত, অপরিচিত সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে অপরাধ রোধে সচেতন ভূমিকা রাখতে। অভিযোগ জানাতে ভয় পাওয়া, চুপ থাকা কিংবা কি দরকার ঝামেলায় জড়ানোর মানসিকতা সমাজকে আরও দুর্বল করে তোলে।

অসহিষ্ণুতা, হতাশা ও নৈতিক অবক্ষয় সমাজে অপরাধের জন্ম দেয়। তাই মানবিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক সহনশীলতা এবং সম্মানের চর্চা অপরিহার্য। নৈতিক শিক্ষা, সুস্থ বিনোদনের সুযোগ অপরাধপ্রবণতা কমাতে সহায়ক হবে।

উপসংহার

অপরাধ দমনে কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা বিচারব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও বহুমাত্রিক উদ্যোগ, যেখানে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি সমভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে হলে আমাদের প্রত্যেককে সচেতন, সাহসী ও দায়িত্বশীল হতে হবে। কণ্ঠ রোধ নয়, বরং ন্যায়বিচারের পক্ষে সোচ্চার হওয়াই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
রংপুরে রোহিঙ্গা নারীকে জন্মনিবন্ধন দেওয়ায় ইউপি চেয়ারম্যান বরখাস্ত
৬০ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানে আক্রমণ করতে পারে ভারত: আশঙ্কা পাক তথ্যমন্ত্রীর
কলকাতায় হোটেলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, ১৪ জনের মরদেহ উদ্ধার
তিন সাংবাদিকের চাকরিচ্যুতিতে সরকারের সংশ্লিষ্টতা? যা বললেন উপদেষ্টা ফারুকী
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা