অধিনায়ক মাশরাফি, পেশাদার মাশরাফি

মাশরাফিকে নিয়ে একটা গল্প শোনাতে চাই। গল্পটা গত বছর বিপিএল শুরু হওয়ার ঠিক আগের। তার আগে আমাকে একটু ভূমিকা করতে হবে। ক্রীড়াজগতের ড্রেসিংরুম ঘিরে হাজার হাজার কাহিনী গড়ে ওঠে। কখনো নেতিবাচক, কখনো ইতিবাচক। যার কিছু কিছু ঘটনা আমরা জানতে পারি। বেশিরভাগ পারি না। যারা জানেন, তারা আবার নৈতিকতা আর পেশাদারিত্বের বেড়াজালে জানাতে পারেন না। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় দলের সর্বকালের অন্যতম সেরা অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজার তেমনি একটি ঘটনা ঘটেছে। মাশরাফি রাগের মাথায় টিম হোটেল ছেড়ে ঠিক কাজ করেছেন কি না, কিংবা ঘটনার পরপর সংবাদ মাধ্যমে বক্তব্য দিয়ে কতটুকু পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়েছেন তা নিয়ে দেখছি কেউ কেউ আলোচনা করছেন।
মাশরাফি ঠিক কিংবা ভুল কাজ করেছেন কি না, সেই রায় টানার দুঃসাহস আমি করবো না। তবে ঘটনার আগে পরে কিছু কিছু ঘটনার ছবি ভেঙে ভেঙে দেখতে চাইবো। তারপর সেটা জোড়া লাগালে পূর্ণাঙ্গ একটা ছবি বের হবে। যে যার মতো করে সেই ছবিতে নতুন একটি ছবি ফোটাতে পারেন। ছবি আঁকতে আঁকতে এবার সেই গল্পটা শোনা যাক…
ছবি: এক
গত বছর কুমিল্লার অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফির নাম ঘোষণার পর নতুন প্রজন্মের প্রতিশ্রুতিশীল ক্রীড়া সংগঠক নাফিজা কামাল ‘নিজের অজান্তে’ বলে বসেন, ‘আমরা একজন অলরাউন্ডার চেয়েছিলাম।’ গণমাধ্যম তার এই বক্তব্যের বিভিন্ন মানে দাঁড় করায়। এমনও প্রশ্ন উঠে আসে, তাহলে কি তিনি মাশরাফিকে চাননি? নাফিজা কামাল পরে দাবি করেন, তিনি ওইভাবে বলতে চাননি। ম্যাশকে পেয়ে তারা খুশি।
ছবি: দুই
ওই ঘটনার পরদিন মিরপুরের একাডেমি মাঠে মাশরাফিকে দেখা যায়। সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে অনেক কথা বলেন। শুরুতে বলছিলেন, ‘আমি তার কথায় কিছু মনে করিনি। আমার মনে হয় না আপনারা যেমন ভাবছেন তিনি ওইভাবে বলেছেন। আমি যদি মালিক হতাম, আমিও একই চিন্তা করতাম। সাকিবের মতো অলরাউন্ডারকে নিতে চাইতাম। কিংবা রিয়াদকে।’
মাশরাফি কথা প্রসঙ্গে বলে যান, পেশাদার ক্রিকেটারদের খেলতে গেলে এমন অনেক পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। এমনকি জাতীয় দলেও। জাতীয় দলের প্রসঙ্গ উঠতেই মাশরাফি আসল কথাটা বলে যান। যে কথাটা শোনানোর জন্য এই লেখা। মাশরাফির সেদিনের বক্তব্য ছিল এমন, ‘জাতীয় দলে খেলার সময় বাইরে থেকে কেউ কিছু বললে মাঠে বসে ভুলে যাই। তখন মাথায় থাকে দেশের হয়ে খেলছি। আমি বাংলাদেশের। নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির নই। কিন্তু ক্লাবে খেললে সব কথা সহজে সবাই মেনে নিতে পারে না।’
কুমিল্লার টিম হোটেল ত্যাগের কথা শুনে আমার ওই দিনের কথা স্মরণে আসছিল। বারবার ভাবছিলাম, জাতীয় দলে এমন ঘটনা ঘটলে মাশরাফি কি হোটেল ছেড়ে বের হয়ে যেতেন?
ছবি: তিন
২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ‘দ্য নিউএজ’ পত্রিকায় ‘দ্য আনটোল্ড স্টোরি অব ২০১৫’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। মনে পড়ে আমি সেটা অনুবাদ করে ঢাকাটাইমসে প্রকাশ করেছিলাম। সেখানে বলা হয়, দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডের আগে মাশরাফি অধিনায়কত্ব ছাড়তে চেয়েছিলেন! গণমাধ্যমের সঙ্গে বোর্ড সভাপতি পাপনের কিছু কথায় মাশরাফি হতাশ ছিলেন। পরে ওই ম্যাচে বাংলাদেশ দারুণভাবে জয় পায়। পাপনও চুপ করে যান।
এখানে খেয়াল করার বিষয় হলো, মাশরাফি কিন্তু অধিনায়কত্ব ছাড়তে চেয়েছিলেন। দল থেকে বেরিয়ে যেতে চাননি। এমনকি গতকালের মতো খেলতেও অস্বীকৃতি জানাননি। দায়িত্ব যে কোনো কারণে তিনি ছাড়তেই পারতেন। বাকি যা ঘটুক, লাল-সবুজের জার্সিতে মাঠে ঠিকই নামতেন। নিজেকে উজাড় করেও দিতেন।
ছবি: চার
মাশরাফিকে আমরা কুমিল্লার জন্য ব্যথা নিয়েও খেলতে দেখেছি। ঝুঁকি নিয়ে উপরে ব্যাটও করতে দেখেছি। একজন অধিনায়ক তখনই এসব করতে পারেন, যখন খেলাটাকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। আর শুধু জিততে চান। একজন অধিনায়ক তখনই অধিনায়কত্ব ছাড়ার কথা ভাবেন, যখন তার হৃদয়ে বড় কোনো আঘাত লাগে। মাশরাফির সঙ্গে ভিক্টোরিয়ান্স মালিকপক্ষের আসলে কী ঘটেছিল, তার সবটা আমরা জানতে পারিনি। হয়তো কোনোদিন জানাও যাবে না। কিন্তু সেই ঘটনার একটা ছবি ঠিকই কল্পনা করা যায়।
পাঠক, লেখার শুরুতে আমি আর একটা ছবির কথা বলেছিলাম। যেটা কল্পনা করার কথা আপনাদের। হৃদয় ভেদে এই দুটো ছবির স্কেচ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে একটা মিল নিশ্চয়ই থাকবে।
আঘাতের জলছাপ!
(ঢাকাটাইমস/১৫নভেম্বর/এএম)

মন্তব্য করুন